X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

পালাবার পথ খুঁজি রোজ…

সৈয়দা আখতার জাহান
৩১ অক্টোবর ২০১৯, ১৫:৪৫আপডেট : ৩১ অক্টোবর ২০১৯, ১৫:৫৭

সৈয়দা আখতার জাহান ‘বয়েলিং ফ্রগ’ সিনড্রোম একটা জনপ্রিয় মেটাফোর। একটা ব্যাঙকে যদি আপনি একটি পানিভর্তি পাত্রে রাখেন এবং পাত্রটিকে উত্তপ্ত করতে থাকেন, তবে ব্যাঙটি পানির তাপমাত্রার সঙ্গে সঙ্গে নিজের শরীরের তাপমাত্রা ভারসাম্যে রাখতে থাকে। পানির উত্তাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙটিও নিজের সহ্যক্ষমতা বাড়াতে থাকে, লাফ দিয়ে বেরোনোর পরিবর্তে। কিন্তু একসময় পানির প্রচণ্ড তাপমাত্রা ব্যাঙের শরীর আর মানিয়ে নিতে পারে না। পানির প্রচণ্ড উচ্চতাপমাত্রার সমতায় নিজের শরীরের তাপমাত্রা সহ্যক্ষমতা তার নিজসীমার বাইরে চলে যায়। এমন পরিস্থিতিতে তখন ব্যাঙটি ফুটন্ত পানির পাত্র থেকে লাফ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়তো নেয়। কিন্তু সে তখন আর লাফ দিতে পারে না, কেননা ততক্ষণে ব্যাঙটি তার সমস্ত শক্তি তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ব্যয় করে ফেলেছে। অতঃপর সে পানিতে সেদ্ধ হতে থাকে। ব্যাঙটির মৃত্যুর কারণটা কিন্তু আসলে গরম পানি না, বিপজ্জনক পরিস্থিতির শুরুতে সেই পরিস্থিতি অস্বীকার করে লাফ না দেওয়াটা তার মৃত্যুর কারণ।
আবরার ফাহাদ নামে বুয়েটের মেধাবী যে ছাত্র সম্প্রতি তারই সহপাঠীদের দ্বারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন, সেটা এই সমাজের ‘বয়েলিং সিনড্রোমটা’কে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। গণমাধ্যমে সম্প্রতি যে সংবাদগুলো উঠে আসছে, তাতে এটা পরিষ্কার, এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে র‌্যাগিংয়ের নামে শিক্ষার্থী নির্যাতন নতুন কিছু নয়। বরং বছরের পর বছর পুনঃপুন চর্চায় তা যেন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। এর পেছনে ক্ষমতাসীনদের বেপরোয়া আচরণ আর সাধারণ ছাত্রদের সবকিছু সহ্য করে নেওয়ার মানসিকতাই আবরার কিংবা মোমতাজের মৃত্যুর কারণ। খুব সম্ভবত আমরাও ওই ব্যাঙের মতো মানিয়ে নিচ্ছি আমাদের চারপাশের সঙ্গে। সহ্য করছি সব, আর ভাবছি টিকে তো আছি!

প্রত্যেকেরই জানা উচিত সে আসলে কে? কী তার উদ্দেশ্য? সমাজে একশ্রেণির মানুষ আছেন যারা উঁচু স্তরের কিছু ভাবেন না, কোনও কিছুকেই গভীর করে অনুভব করেন না। জীবনের মানে না জেনেই কাটিয়ে দেন একটা জীবন। তবে তারা হরহামেশাই যেটা করেন, সেগুলোকে ভদ্র ভাষায় ‘স্থূল রসিকতা’ বলা যেতে পারে। অধিকাংশ মানুষই বেশিরভাগ সময় চলতি পন্থার দাসত্ব করে। অন্যের দেখিয়ে দেওয়া পদ্ধতিতে জীবনযাপন করতে গিয়ে নিজের সত্যিকারের সত্তাটা আর তাদের চেনা হয় না। সময় ভয়ানক প্রতারক। চলছে সুপরিচিত সুবিধাবাদীদের সুসময়। এভাবে চলতে থাকলে মানুষ একসময় মুখ খুলতে ভুলে যাবে।

ডিজিটালাইজেশনের এই যুগে বর্তমানটা বেশ আকর্ষণীয়। তরুণদের কাছে রয়েছে এমন প্রযুক্তি যা বিশ্বকে ক্রমাগত ছোট এবং দৃশ্যমান করে তুলেছে। দূরত্ব কমিয়ে সবাইকে পরস্পরের প্রতিবেশী করে দিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তরুণরা যেমন তথ্য পাচ্ছে, সেই সঙ্গে তারা তাদের যুক্তি, বার্তা, অভিমতও প্রকাশ করছে। স্মার্টফোনের স্ক্রিন হয়ে উঠেছে অভিমত প্রকাশের জায়গা। নাকি ‘সহমত ভাই’ প্রকাশের মাধ্যম। আবরার ফাহাদ চলতি পন্থার মধ্যে থেকেও কিছু তথ্য তুলে ধরেছিলেন, সেটাই ছিল তার অপরাধ। অন্তঃসারশূন্যদের মতো তিনি স্মার্টফোনটাকে সেলফি তোলার কাজে ব্যবহার করেননি।  

আবরারকে হত্যা করলো তার সহপাঠীরা, ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে নিষ্ঠুরতার চরম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়তে আসা এই কয়েকজন শিক্ষার্থীও প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় পড়াশোনা করে বুয়েটে পড়তে এসেছে। তাদের পরিবার-পরিজন-প্রতিবেশী সবই আছে। তবে তারা কেন এমন আচরণ করলো? কারণটা আত্মগোপন করে নেই। দিনের আলোর মতো পরিষ্কার, তারা ক্ষমতার দাপট দেখাতে সংঘবদ্ধভাবে অপরাধটা করেছে। হীন আনুগত্য তাদের আমার চতুষ্পদী জন্তু করে তুলেছিল। তারা দেখিয়ে দিয়েছে মানুষ যতটা উদার হতে পারে, তার থেকে শতগুণ নিষ্ঠুর হতে পারে। আবরারের সঙ্গে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা সমবেদনার চেয়েও মনোযোগ দাবি করে বেশি।

স্বভাবগতভাবে অন্ধকারপ্রিয় মানুষদের চাইলেই সভ্য বানানো যায় না। জোর করেও না। জোর করলেই কি সব হয়? যদি মানুষ ছোটবেলা থেকে সামাজিক মূল্যবোধের মধ্যে বড় না হয়। আজকালকার ছেলেমেয়েরা কি সময়ের বহু আগেই প্রাপ্তবয়স্কের স্বপ্নভঙ্গের অভিজ্ঞতা লাভ করেছে? সমস্যাকে দীর্ঘদিন জিইয়ে রাখাও এক ধরনের সমাধান। পুরনো রোগের মতো পুরনো সমস্যা নিয়ে কেউ বেশিদিন শুনতে চায় না। জীবিতদের থেকে লাশগুলো এখন অনেক বেশি মানবিক। ক্ষমতার দখলদারিত্ব নিয়ে ঝগড়া করে না। চাওয়া-পাওয়ার সামান্য ব্যবধানে একটা আপিল বেঞ্চ আছে। পৃথিবীর সবথেকে শক্তিশালী জুরিবোর্ড, বিবেকের অবস্থান সেখানে। অথচ সেই বিবেককে আমরা ব্যবহার করছি নীরবতার পাহারাদার হিসেবে।  

কমোডিটি ফেটিশিজমের এই যুগে চাহিদা আর জোগানের ঘেরাটোপে আটকে গেছি। মূল্যের বিচারে প্রতিনিয়ত বড় হচ্ছে সবকিছু, কেবল ছোট হই আমরা। চারপাশটা বড় দ্বান্দ্বিক। সাদা না কালো, চা না কফি, ভোর না গোধূলি, পাহাড় না সমুদ্র। সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পৌঁছতে আমাদের বোধগুলো হারিয়ে যায় কিংবা ফুরিয়ে যায়। দিন শেষে শূন্যতা আর অসন্তোষ। সামাজিক চাপ আমাদের সহনীয়ভাবে সুখী হতে শেখায়। জীবনের অসংখ্য স্ববিরোধিতা রয়েছে। রয়েছে যৌথ অভিজ্ঞতা। একজনের অন্যজনের প্রতি বাড়িয়ে দেওয়া সাহায্যের হাত ফুটিয়ে তুলছে মানবিক সৌন্দর্য। মানুষকে বিচার করতে শিখতে হবে মানবিক মূল্যবোধের নিরিখে। কান পেতে আছি কোনও হ্যামিলনের বাঁশির ডাক শুনবো বলে। কেউ কি ডাকে? কেউ কি ডাকবে?

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা এবং গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ