X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

একজন বীরের প্রয়াণ

মোস্তফা হোসেইন
১১ জানুয়ারি ২০২০, ১৯:২৫আপডেট : ১১ জানুয়ারি ২০২০, ১৯:২৬

মোস্তফা হোসেইন বাংলাদেশের জন্মব্যথার অংশীদার আরেকজন বীরযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আহমেদ আলীও চলে গেলেন শুক্রবার (১০ জানুয়ারি) দিনগত রাতে। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী এই মুক্তিযোদ্ধার প্রয়াণে জাতীয়ভাবে হয়তো তেমন আলোচনা হবে না, কিন্তু ইতিহাসের বিচারে তার অনুপস্থিতি বিশাল শূন্যতা তৈরি করবে, বলতে দ্বিধা নেই। কারণ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা, দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা, ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দীর্ঘকালীন সম্পর্ক, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালীন দেশগঠনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ছিল তার অগ্রণীভূমিকা। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঐতিহাসিক রোজ গার্ডেনে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাক্ষণে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বেঁচে থাকা কয়েকজনের একজন ছিলেন তিনি।
শেষ বয়সে কিছুটা স্মৃতিভ্রম হলেও স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রসঙ্গ এলে তাকে মনে হতো গত শতকের ৫০-এর দশকের তরুণ রাজনৈতিক নেতা। গত বছর আগস্টে কুমিল্লায় তার বাসভবনে সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছিলেন। অনেকের কাছেই অজানা, এমন সব রাজনৈতিক তথ্য বেরিয়ে আসছিল তার মুখ থেকে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঘটে যাওয়া ঐতিহাসিক অনেক ঘটনার পেছনের ঘটনাগুলোর সাক্ষী ছিলেন তিনি।

গত শতকের ৪০-এর দশকে ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশ, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পর্যন্ত জাতীয় নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠজন হওয়ার পরও কুমিল্লাকে তিনি প্রাণের মতো ভালোবাসতেন। মফস্বলে থেকেই তিনি কীভাবে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজন হয়েছিলেন, তার স্মৃতিচারণে সে রকম অনেক প্রসঙ্গ এসেছে। বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু তাকে ভালোবাসতেন বলেই ঢাকা থেকে সিলেট কিংবা চট্টগ্রাম এলাকার যেকোনও প্রোগ্রামে যাওয়ার পথে তিনি কুমিল্লায় তার বাসায় অবস্থান করতেন। যে কারণে কুমিল্লা রেসকোর্সের তার বাসাটি প্রায়ই আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতো। অতি সাধারণ বাঙালি খানায় অভ্যস্ত বঙ্গবন্ধুকে কীভাবে মাছের ভর্তা, গুঁড়ো মাছ দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো, সেটুকু বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি ইতিহাসের আরও পেছনেও চলে গিয়েছিলেন। তার কাছ থেকেই জানতে পেরেছিলাম, ভারত বিভাজনের পর মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে আসার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ কী কারণে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের তালিকায় স্থান পেলেন না।

একই জেলার অধিবাসী ও আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাকালীন সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদের রাজনৈতিক চরিত্রে যে নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় ছিল, সে রকম কিছু ঘটনার কথাও জানা হয়েছিল তার সঙ্গে কথা বলার সময়। তার স্মৃতিচারণের একটি অংশ উপস্থাপনযোগ্য:

‘‘...প্রথম কমিটিতে শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের ৩ নম্বরের সহসাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। বাস্তবতা হচ্ছে—তাকে দেখা গেছে, সাধারণ সম্পাদকের মতো কর্মচঞ্চল নেতা হিসেবে। তার রাজনৈতিক নেতৃত্বের গুণই সেই সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল। তার এই দক্ষতার কারণে দুয়েকজন তাকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেও দেখতে থাকেন। এর মধ্যে খন্দকার মোশতাক আহমদের নাম করতে হয়। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। কিন্তু সেই মোশতাক আহমদ যে শেখ মুজিবকে ভালোবাসতেন, তা নয়। এটি ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে খুন করার কারণে বলছি না। বহু আগে থেকেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। শেখ মুজিবুর রহমানও যে সেটা বুঝতেন না, তা নয়। বাস্তবতা হচ্ছে—এরপরও কেন যে মোশতাককে প্রত্যাখ্যান করেননি শেখ মুজিবুর রহমান, সেটি গবেষণার বিষয়। ১৯৫২ সালের একটি উদাহরণ এখানে উল্লেখ করতে পারি।

চৌদ্দগ্রামে আওয়ামী মুসলিম লীগের জনসভা হবে। ঢাকা থেকে শেখ মুজিবুর রহমান ও কেন্দ্রীয় নেতারা অংশ নেবেন সেই জনসভায়। শেখ মুজিবুর রহমান আগের কথামতো কুমিল্লায় আমার বাসায় আতিথ্য গ্রহণ করেন। আগেই কথা ছিল চৌদ্দগ্রাম যাওয়ার পথে তিনি নিজের গাড়ি ব্যবহার করবেন। সেই গাড়িতে আমিও যাবো। গাড়িতে খন্দকার মোশতাক আহমদ ও আমেনা বেগমও  ছিলেন। সামনের সিটে ছিলেন আমেনা বেগম। পেছনের সিটে দু’জন।

এরমধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের সহসাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মীর হোসেন এসে উপস্থিত আমার বাসায়। তাই গাড়িতে জায়গা  হচ্ছিল না। শেখ মুজিবুর রহমান কৌতূকছলে বললেন, ‘মোশতাককে তো আমার কোলে বসায়েও নেওয়া যায়। কিন্তু তাকে হজম করা কঠিন ব্যাপার। কারণ বুকে থেকে কখন কাকে ঘাই মারে, তা বলা যায় না।’ দুঃখজনক হচ্ছে এই ‘ঘাই মারা’ লোকটির জন্য তিনি কতকিছুই না করলেন। নিয়তি হলো— সেই মোশতাকই চূড়ান্ত ‘ঘাই’ মেরেছিলেন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। সেটি ছিল শেখ মুজিবুর রহমানেরই বুকে।’’

খন্দকার মোশতাক আহমদের দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন অ্যাডভোকেট আহমেদ আলী। ১৯৭০-এর নির্বাচনে মোশতাকের বিজয় নিয়ে সন্দিহান ছিলেন বঙ্গবন্ধু। অথচ বঙ্গবন্ধু কেন আর কীভাবে তাকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন, তাও উল্লেখ করেছেন আহমেদ আলী।

মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশে জাতীয় রাজনীতিতে আহমেদ আলীর একটি ভূমিকাও উল্লেখ্য। যাইহোক, পরিণত বয়সেই অ্যাডভোকেট আহমেদ আলী চলে গেছেন, কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসের অনেক অজানা তথ্যভাণ্ডারকেও হারালাম আমরা। অ্যাডভোকেট আহমেদ আলীর মৃত্যুসংবাদ যখন প্রচার হচ্ছিল, ওই সময়ই জানতে পারলাম তারই সহযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা জয়নুল আবেদীনও পরপারে চলে গেছেন। পত্রিকায় সংবাদ হয়েছে বাগের হাটের এমপি ও মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হোসেন ৮০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন।

প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে এভাবেই প্রবীণ এই বীরদের প্রয়াণ হচ্ছে— দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, ইতিহাসের প্রয়োজনে তাদের যুদ্ধস্মৃতিগুলো সংরক্ষণের কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এখনও যেসব বীর বেঁচে আছেন, তাদের স্মৃতিচারণ সংরক্ষণের প্রয়োজন বোধ করছি। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কি সেদিকে নজর দেবে?

লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ