X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

পেঁয়াজ সংকট আর ব্যর্থ বাণিজ্যমন্ত্রীর ‘তৃতীয় হাত’

ডা. জাহেদ উর রহমান
৩০ নভেম্বর ২০১৯, ১৩:১৭আপডেট : ৩০ নভেম্বর ২০১৯, ১৩:১৯

ডা. জাহেদ উর রহমান ‘মানুষ প্লেনে চড়তে পারে না, আমি পেঁয়াজ নিয়ে এসেছি’—একেবারে উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের কথা বাদই দেই, আমাদের আশপাশের অনেক দেশেও একটা ভয়ঙ্কর পেঁয়াজ সংকটের মধ্যে একজন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির এমন মন্তব্য অকল্পনীয়। কিন্তু আমাদের সেটা শুনতে হয়েছে। তিনি প্লেনে করে পেঁয়াজ নিয়ে আসার গর্ব এমনভাবে করছেন, যেন তিনি ব্যক্তিগত খরচে এটা করেছেন।
পেঁয়াজ কাণ্ডে এখন পর্যন্ত মানুষের পকেট থেকে ঠিক কত টাকা বেরিয়ে গেছে? কনসাস কনজুমার্স সোসাইটি (সিসিএস) নামের একটি সংগঠন গত ২ নভেম্বর হিসাব করে দেখিয়েছে, এর আগের চার মাসে পেঁয়াজ নিয়ে কারসাজি করে, কম মূল্যে আমদানি করা পেঁয়াজ অনেক বেশি মূল্যে বিক্রি করে জনগণের পকেট থেকে ৩ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। এই হিসাব করা হয়েছিল যখন, তখন পেঁয়াজের মূল্য  ১৫০ টাকার আশেপাশে। আর এখন পেঁয়াজ ২৫০ টাকা। বেশ কয়েকদিন আগেই খবর এসেছিল, মিয়ানমার থেকে আমদানি করা ৪২ টাকার পেঁয়াজ বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৩০ টাকায়। এরপর এই খবরও আমরা পেলাম কয়েকদিন আগে শ্যামবাজার আড়ত  থেকে ১৩৭ টাকা কেজি দরে কেনা পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ২২০ টাকায়, অর্থাৎ প্রতি কেজিতে লাভ ৮৩ টাকা। এইসব বিবেচনায় নিলে ২ নভেম্বর লুটপাটের যে অঙ্কটা দেখা গিয়েছিল, সেই অঙ্কটা এখন কত হয়েছে সেটা সহজেই অনুমেয়।

বিমানে করে পেঁয়াজ নিয়ে আসার পর বাণিজ্যমন্ত্রী আমাদের জানান বিমানে করে আনা প্রতি কেজি পেঁয়াজের মূল্য ২০০ টাকার মতো পড়ে, সেই পেঁয়াজ ভর্তুকি দিয়ে ৪৫ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। এই টাকাটাও জনগণের টাকা, তার ব্যক্তিগত নয়। শুধু এক পেঁয়াজের সংকট থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা গচ্চা দেওয়া জনগণের সামনে একজন মন্ত্রী বিমানে করে পেঁয়াজ নিয়ে আসার এবং সেই ক্ষেত্রে জনগণের টাকা ভর্তুকি দেওয়ার কথা বলেন দম্ভ নিয়ে।

পেঁয়াজ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রীর বচনামৃত থেমে নেই। বাংলা ট্রিবিউনে ‘পেঁয়াজ সংকটের জন্য ভারত দায়ী’ শিরোনামের রিপোর্টে দেখা যায় পেঁয়াজ সংকটের জন্য তিনি ভারতকে দায়ী করে বলছেন, ‘আমাদের দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয় ২২ থেকে ২৩ লাখ টন। এরমধ্যে পচে যাওয়ায় পেঁয়াজ থাকে ১৭ থেকে ১৮ লাখ টন। ফলে আমাদের ৭/৮ লাখ টন ঘাটতি থাকে। এই ঘাটতির ৯০ ভাগ পেঁয়াজ ভারত থেকে আমদানি করা হতো। কিন্তু এবার ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত হঠাৎ পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেয়। ফলে আমরা বিপদে পড়ে যাই। এ কারণে পেঁয়াজের হঠাৎ সংকট দেখা দেয়। তারা যদি আমাদের আগে জানাতো তাহলে আমরা এ সমস্যায় পড়তাম না। যেহেতু শুধু ভারত থেকেই আমরা পেঁয়াজ আমদানি করতাম, সে কারণে বিকল্প চিন্তা করিনি। কিন্তু তারা যে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেবে, তা আমরা কখনও কল্পনাও করিনি।’

ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেবে সেটা এই দেশে অতি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রী কল্পনাও করেননি। অথচ, একজন খুব সাধারণ, সচেতন মানুষও ইন্টারনেটে কিছুক্ষণ সময় দিয়ে যে তথ্যগুলো পাবেন, তাতে খুব স্পষ্টভাবেই বুঝবেন ভারতে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করা মোটেও কোনও আকস্মিক সিদ্ধান্ত ছিল না।

ভারতের রফতানি বন্ধ হয়ে যেতে পারে পুরোপুরি সেটা বোঝা যাচ্ছিল কয়েক মাস আগে থেকেই। ভারতের সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদনকারী রাজ্য মহারাষ্ট্র বন্যা ও অতিবৃষ্টিতে আক্রান্ত হয়েছিল। এতে পেঁয়াজের উৎপাদন ৩০ শতাংশ কমে যেতে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। এরপর পেঁয়াজের মূল্য ভারতেই যখন বাড়তে শুরু করে, তখন মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানায় বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে পেঁয়াজের মূল্য নিয়ন্ত্রণের সব রকম পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হয়।

উল্লেখ্য, নির্বাচনে পেঁয়াজের মূল্য খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ এসব এলাকার অতি দরিদ্র মানুষ শুধু পেঁয়াজ দিয়ে রুটি খায়। তাই প্রয়োজনে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিয়ে পেঁয়াজের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা হবে–এমন এমন আলোচনা ভারতের পত্রপত্রিকায় ছিল।

আগস্টের মাঝামাঝি ভারতের পত্রিকায় খবর হয়েছিল পেঁয়াজের মূল্য গত এক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, আর সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পেঁয়াজের মূল্য চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে গেছে– এমন খবর প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর ১৩ সেপ্টেম্বর প্রতি টন পেঁয়াজের রফতানি মূল্য ৮৫০ ডলারে বেঁধে দেয় ভারত সরকার। এর কিছুদিন পর, ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত পেঁয়াজ রফতানি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। এই ঘটনাগুলো একের পর এক সাজালে যে কেউ খুব সহজেই বুঝতে পারবেন, ভারত পেঁয়াজের রফতানি হঠাৎ বন্ধ করেনি।

এর সঙ্গে যোগ করা যাক আমাদের সংকটের কথা। এই প্রসঙ্গে বিবিসি বাংলাকে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক যা বলেছেন, তা হুবহু উদ্ধৃত করছি, ‘গত বছর আমাদের আগেই বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। মাঠে অনেক পেঁয়াজ ছিল। পেঁয়াজ সহজেই পচনশীল একটি ফসল। অনেক পেঁয়াজের ক্ষতি হয়েছে। যার জন্য আমাদের ঘাটতি ছিল। আমাদের একটি দুর্বল দিক হলো আমাদের আগেই অ্যাসেস করা উচিত ছিল যে, আমাদের পেঁয়াজের ঘাটতি হবে এবার।’

চাইলেই যে পেঁয়াজের এই সংকট এড়ানো যেতো, শ্রীলঙ্কা এর চমৎকার উদাহরণ। দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায় ভারত রফতানি বন্ধের পর সেখানে আমদানি করা পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৭৮ থেকে বেড়ে ১৪১ টাকা পর্যন্ত ওঠে। সংকট মোকাবিলায় শ্রীলঙ্কা দ্রুত পাকিস্তান, মিসর ও চীন থেকে আমদানি বাড়িয়েছিল, যে কারণে দ্রুত মূল্য কমে কেজিপ্রতি ৫৮ টাকায় নেমেছে। এই সংবাদ অন্তত দুই সপ্তাহ আগের।

সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যায়– হয়তো সরকারের একটি অংশ এই পেঁয়াজ সংকটের সঙ্গে জড়িত হয়ে লুটপাটের অংশ হয়েছে, অথবা এটি সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভয়ঙ্কর একটা অদক্ষতার স্বাক্ষর।

পারিপার্শ্বিক সব ঘটনা বিবেচনা করে আমি মনে করি, জেনেশুনে এই সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে মানুষের পকেট কাটার জন্য। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম এটি একটা ব্যবস্থাপনাগত সমস্যা। তাহলেও অর্পিত দায়িত্ব পালনে এমন ভয়ঙ্কর ব্যর্থতার জন্য কোনও মন্ত্রী পদত্যাগ  করবেন, এটাই প্রত্যাশিত, যদিও বর্তমান বাংলাদেশের এই প্রত্যাশা কেউ করে না। কিন্তু সীমাহীন ব্যর্থতা দায়িত্বপ্রাপ্ত মানুষটিকে কিছুটা হলেও লজ্জা দেবে, কিছুটা হলেও অনুতপ্ত করবে, সেই প্রত্যাশাও করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বরং বর্তমান বাংলাদেশে আমাদের এখন প্রস্তুত হতে হবে ব্যর্থ মন্ত্রীদের দম্ভোক্তি শোনার জন্য।

ব্যর্থতার জন্য অভিযুক্ত না করার চর্চাটা আমাদের জাতিরই একটা রোগ। ব্যক্তিগত পর্যায়ে, পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও ‘ডিনায়াল সিনড্রোম’ খুব স্বাভাবিক ব্যাপার এই দেশে। এই কারণেই আমরা মজা করি, আমাদের একটা তৃতীয় হাত আছে, সেটি ‘অজুহাত’। যেকোনও সমস্যায় পড়লে আমরা সেটাকেই দেখানোর চেষ্টা করি। সমস্যাকে স্বীকার করি না বলেই, সমস্যার জন্য দায়ী হয়ে লজ্জা পাই না বলেই, অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে না পারলে অনুতপ্ত হই না বলেই এই দেশে বড় সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয় না। কোনও রকমে একটি সমস্যা শেষ হওয়া মানে আরেকটা বড় সমস্যার অপেক্ষা, যেটা আমাদের দেখা দেয় খুব দ্রুতই।

পুনশ্চ: এই প্রসঙ্গে কৃষি মন্ত্রীকে আমাদের একটা ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। কারণ তিনি অন্তত ‘ডিনায়াল সিনড্রোমে’ না ভুগে এই ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতার কথা কিছুটা স্বীকার করেছেন।

লেখক: শিক্ষক, অ্যাকটিভিস্ট

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ