X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতির ভাষণ ও ইউজিসির পরামর্শ

মো. সামসুল ইসলাম
১৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৭:৪৮আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৭:৫০

মো. সামসুল ইসলাম সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকোর্স নিয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতির খোলাখুলি আপত্তির মাত্র তিনদিনের মাথায় ইউজিসি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ১৩ দফা পরামর্শ পাঠিয়েছে, যার অন্যতম হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকোর্স বন্ধের নির্দেশ। রাষ্ট্রপতি মোটামুটি স্পষ্টভাষায় জানিয়েছেন, ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে সন্ধ্যাবেলায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেসরকারি রূপ পরিগ্রহণ কারও কাম্য নয়।
রাষ্ট্রপতির সমাবর্তন বক্তৃতায় বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবিরই প্রতিফলন ঘটেছে। কিছুদিন আগে পত্রিকান্তরে ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বাঁচাতে হবে’ শীর্ষক এক কলামে আমি এ ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়ে লিখেছিলাম, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিয়মিত কোর্সে পাঠদান করবেন, সান্ধ্যকোর্স চালু রাখবেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবেন, আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে সাত অধিভুক্ত কলেজ দেখাশোনা করবেন, সেটা তো অসম্ভব এক ব্যাপার।
সান্ধ্যকোর্সের ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের উদাহরণ দিয়ে বলেছিলাম যে নিয়মিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রির পাশাপাশি গভর্নেন্স স্টাডিজের ওপর একটি অতিরিক্ত প্রফেশনাল মাস্টার্স ডিগ্রি প্রদান নিয়মিত ছাত্রদের ক্ষুব্ধ করতে পারে। কারণ, এ ডিগ্রি একাধারে আকর্ষণীয় আবার খুব কম যোগ্যতার অধিকারীরা এখানে ভর্তি হতে পারেন।

তবে সান্ধ্যকালীন কোর্স চালুর ব্যাপারে শুধু যে শিক্ষকদের অর্থলিপ্সাই দায়ী তা হয়তো আংশিকভাবে সত্য। এসব কোর্সের ব্যাপারে বাজারের চাহিদার ব্যাপারটিও আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। গ্লোবাল এডুকেশন সম্পর্কিত জাতিসংঘের বর্তমান বিশেষ দূত, প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন এবং এমআইটি প্রফেসর অনন্ত আগরওয়ালের  যৌথভাবে লিখিত এক সাম্প্রতিক নিবন্ধে পড়লাম, বৈশ্বিকভাবে উচ্চশিক্ষা একজন ব্যক্তির আয়কে গড়ে ১৬ ভাগ বাড়িয়ে দিতে পারে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা ব্যক্তির আয়কে বাড়াতে পারে ২৭ ভাগ পর্যন্ত। তারা আরও বলছেন, ভবিষ্যতে দেশগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী education-rich এলিট ও  education-poor জনগণের মধ্যে বৈষম্য বাড়বে। 

এই বৈষম্য কমাতে এবং তীব্র প্রতিযোগিতার চাকরির বাজারে মিডক্যারিয়ার পেশাজীবীদের মাঝে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেশনাল কোর্সের প্রতি ব্যাপক আগ্রহ আমরা দেখছি। অনেকেই এই সময় আবার নতুন বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে নিজেদের যোগ্যতা বৃদ্ধি বা ঝালাই করে নিতে চান। সেই সঙ্গে শীর্ষস্থানীয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেটের লোভ তো আছেই। কিন্তু এটি শিক্ষাঙ্গনের রাজনীতির মতোই শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক মাত্রায় বৈষম্য, অরাজকতা সৃষ্টি করছে। নিয়মিত শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষকদের মনোযোগের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে, যার ফলে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হচ্ছেন সংক্ষুব্ধ, বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার পরিবেশ হচ্ছে বাধাগ্রস্ত, সর্বোপরি বিশ্ব-র‍্যাংকিংয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান দেশের জনগণ ও সরকারকে করছে লজ্জিত। 

নিয়মিত ছাত্রদের চার বছরের অনার্স ডিগ্রির পর আবার মাস্টার্স ডিগ্রি সবার জন্য অপ্রয়োজনীয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কোনও বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি সংশ্লিষ্ট সব বিভাগের মেধাবীদের জন্যই শুধু উন্মুক্ত থাকা উচিত।  শিক্ষার নামে যাকে-তাকে ডেকে নিয়ে সার্টিফিকেট গছিয়ে দেওয়া কারও কাম্য হতে পারে না। 

অনেকেই বলতে পারেন পৃথিবীর অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়েই সান্ধ্যকালীন কোর্স আছে। কিন্তু তাদের দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার অনেক পার্থক্য রয়েছে। শিক্ষাখাতে এমনিতেই আমাদের ব্যয়-বরাদ্দ কম। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা উপকরণের ঘাটতি রয়েছে। গবেষণার মান নিম্নগামী। বাড়তি ছাত্রের চাপ নেওয়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে সম্ভব নয়। 

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, দেশে প্রায় শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যে হারে ব্যবসা শুরু করেছে তাতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সান্ধ্য বা প্রফেশনাল কোর্সগুলো তো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনা করতে পারে। আমরা খেয়াল করেছিলাম যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সাতটি কলেজকে অধিভুক্ত করার কারণে ঢাকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের ভর্তির আগ্রহ কমে গিয়েছিল। কারণ, কলেজে পড়লেও সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট পাবেন।

একদিকে একের পর এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন, অপরদিকে কলেজ অন্তর্ভুক্তি, নিত্যনতুন বিভাগ খোলা, সান্ধ্যকোর্স ইত্যাদির মাধ্যমে  পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসর বৃদ্ধির পরস্পরবিরোধী নীতিমালার কারণে পাবলিক ও প্রাইভেট সব ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সুতরাং ইউজিসির ১৩টি পরামর্শের প্রথমটি অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন বিভাগ, প্রোগ্রাম, ইনস্টিটিউট ইত্যাদি খোলার ব্যাপারে পূর্বানুমোদন নেওয়ার পরামর্শ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে।  

বিশ্বজুড়েই এখন সনাতন brick-and-mortar শিক্ষাপদ্ধতি বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপদ্ধতির পরিবর্তে online learning বা blended learning-এর ক্ষেত্রে আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। Online learning-এ শুধু ইন্টারনেটের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রদান করা হয়, শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসার কোনও প্রয়োজন হয় না। অপরদিকে blended learning হচ্ছে online আর সনাতন brick-and-mortar শিক্ষাপদ্ধতির সমন্বয়। শিক্ষার্থীরা এক্ষেত্রে মাঝেমধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হাজিরা দেন। বিশ্বের অনেক খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় এ ধরনের শিক্ষাপদ্ধতি চালু করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক উন্নত দেশে এ শিক্ষা পদ্ধতি স্বীকৃত। ভালো, স্বীকৃত অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি অনলাইনে পিএইচডি ডিগ্রি দিচ্ছে এবং এ ডিগ্রির মান কোনও অংশেই খারাপ বলা যাবে না। চাকরিতেও এটি কোনও সমস্যা সৃষ্টি করে না।  

অথচ আমাদের দেশে অনলাইন ডিগ্রি, সে যত খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়েরই হোক না কেন, স্বীকৃত নয়। আমি যতদূর জানি, ইউজিসি এ ধরনের ডিগ্রি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে অনুমোদন করে না। ইউজিসিকে এ ব্যাপারে চিন্তাভাবনায় আধুনিক হতে হবে। এমনকি মালয়েশিয়ায় এশিয়া-ই-ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেখানকার ডিগ্রি বিশ্বের অনেক দেশেই স্বীকৃত। কেউ যদি হার্ভার্ড বা এমআইটি থেকেও ধরা যাক মাস্টার্স করলো এবং তার ডিগ্রি এ দেশে স্বীকৃত হলো না এটা মেনে নেওয়া কঠিন। ইউজিসির এ ব্যাপারে একটি দিকনির্দেশনা দেওয়া উচিত।    

এক্ষেত্রে সান্ধ্যকোর্সের পরিবর্তে অনলাইন কোর্সের ব্যাপারে ইউজিসি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুমতি দেওয়ার কথা চিন্তা করতে পারে। শিক্ষকদের রেকর্ডেড লেকচার দিয়ে হাজার হাজার মানুষকে শিক্ষাদান সম্ভব। আমাদের আশপাশের দেশগুলো তা শুরু করেছে। এটা হলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসার প্রয়োজনীয়তা থাকবে না এবং স্বল্প খরচে তারা উচ্চশিক্ষা নিতে পারবেন। কিন্তু  সবার আগে প্রয়োজন অনলাইন ডিগ্রির ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসির আগ্রহ ও স্বীকৃতি। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এটি স্বীকৃত হলে আমাদের দেশে দিতে অসুবিধা কোথায়?

আমরা চাই প্রয়োজনে মেধাবী ও দক্ষ শিক্ষকদের বেতনভাতা বৃদ্ধি করা হোক, শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয়বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হোক। সম্প্রতি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস)-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চশিক্ষায় ভালো ফল অর্জনকারীদের মধ্যে ২৮ থেকে সাড়ে ৩৪ শতাংশ বেকার। শিক্ষার সঙ্গে চাকরিকে সম্পর্কিত করার ব্যাপার নিয়ে আমরা বারবার লিখছি। আশা করি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও ইউজিসির পরামর্শ আমলে নেবেন এবং শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি পরিহার করে কারিকুলাম সংস্কারের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষাকে আরও যুগোপযোগী করে তুলবেন। সেই সঙ্গে অনলাইন ডিগ্রিসহ উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রের আধুনিক প্রবণতা সম্পর্কে তারা ইউজিসির সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে দেশে আগ্রহীদের জন্য উচ্চশিক্ষার পথ প্রশস্ত করবেন।   

লেখক: কলামিস্ট

ইমেইল: [email protected]    

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
করোনার পরে মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
করোনার পরে মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস দুর্ঘটনায় ৪৫ তীর্থযাত্রী নিহত
দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস দুর্ঘটনায় ৪৫ তীর্থযাত্রী নিহত
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ