‘আমরা চাই, আজাদি’ স্লোগানটি বিতর্কিত সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ)-বিরোধী বিক্ষোভে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এই স্লোগানটির প্রথম প্রচলন হয় নব্বই দশকের শুরুতে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্লোগানটি কাশ্মিরের স্বাধীনতা-পন্থীদের উপযুক্ত স্তবকে পরিণত হয়। কিন্তু গত বছর আগস্ট থেকে পুরো কাশ্মিরে এই স্লোগান তোলার মতো পরিস্থিতি নেই সরকারি বিধিনিষেধের কারণে। সংবাদমাধ্যম হাফিংটন পোস্টের ভারতীয় সংস্করণ এক প্রতিবেদনে স্লোগানটির উৎপত্তি থেকে শুরু ভারতে ছড়িয়ে পড়ার কারণ খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছে।
কাশ্মিরের সংগ্রামের সঙ্গে ‘আজাদি’ স্লোগানটির রাজনৈতিক শেকড় ও একাত্মতা আরও বড় পরিসরের ছিল। সিএএবিরোধী বিক্ষোভে এটির ব্যবহার সেটিরই ইঙ্গিত দেয়। স্লোগানটির বলিষ্ঠতা, আবেগময় টান ও বিভিন্ন অর্থবহ হওয়ার কারণে বিক্ষোভকারীরা বৈষম্যমূলক আইনের বিরুদ্ধে তা যথার্থ হয়ে উঠে। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ স্লোগানের কথাকে আপন করে নিয়েছেন। কিন্তু স্লোগানটির অর্থ শুরুর তুলনায় অনেকটাই পাল্টে গেছে।
কাশ্মিরের স্বাধীনতা-পন্থীদের কাছ থেকে আজাদি শব্দটি কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এটির অর্থ এখন ‘স্বৈরাচার থেকে মুক্তি’, ‘বিক্ষোভের স্বাধীনতা’ এবং বৃহৎ অর্থে ‘ভারত রাষ্ট্রের ধারণা পুনরুদ্ধার করা’।
নয়া দিল্লির ২৪ বছরের কবি ও শিক্ষার্থী নাবিয়া খান বলেন, ‘আমাদের আজাদি ভিন্ন। আমরা প্রথমে ভারতীয়। আমরা যখন আজাদি নিয়ে কথা বলি তখন আমরা নাগরিকত্বের অধিকার চাই। আমরা দেশের সেক্যুলার ভাবধারার জন্য লড়াই করি।’
নিউজ চ্যানেলে যখনই সিএএ-বিরোধী বিক্ষোভকারীদের দেখানো হয়েছে তাদেরকে আজাদি স্লোগান দিতে দেখে কাশ্মিরিদের অনুভূতি ছিল ভিন্ন। এমন সময় ভারতজুড়ে এই স্লোগান দেওয়া হচ্ছে যখন কাশ্মিরিদের বিক্ষোভের কোনও অধিকার নেই, যোগাযোগ-বিচ্ছিন্ন হওয়ায় তাদের দুর্ভোগও কেউ দেখতে পারছে না। যদিও গত কয়েক সপ্তাহে লক ডাউন ও টেলিযোগাযোগ কিছুটা শিথিল হয়েছে।
কাশ্মির বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ছাত্র ওয়াসিম আহমেদ (২২) বলেন, ‘যে আজাদি স্লোগান কাশ্মিরে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে তা এখন ভারতের বিভিন্ন রাজপথে শোনা যাচ্ছে’।
গত তিন দশক ধরে কাশ্মিরের স্বাধীনতা-পন্থীদের বিক্ষোভের প্রধান স্লোগান ছিল আজাদি। জনগণের যে কোনও ক্ষোভ ও শোকেও এই স্লোগানটি উচ্চারিত হতো।
কাশ্মিরের এক সাংবাদিক নাসির আহমেদ বলেন, ‘এখানে আজাদি স্লোগানের সম্ভাব্য সবচেয়ে যৌক্তিক রাজনৈতিক অর্থ রয়েছে। সত্যিকার অর্থে শব্দগুলো আরও বড় অর্থ ধারণ করে। বৃহৎ অর্থে আজাদি মানে হলো পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা এবং ঐক্যবদ্ধ স্বাধীন কাশ্মিরের জন্য দাবি তোলা।’
স্লোগানটি যখন শুরু হয়েছিল তখন এটাকে সেক্যুলার চরিত্রের দাবি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। জম্মু অ্যান্ড কাশ্মির লিবারেশন ফ্রন্ট (জেকেএলএফ) স্লোগানটি ব্যবহারে জোর দেয়। বার্মিংহামে মকবুল বাট ও আমানুল্লাহ খান ১৯৭৬ সালে এই সংগঠন গড়ে তুলেন। এটিই কাশ্মিরের প্রথম সংগঠন যা ১৯৮৯ সালের দিকে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে। শুরুর দিকে তাদেরকে সহযোগিতা করত পাকিস্তান অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়েছে। তবে তাদের লক্ষ্য ছিল ভারত ও পাকিস্তানের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন কাশ্মির প্রতিষ্ঠা করা।
সংগঠনটির সাবেক নেতা জাভেদ মির বলেন, ‘জেকেএলএফ আজাদি স্লোগানের অর্থ দাঁড় করিয়েছিল- ভারত থেকে স্বাধীনতা। স্লোগানটি এখনও আমাদের জন্য একই অর্থবহ।’
তিনি জানান, সংগঠনের পক্ষ থেকে আজাদি স্লোগান শুরু করা হয়নি। কিন্তু ওই সময়ের পারিপার্শ্বিকতায় এটি জনপ্রিয়তা পায়। ঠিক কবে স্লোগানটি প্রথম উচ্চারিত হয়েছিল সেই সময় ও স্থান সম্পর্কে তিনি কিছু বলতে পারেননি।
জাভেদ মির বলেন, “এটি ১৯৯০ দশকের শুরুতে শ্রীনগরের বহরি কাদাল এলাকায় সশস্ত্র বিদ্রোহীরা প্রথম তাদের অস্ত্র প্রদর্শন করে। কালাশিনোকভ রাইফেল স্বচক্ষে দেখে জনগণের মধ্যে উন্মত্ততা ছড়িয়ে পড়ে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হন। এদের মধ্যে কেউ একজন চিৎকার করে বলে উঠে ‘আমরা কী চাই’, জবাবে সমবেতরা সমস্বরে বলেন ‘আজাদি’।”
শুরুর দিকে ‘হাম ক্যায়া চাহতে’ (আমরা কী চাই) ছাড়াও স্লোগানটিতে আরও তিনটি বাক্যাংশ ছিল। ‘চিন কে লেঙ্গে (কেড়ে নেব), আজাদি’, ‘হ্যায় হক হামারা (আমাদের অধিকার), আজাদি’ এবং ‘জোরসে বলো (জোরে বলো), আজাদি’।
আজাদি স্লোগানটি আরও কয়েকটি বাক্যাংশের সঙ্গে সমন্বিত হতে খুব বেশি সময় নেয়নি। এগুলোর অনেকটাই ছিল মতাদর্শগতভাবে এর চেতনা-বিরোধী। এই পরিবর্তন উপত্যকায় সশস্ত্র সংগ্রামের পরিবর্তনের সঙ্গেও জড়িত। ১৯৯১ সালে হিজবুল মুজাহিদিন কাশ্মিরের সবচেয়ে বড় সশস্ত্র সংগঠনে পরিণত। পাকিস্তানপন্থী এই সংগঠন স্লোগানটিকে পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত হওয়ার দাবিতে ব্যবহার করে।
আপোষ না হলে স্লোগানটির ধর্মনিরপেক্ষতা অটুট থাকতো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মূল স্লোগানের সঙ্গে এর ভাবের মিল না থাকলেও সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। যেমন- ‘ফুলের মতো, আজাদি’, ‘সুভাসের মতো বিদ্যমান, আজাদি’ মূল ‘আজাদি’ স্লোগানের বিজয়গাঁথা মাত্র।
এসব অন্তর্ভুক্তি ও নতুন রূপে হাজির হওয়ার মধ্যদিয়ে স্লোগানটি একটি গানে পরিণত হয়েছে। ফলে যেখানেই বিক্ষোভ-প্রতিবাদ হচ্ছে সেখানেই তা উচ্চারিত হচ্ছে।