X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

আইএস টুপি

এম আবুল কালাম আজাদ
০৭ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৮:০৫আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৫:০২

এম আবুল কালাম আজাদ জঙ্গি রাকিবুলের মাথায় আইএসের টুপি কীভাবে এলো, তা নিয়ে কয়েকদিন ধরে আলোচনা চলছিল। কারাগার থেকে আদালত পর্যন্ত জায়গায় এত পুলিশ পাহারার মধ্যে সে কীভাবে টুপি বহন করলো এবং দীর্ঘ সময় ধরে কীভাবে তা মাথায় পরে থাকলো, তা নিয়ে অনেক লেখালেখি ও তর্ক-বিতর্ক হচ্ছিল। তবে, সর্বশেষ মঙ্গলবার  আদালতে রাকিবুল যে বক্তব্য দিয়েছে, তা থেকে একটি উত্তর পাওয়া গেছে। সে আদালতে বলেছে,  ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন তাকে টুপিটা দিয়েছে। যদিও কে দিয়েছে, তা রাকিবুল আদালতকে বলেনি।
আপাত দৃষ্টিতে বিষয়টির একটা সুরাহা হলো বলে মনে হতে পারে। তবে, বিষয়টাকে এত সহজভাবে দেখলে চলবে না। দেশের সবচেয়ে বড় জঙ্গি হামলার ঘটনায় ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত আসামি কীভাবে টুপি বহন করলো এবং এতটা সময় আদালতের ভেতরে কীভাবে পরে থাকতে পারলো, তা অনেক গুরুতর একটি বিষয়। এ কারণে কয়েকটি বিষয় পর্যালোচনা করা জরুরি বলে মনে করি।
এক. রাকিবুলের মতো একজন জঙ্গি সত্যি কথা বলবে না, এটাই স্বাভাবিক। বরং সে মিথ্যা কথা বলে সবাইকে, বিশেষ করে পুলিশ ও কারা কর্তৃপক্ষকে বিভ্রান্ত করতে চাইবে। টুপিটা সে কোথায় পেয়েছে, বা কে তাকে দিয়েছে বা কীভাবে আদালতে বহন করে এনেছে অথবা কারাগারে তাকে কেউ দিয়েছে কিনা, সে বিষয়ে সে সহজে সত্যিটা বলতে চাইবে না। কারণ তথ্য গোপন করা ও আলামত ধ্বংসের ব্যাপারে জঙ্গিরা প্রশিক্ষিত।

দুই.  সে আদালতে সত্যি বলেছে বলে যদি আমরা ধরে নেই, তাহলে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে, কীভাবে তা সম্ভব হলো? রাকিবুল আদালত প্রাঙ্গণে সবসময় পুলিশের নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যে ছিল। আদালতে ভিড় থাকলেও তার চারপাশে পুলিশ ছাড়া আর কেউ থাকার সুযোগ ছিল না। এছাড়া, কেউ দিলেও কখন, কীভাবে টুপিটা পরতে হবে, তা সে কীভাবে বুঝতে পারলো? রায়ের পর  টুপিটা পরে ভি-চিহ্ন  দেখাতে হবে, সেটাও কি তাহলে ‘কেউ’ তাকে বলে দিয়েছিল?

তিন. হাজতখানা থেকে যখন তাকে বের করা হয়, ওই সময় টুপিটা উল্টো করে পরা ছিল, যেন কেউ বুঝতে না পারে সেটার ভেতরের অংশে আইএস লেখা ছিল। তাহলে কি হাজতখানায় কেউ তাকে টুপিটা দিয়েছে? সেই আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

চার. হতে পারে সে টুপিটা কারাগার থেকেই বহন করেছে। টুপি বহন করা, আদালতে রায় ঘোষণার পর সেটা মাথায় পরে দেশে যে জঙ্গি সংগঠন আইএস তৎপর সেটা দেশবাসীকে জানানোর জন্যে পুরো বিষয়টি একটা পূর্বপরিকল্পনা হতে পারে। কারণ তারা জানে যে, সেখানে অনেক গণমাধ্যম থাকবে এবং টুপিটা নিয়ে অনেক প্রচারণা ও আলোচনা হবে। জঙ্গি সংগঠনগুলো এসব কৌশলের মাধ্যমেই নিজেদের কার্যক্রম প্রচার করে, যুবকদের প্ররোচিত করে আর দলের নেতাকর্মীদের উৎসাহিত করে।

পাঁচ. কে তাকে টুপি দিয়েছে বা কোথায় থেকে সে টুপিটা পেল, আইএস-এর টুপি আছে কিনা—সেটা গুরুত্বপূর্ণ না। বরং পুলিশ টুপি জব্দ না করে অনুমোদন করেছে, কেন সেটা সবচেয়ে বড় ব্যাপার। নাকি টুপির ব্যাপারটা পুলিশের নজরেই আসেনি? নাকি তারা বুঝতেই পারেনি বিষয়টি এত গুরুতর? অতীতের অনেক ঘটনার মতোই পুলিশ হয়তো খেয়াল করেনি! আর এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয়।

২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের জুলাই পর্যন্ত একের পর এক জঙ্গি হামলার ঘটনার পর সরকার জঙ্গি দমনে বাহিনীগুলোকে প্রস্তুত করেছে, অফিসাররা দেশে-বিদেশে কীভাবে জঙ্গি দমন করতে হবে, সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। জঙ্গিবাদের ব্যাপারে তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন এখন। এমনকি জঙ্গি দমনে গত কয়েক বছর বাহিনীগুলোর মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা চলছে। তাই টুপির বিষয়টি পুলিশের বুঝতে না পারা, অথবা খেয়াল না করা মানতে পারা কঠিন। আমাদের পুরো বাহিনী জঙ্গি তৎপরতার বিষয়ে সচেতন হয়েছে এবং তারা দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে, এটাই সবাই আশা করে। এতকিছু করার পরেও, অনেক ধরনের কার্যক্রম নেওয়ার পরেও কি তা পুরো বাহিনীর সব পর্যায়ে, সব সদস্যের কাছে এর গুরুত্ব পৌঁছায়নি? গুলশান হামলার ফাঁসির আসামির আইএস-এর টুপি পরে আদালতে ঘুরে বেড়ানোর বিষয়টি আমাদের কী  বার্তা দিচ্ছে?

পুরো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সব পর্যায়ের সব সদস্যের কাছে এর জঙ্গি দমনের গুরুত্ব না পৌঁছালে বিষয়টা আমাদের জন্য এক অশনিসংকেত। তার চেয়েও যে বিষয়টি বেশি উদ্বেগের, তা হলো কর্তৃপক্ষ টুপির বিষয়টি কীভাবে নিয়েছে? এটিকে হাল্কাভাবে দেখা এবং তদন্তের আগে একধরনের দায়িত্ব এড়ানোর যে প্রবণতা, তার পরিণতি ভালো হবে না। এর মধ্যেই আমরা দেখছি পুলিশ আর কারা কর্তৃপক্ষ টুপি নিয়েছে, সে ধরনের মনোভাব প্রকাশ করছে। আইএস-এর কোনও ক্যাপ নেই বা সে ক্যাপটি জেল থেকে সে পেয়েছে বলে যে ধরনের মন্তব্য পুলিশের দিক থেকে করা হচ্ছে, তা ঘটনাটিকে খাটো করে দেখার প্রয়াস মাত্র। এ ধরনের মনোভাবের জন্যে অতীতে আমাদের অনেক মূল্য দিতে হয়েছে।

এত কড়া পুলিশি পাহারার মাঝেও রকিবুল কীভাবে আইএসের  টুপি বহন করলো এবং আদালতের ভেতরে তাকে টুপি পরে থাকতে দেখেও পুলিশ কেন কোনও ব্যবস্থা নেয়নি,  এই বিষয়ে পুলিশের তথা কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের উচিত হবে, এটি  গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা ও পুরো ব্যাপারটি বের নিয়ে আসা। কারণ এটি সাধারণ কোনও ঘটনা নয়। এর মাধ্যমে যে বিষয়টি আমাদের কাছে পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মাণ হয়, তা হলো জঙ্গিরা ভেতরে ভেতরে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তারা গোপনে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে এবং যেকোনও সময় ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে পারে। টুপির মাধ্যমে তারা হয়তো নিরাপত্তার বিষয়টি যাচাই করে দেখেছে মাত্র। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে পুলিশের উচিত হবে টুপিটি কোথায়, কে তৈরি করেছে তার উৎস খুঁজে বের করা। আমি বিশ্বাস করি, জঙ্গি রাকিবুলের ক্যাপটি একমাত্র টুপি নয়। এমন আরও টুপি হয়তো বানানো হয়েছে আর তা প্রমাণ হয়তো আমরা নিকট অতীতে দেখতে পাবো।

বিষয়টি নিয়ে পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের মিটিং হয়তো হয়নি, নাহলে তা করা উচিত ছিল। কারণ পুরো বিষয়টার দায়ভার পুলিশের ওপরই চলে আসে। পুলিশের যে সব সদস্য সেদিন আদালতে ছিল তাদের যে এ বিষয়ে গাফিলতি বা অজ্ঞতা আছে তা নিয়ে কোনও রাখঢাকের সুযোগ নেই। তারা এরকম একটি গুরুতর বিষয় খেয়াল না করার বিষয়টি খাটো করে দেখলে চলবে না। বরং এটাকে গুরুত্বভাবে নিতে হবে। পুলিশ সদস্যদের এবিষয়ে আরও বেশি প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাদের জঙ্গিবাদ ও তা মোকাবিলার ব্যাপারে আরও সচেতন করে তুলতে হবে, যেন ভবিষ্যতে এ ধরনের কিছু ঘটলে, তারা এমন ভুল আর না করে, বরং দ্রুত ব্যবস্থা নেতার মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অনেক সংখ্যক পুলিশ নিয়োগ করলেই যে নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে এমন ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

আদালতের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যাপারেও সরকারকে ভাবতে হবে। অতীতে বেশ কিছু অনাকাক্ষিত ঘটনা ঘটেছে আদালতে।সন্ত্রাসী ও জঙ্গিরা কার সঙ্গে কীভাবে দেখা করে এবং কথা বলে সে বিষয়টি নজরে রাখতে হবে। বিশেষ করে জঙ্গিরা আদালত প্রাঙ্গণে কী করে তা কড়া নজরদারিতে আনতে হবে।

কারাগারে টাকার বিনিময়ে অনেক কিছুই সম্ভব হয়। তাই কারা কর্তৃপক্ষও দায়িত্ব এড়াতে পারে না। এরই মধ্যে ভিডিও ফুটেজ দেখে পুলিশ দাবি করেছে যে টুপিটা রাকিবুল জেল থেকে এনেছে। পুলিশের এই দাবি অমূলক নাও হতে পারে। কারণ কারা জঙ্গিদের সঙ্গে জেলখানায় দেখা করে তা অনেক সময় মনিটর করা হয় না। এ বিষয়েও সরকারকে নজর দিতে হবে। আর এসব কিছু করতে পারলে ভবিষ্যতে আইএস এর টুপির মতো ঘটনা রোধ করা যাবে—যা জঙ্গি দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি।

লেখক: সাংবাদিক ও জঙ্গিবাদ বিষয়ক বিশ্লেষক

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঢাবির সুইমিংপুলে শিক্ষার্থী মৃত্যু: বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটি
ঢাবির সুইমিংপুলে শিক্ষার্থী মৃত্যু: বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটি
‘লম্বা’ নায়িকা প্রসঙ্গে কৃতির ব্যাখ্যা
‘লম্বা’ নায়িকা প্রসঙ্গে কৃতির ব্যাখ্যা
ভান মুন নোয়াম বমকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার
ভান মুন নোয়াম বমকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার
কারিগরির সনদ জালিয়াতি: সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান ডিবি কার্যালয়ে
কারিগরির সনদ জালিয়াতি: সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান ডিবি কার্যালয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ