X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

আমরা যখন টেলিভিশন দেখতাম

ফয়েজ রেজা
২৫ নভেম্বর ২০১৯, ১৫:৫৯আপডেট : ২৫ নভেম্বর ২০১৯, ১৬:১৫

ফয়েজ রেজা বেডরুম থেকে আজ টেলিভিশনটা সরিয়ে নিলাম অন্যরুমে। বেডরুমে থাকার পরেও গত ৪ বছরে একদিনও দেখা হয়নি টেলিভিশন। একদিনও মনে হয়নি, টেলিভিশন দেখা প্রয়োজন। অথচ এক সময় রাতদিন কত চেষ্টা করে, কত বই পড়ে শিখেছিলাম টেলিভিশনের কাজ।
টেলিভিশনের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ‘ইত্যাদি’ ও ‘ম্যাকগাইভার’-এর সময়কালে। ইত্যাদি তো এখনও হয়, তারপরেও ‘সময়কাল’ বলছি, এর কারণ আশা করি এ লেখার পাঠকরা অনুধাবন করতে পারবেন। আমার মতো সম্ভবত সবার দেখার অভিজ্ঞতা একই রকম। অপরিণত বয়সে একটি উপজেলা শহরে হঠাৎ মশার কয়েল কেনার প্রয়োজনে রাতে দোকানে যাওয়ার প্রয়োজন হলো। বাসা থেকে বেরিয়ে দেখি একটি অন্যরকম রাত, মানে—এত আগে সব দোকান বন্ধ। হঠাৎ জনশূন্য রাস্তা। মানুষজনের কোলাহল দূরে থাক, পদচারণার শব্দও নেই। নেই রিকশার টুংটাং সতর্কবার্তাও। দূরে বিভিন্ন বাসাবাড়ি থেকে শুধু টেলিভিশনের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। সে শব্দ ও কণ্ঠ প্রায় সবার কানস্থ। বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘ইত্যাদি’র মিউজিক ও এর উপস্থাপক হানিফ সংকেতের কথা বলার নিজস্ব ভঙ্গি।

এটি অবশ্য সেই সময়ের কথা, যখন আমাদের মা খালাদের দেখতাম মাঝেমধ্যে সন্ধ্যার পর বাসার বাইরে যেতেন এবং এই বাইরে যাওয়ার অর্থ আমরা বুঝতাম সিনেমাহলে শাবানা বা ববিতার নতুন সিনেমা এসেছে। এর কিছুদিন পর দেখতাম শাবানা ও ববিতার পরনের শাড়ি ব্লাউজটি আমার মায়ের পরনে। শহরের দোকানে দোকানে ঝুলছে ‘ভিউ কার্ড’। নায়ক-নায়িকা ও নাটক সিনেমার বিভিন্ন চরিত্রের এসব ‘ভিউ কার্ড’ পকেটে পকেটে ঘুরতো গ্রামে, শহরে। গ্রামে-গঞ্জে শোলার (পাটকাঠি) বেড়ায় সাঁটানো থাকতো সিনেমার পোস্টার। মাইকিংয়ের জ্বালা যন্ত্রণায় আমাদের কণ্ঠেও সিনেমার কিছু ডায়ালগ চলে আসতো। এটি অবশ্য সেই সময়ের কথা, যখন গ্রামের কৃষকেরা কোমরে ‘ট্রানজিস্টার’ বেঁধে মাঠে কাজ করতে যেতেন। আর সেই ‘ট্রানজিস্টারে’ সিনেমার গান গ্রামের নীরবতা ভেঙে নতুন এক আবহসংগীতের সূচনা করতো মাঠে। আর প্রতি বছর শীতের রাতে যাত্রাপালার মঞ্চে পরিবেশিত হতো রঙিন রূপবান, রহিম বাদশা। 

এই সেদিনের দৃশ্য। আমরা এখনও ঠিক পরিণত হইনি। এর মধ্যেই কী অশরীরী শক্তি গ্রাস করে নিলো সিনেমার শক্তিকে। এর মধ্যে কী এক অদৃশ্য দৈত্য এসে আছাড় দিলো টেলিভিশনকে। কী এক বিতৃষ্ণার ঢেউ আঘাত করলো আমাদের রুচিবোধে? কী এক অদৈব ঝাঁকুনিতে মোহভঙ্গ হলো আমাদের? আর আমরা ক্রমশ মুখ ফিরিয়ে নিলাম টেলিভিশন থেকে, সিনেমা থেকে, যাত্রাপালা থেকে, কবিগান থেকে, বাউল গানের আসর থেকে। নতুন নতুন ইলেকট্রনিক ডিভাইস, গ্যাজেট, ফেসবুক, অনলাইন, ইউটিউব চ্যানেল কি তবে মৃত্যুঘণ্টা বাজাচ্ছে টেলিভিশনের? টেলিভিশন যেভাবে ‍মৃত্যুঘণ্টা বাজাতে চেয়েছিল সিনেমার! নাকি রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অনুশাসনে বিলোপ হয়ে যাচ্ছে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য?  

এখন তো আমরা দুই হাত খুলে আমন্ত্রণ জানাই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে। যখন আমরা কুসংস্কারের মোহে আচ্ছন্ন ছিলাম, যখন আমরা ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে রেখেছিলাম, তখনও তো কুসংস্কারের বেড়া ভেঙে ‘কিরণকুমার’ নামে পর্দায় উঠেছিলেন মুসলমান অভিনেতা ফতেহ লোহানি। মিস লোলিটা উপহার দিয়েছিলেন ‘দ্য লাস্ট কিস’।

সিনেমার বড় পর্দাকে ঠেস দিয়ে নতুন টেলিভিশন নাকি এসেছিল ঘরে। বিনা বাধায় ঘরে তখন ঢুকে পড়েছিল পৃথিবীর নানা প্রান্তের দৃশ্য, নৃত্য, সংগীত, খবর, কমেডি। তার সঙ্গে এসেছিল নতুন নতুন পণ্য ও বিজ্ঞাপন। মুহূর্তেই আমরা বিনোদনের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়েছিলাম। নতুন নতুন বিজ্ঞাপনের ভাষায় খেই হারিয়ে নানান রকম তৈজসপত্র দিয়ে ভরে তুলেছিলাম আমাদের ড্রয়িংরুম, ডাইনিং টেবিল আর শোবার ঘর। এই ফাঁকে বিনোদন কোথায় হারিয়ে গেলো? খবর রাখিনি তার।  

আমরা গল্পে শুনি, বইয়ে পড়ি—এক সময় আমাদের সিনেমার পরিচালকেরা ছিলেন ভাষা আন্দোলনের প্রেরণায় উজ্জীবিত। তাদের পরিচালিত সিনেমার গল্প, সংলাপ ও গানে দেশপ্রেমের উপস্থাপন ছিল। ছিল বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ঢেউ। এরপর অতি মুনাফাখোরদের নিয়ন্ত্রণে গেলো সিনেমা। ‘গল্পের প্রয়োজনে’ বলতে বলতে সিনেমায় ঢুকলো উর্দু সংলাপ, উর্দু গান। নাচগানে ভরপুর হলো সিনেমা। অতিরিক্ত মুনাফাখোরদের কাছে ক্রমে দুর্বল হলো দেশপ্রেমে উজ্জীবিত নির্মাতারা। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের পর আবারও বাংলার জয়গান দেখা গেলো সিনেমায়। আবারও উর্দু ও হিন্দি নাচ গান এসে গ্রাস করলো বাংলা সিনেমাকে। এরপর সাহিত্য ও লোকজীবনের গল্পে নতুনভাবে উজ্জীবিত হলেন সিনেমার পরিচালকেরা। বাংলা সিনেমাও হলো ‘হাউজফুল’। আবারও শ্লীল-অশ্লীলতার বিতর্কে সিনেমাবিমুখ হলেন দর্শক। এই করে করে যখন ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে ছিল বাংলা সিনেমা, তখন ঘরের টেলিভিশনে শুরু হলো বাংলা সিনমার ‘ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার শো’। নতুন চমকে বাক্সবন্দি হলো বড় পর্দার সিনেমা। টেলিভিশনের জনপ্রিয়তার সঙ্গে সিনেমার একচেটিয়া বাজারের বিপুল ক্ষতি হলো!

টেলিভিশনের গরম কাল, এ তো আমাদেরই চোখে দেখা। গ্রামে-গঞ্জে, যেখানে বিদুৎ সংযোগ ছিল, চায়ের দোকানে, রেলস্টেশনে, বাজার, ঘাটে মানুষ জড়ো হয়ে দেখছে টেলিভিশন। সে টেলিভিশনে তারা শুধু বাংলা সিনেমা দেখতো না। দেখতো খবর, দেখতো নাটক, নাচ, গান। ন্যাশনাল জিওগ্রাফির মতো বনে জঙ্গলের প্রাণীদের আনন্দ-বেদনার দৃশ্যও দেখতো মানুষ। এরপর তো টেলিভিশনের সংখ্যা বেড়েছে, বাড়ছে। নতুন শিল্পপতিদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে একটি করে টেলিভিশন। দেশি নাটকে আস্থা নেই, তাই বিদেশ থেকে আমদানি হচ্ছে ‘সিরিয়াল’। দিনের চব্বিশ ঘণ্টাই বসছে বিনোদনের পসরা। খবর বা গুজব, যখন যেখানে যা ঘটছে, সেখান থেকেই তা প্রচার করা হচ্ছে টেলিভিশনে। প্রতিযোগিতার দৌড়ে কখনো সত্যতা যাচাইয়ের সুযোগ পাচ্ছেন সংবাদকর্মীরা। কখনো সত্যতা যাচাই ছাড়াই রঙেচঙে একাকার করা হচ্ছে দৃশ্যগুলো। এতকিছুর পরেও মানুষ টেলিভিশনবিমুখ! নাকি বিনোদনবিমুখ?

মঞ্চ নাটক না টেলিভিশন নাটক? নাটকের জন্য মঞ্চ নাকি টেলিভিশন? টেলিভিশনের জন্য কি হুমকির সম্মুখীন মঞ্চ নাটক? এমন কত বিতর্ক এক সময় শোনা যেতো এই শহরে। এমন কত সংবাদ ও ফিচার এক সময় প্রকাশিত হতো খবরের কাগজে, ম্যাগাজিনে। শিরোনামগুলো এখন বিলুপ্তপ্রায়। টেলিভিশনের খবরে এখন নতুন শিরোনাম যুক্ত হচ্ছে—‘অনিশ্চয়তা ও চ্যালেঞ্জ’। এই অনিশ্চয়তা হয়তো বেঁচে থাকা না থাকা মানে টেলিভিশনের অস্তিত্ব টিকে থাকা না থাকার অনিশ্চয়তা। এই চ্যালেঞ্জ হয়তো টেলিভিশনকে টিকিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জ। টেলিভিশনে যারা কাজ করেন, তারা হয়তো জানেন, কতটা অনিশ্চয়তায় প্রতিদিন অফিসে যান তারা? অফিস শেষে ফিরে আসেন বাসায়? তাদের কতজন অভিজ্ঞ সহকর্মী আজ কর্মহীন, বেকার। টেলিভিশনের মালিকানা যাদের হাতে এবং যারা এর পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত, তারা হয়তো জানেন, প্রতিবছর কত টাকা গচ্চা দিয়ে টিকিয়ে রাখছেন টেলিভিশন। টেলিভিশনে যারা অভিনয় করেন, যারা গান করেন, যারা শিল্পী, তারা হয়তো জানেন নিজের শিল্পী সত্তা বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে কত কম বাজেটের এবং মানহীন অনুষ্ঠানে অভিনয় করতে হয় কিংবা ‘পারফর্ম’ করতে হয় তাদের। এতগুলো চ্যানেল থাকার পরেও একটি ভালো অনুষ্ঠান বা নাটকে কাজ করার জন্য কতদিন অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয় শিল্পীদের। এই যে এত বড় ও শক্তিশালী একটি সংবাদ ও বিনোদন মাধ্যম, এই মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত প্রায় প্রতিটি মানুষ যে অনিশ্চয়তা ও চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিনাতিপাত করছেন, সেই অনিশ্চয়তা ও চ্যালেঞ্জের কোথাও কিন্তু বিনোদন বা খবরের কথা পাবেন না। পাবেন অর্থ প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির প্রসঙ্গ। বিজ্ঞাপন কমে গেছে, বিজ্ঞাপন কমে যাচ্ছে, লাভ হচ্ছে না, লোকসানে আছে, আমরা লাভে নেই, কোনোরকম টিকে আছি, ঘুরেফিরে এই শব্দগুলো শুনবেন, যারা টেলিভিশনের দরজার কাছাকাছি হাঁটেন তারা। এই বিষয়গুলো যৌক্তিক এবং টেলিভিশনের সঙ্গে যারা সরাসরি সম্পৃক্ত, তাদের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। কিন্তু যাদের জন্য টেলিভিশন অর্থাৎ দর্শকরা, তাদের কাছে কি মূল্য আছে শব্দগুলোর। তারা তো চায় যথার্থ বিনোদন। তারা তো চায় খবর মানে প্রকৃত এবং সঠিক খবর। প্রকৃত ও সঠিক খবর এবং যথার্থ বিনোদন প্রদানের চ্যালেঞ্জ কি কেউ নেবেন? নাকি ‘টাকা কই কই’ বলে চিৎকার করে টেলিভিশনের মৃত্যুঘণ্টাটি বাজাবেন? বিনোদন ও খবরের খোঁজে দর্শকরা কিন্তু এখন তার হাতের ফোনেই স্ক্রল করছে ঘণ্টায় ঘণ্টায়, কাজের ফাঁকে, অবসরে।  

লেখক: ছড়াকার ও তথ্যচিত্র নির্মাতা

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ