X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

পরশের স্পর্শে ‘শুদ্ধ’ হবে যুবলীগ?

বিভুরঞ্জন সরকার
২৬ নভেম্বর ২০১৯, ১৯:১৬আপডেট : ২৬ নভেম্বর ২০১৯, ১৯:৫০

বিভুরঞ্জন সরকার রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম হলেও এতো বছর রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন শেখ ফজলে শামস পরশ। কিন্তু পারলেন না নিজেকে রাজনীতির বাইরে রাখতে। পিতা শেখ ফজলুল হক মনি। বাংলাদেশের রাজনীতির এক আলোচিত নাম, গত শতকের ষাটের দশকের তুখোড় ছাত্রনেতা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ মনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে এবং রাজনৈতিক অনুসারী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার দিন শেখ মনি এবং তার স্ত্রী আরজু মনিকেও হত্যা করা হয়েছিল। শেখ মনি দম্পতি রেখে গেছেন দুই পুত্র সন্তান শেখ ফজলে শামস পরশ এবং শেখ ফজলে নূর তাপস। রক্তে তাদের রাজনীতি। তাপস ব্যারিস্টার। রাজনীতিতে সক্রিয় কয়েক বছর ধরেই। সংসদ সদস্য হয়েছেন একাধিকবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে। পরশ ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন অধ্যাপনাকে। বাবার মতো তাদের চাচা শেখ ফজলুল করিম সেলিমও আছেন রাজনীতিতেই। আওয়ামী লীগের ডাকসাইটে নেতা। মন্ত্রী ছিলেন। সংসদ সদস্য আছেন অনেক বছর ধরে। পরশের নামের আগে আছে ‘শেখ’। রাজনীতিতে এখন শেখ পরিবারের প্রভাবের কথা অস্বীকার করা যাবে না। পারিবারিক বা উত্তরাধিকার সূত্রে রাজনীতিতে নামা এখন উপমহাদেশে একটি বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা এটা অপছন্দ করেন, তারাও এটা মেনে নয়, মেনে নিতে বাধ্য হন।
রাজনীতিতে নামার সব ধরনের সুযোগ সামনে থাকার পরও শেখ পরশ এতো বছর কেন নিজেকে রাজনীতির ডামাডোল থেকে দূরে রাখলেন, সে প্রশ্ন করাই যেতে পারে। রাজনৈতিক দলে নাম লিখিয়ে বিত্ত-বৈভব, প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ানোর উৎকট প্রতিযোগিতা যখন অবাধে চলছে, তখন রাজনীতির প্রতি পরশের নির্লিপ্ততা নিঃসন্দেহে তার নির্লোভ মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। তবে এখন যে প্রশ্নটি অনেকের মনেই ঘুরছে, সেটা হলো, তিনি কেন এই ‘অসময়ে' রাজনীতিতে নামলেন?  অসময়ে এই কারণে যে, এখন রাজনীতিতে জ্ঞানী ও মানী লোকদের খুব একটা আসতে দেখা যায় না। রাজনীতিতে নেমেই যুবলীগের মতো একটি বিতর্কিত, আলোচিত এবং বড় সংগঠনের ‘বোঝা’ কাঁধে তুলে নিলেন, কোন বিবেচনা থেকে? তিনি কি পারবেন এই সংগঠনের শরীর থেকে সব কালিমা মুছে দিতে? ক্যাসিনোকাণ্ড, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে যুবলীগ এখন অনেকের কাছেই একটি মহাআতঙ্ক হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। এই সংগঠনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে তা সফলতা ও দক্ষতার সঙ্গে পালন করা চাট্টিখানি কথা নয়? পরশ পরিচ্ছন্ন ইমেজের একজন শিক্ষাবিদ। কোনও সংগঠনের ছাতা ব্যবহার করার অভিজ্ঞতা তার নেই। তিনি কোনও অরাজনৈতিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলেও শোনা যায় না। সংগঠন পরিচালনায় এমন ‘অনভিজ্ঞ’ পরশের স্পর্শে যুবলীগ কি ‘শুদ্ধ’ হতে পারবে? যুবলীগের যে অপবাদ, বদনাম, তা কি তিনি ঘোচাতে সক্ষম হবেন?

নিজের আগ্রহে পরশ যুবলীগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েছেন বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগ্রহেই পরশ রাজনীতিতে জড়ালেন। এখন তাকে প্রমাণ করতে হবে, তিনি যোগ্য। আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়ে পরশ যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা অনেককেই হয়তো উজ্জীবিত করবে। তবে শুধু ভালো কথায় মানুষ আর এখন আস্থা-বিশ্বাস রাখে না। পরশ বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ত্যাগ এবং তার কন্যার দেশের প্রতি হৃদয়ের ভালোবাসা থেকে আমি সাহস পাই। তাই আজ আমি আপনাদের সামনে বলতে চাই, আমার ওপর যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে, আমি সম্পূর্ণ সততার সঙ্গে সে দায়িত্ব পালন করবো।’

বর্তমান তরুণ-যুবকরা যে রাজনীতিকে ঘৃণা করে, রাজনীতি থেকে নিজেদের দূরে রাখতে চায়, পরশ সেটা জানেন এবং সেজন্যই বলেছেন, “যুব সমাজ যেন ‘আই হেট পলিটিকস' নীতি থেকে বেরিয়ে এসে ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু' বলে কাজ করতে প্রেরণা পায়–সেই লক্ষ্যে তিনি কাজ করবেন।”

শেখ পরশ একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ নিয়েই রাজনীতিতে নেমেছেন। তার একার পক্ষে সব আবর্জনা পরিষ্কার করা সহজ ও সম্ভব হবে না। লাগবে একটি সৎ ও আন্তরিক টিম। আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনগুলোর সম্মেলন হয়, কিন্তু নেতৃত্ব নির্বাচন হয় না। অথচ সম্মেলনের মাধ্যমে কাউন্সিলরদের মতামতের ভিত্তিতে, প্রয়োজনে গোপন ব্যালটে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করাই রীতি। কিন্তু আওয়ামী লীগের মতো গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের ঐতিহ্যবাহী একটি দলও এখন আর নেতৃত্ব নির্বাচনের এই গণতান্ত্রিক রীতি অনুসরণ করে না। দলের মধ্যে যখন শুদ্ধি অভিযান চালানোর কথা বলা হচ্ছে, তখনও সম্মেলনে কোনও সংগঠনেরই পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হচ্ছে না। সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করা হচ্ছে। সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকও কাউন্সিলরদের সর্বসম্মত মতামতে হচ্ছেন না, এমনকি ঐকমত্যের ভিত্তিতেও হচ্ছেন না। সংগঠনের শীর্ষ দুই ব্যক্তির নাম ঠিক করে দিচ্ছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। কোনও সংগঠন গতিশীল হতে পারে না পূর্ণাঙ্গ কমিটি ছাড়া। সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক পদে এবার বিতর্কিতদের বাদ দেওয়ার একটি চেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে। কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক পদে নতুন মুখ দেওয়া হয়েছে। একই ধারাবাহিকতায় যুবলীগেও নতুন সভাপতি (চেয়ারম্যান) এবং সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করা হয়েছে। সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছেন মাইনুল হোসেন খান নিখিল।

প্রশ্ন হলো, এই দুইজনই কি সংগঠনে প্রাণ প্রবাহ সৃষ্টি করবেন? তাদের সহযোগী কারা? তাদের নাম যতক্ষণ ঘোষণা করা না হবে, ততক্ষণ কি কমিটি সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করা সমীচীন? সভাপতি/সাধারণ সম্পাদক ক্লিন ইমেজের হলেন আর তাদের সহযোগীরা যদি অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকেন, তারা যদি বিতর্কিত হন, তাহলে কি সবকিছু ঠিকমতো চলবে? ইঞ্জিন বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে বগিও বদলাতে হবে। না হলে যাত্রা নির্বিঘ্ন হবে না। আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলোতে নতুন রক্ত সঞ্চালন হচ্ছে কিনা, সেটা বলা যাবে পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেখেই। তবে মাথায় যাদের বসানো হচ্ছে, তাদের দেখে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে বলা যায়, শুরুটা আশাহত হওয়ার মতো নয়। পুরো কমিটি গঠনে বেশি দেরি করা ঠিক হবে না।

যুবলীগের সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা শুদ্ধি অভিযান অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, ‘কী পেলাম, কী পেলাম না, সে চিন্তা নয়, মানুষকে কতটুকু দিতে পারলাম, কতটুকু মানুষের জন্য করতে পারলাম, সেটা হবে রাজনীতিবিদের চিন্তা-ভাবনা। একজন রাজনীতিবিদ যে হবে, তার জীবনে ত্যাগ ও মানুষের কল্যাণের আদর্শ থাকতে হবে।’ শেখ হাসিনার অনুসারীরা তার কথা যদি মেনে চলেন, শুধু পাওয়ার জন্য রাজনীতিতে না এসে কিছু দেওয়ার মনোভাবও যদি তৈরি হয়, তাহলেই আসলে রাজনীতিতে যে অপসংস্কৃতির চর্চা হচ্ছে, তা দূর হওয়ার পথ সুগম হবে।

যুবলীগের নেতাকর্মীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘লোভ লালসার ঊর্ধ্বে থেকে একজন রাজনীতিক কীভাবে আদর্শ নিয়ে চলতে পারেন, তা জানার জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা'এবং তার বিরুদ্ধে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা যেসব প্রতিবেদন তৈরি করেছিল, তা নিয়ে প্রকাশিত বইগুলো পড়তে হবে।’

শেখ পরশ যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র পড়ান, সেহেতু তার পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর বইপড়ার পরামর্শ যুবলীগের মধ্যে কার্যকর করা সহজ হওয়ার কথা। যুবলীগকে বদলাতে হলে শেখ পরশকে নতুন পথেই এগোতে হবে, সংগঠনের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে আগুনের পরশ মণি। ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালানোর হিম্মত দেখাতে পারলেই না মানুষ বলবে, ‘বাপকা বেটা’।

শেখ পরশের জন্য শুভ কামনা।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পাগলা মসজিদের দানবাক্সে এবার মিললো ২৭ বস্তা টাকা
পাগলা মসজিদের দানবাক্সে এবার মিললো ২৭ বস্তা টাকা
বিকল্প অর্থনীতি ও গ্রাম্য কায়কারবার
উপন্যাসবিকল্প অর্থনীতি ও গ্রাম্য কায়কারবার
ইরান-সমর্থিত ইরাকি সেনা ঘাঁটিতে বিস্ফোরণ, নিহত ১
ইরান-সমর্থিত ইরাকি সেনা ঘাঁটিতে বিস্ফোরণ, নিহত ১
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অ্যাসেম্বলি বন্ধ
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অ্যাসেম্বলি বন্ধ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ