X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

৫২-এর ভাষা আন্দোলনের নেতাদের জীবনে ভাষার চরিত্র

স্বদেশ রায়
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ২৩:৫৪আপডেট : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ২৩:৫৬





স্বদেশ রায় ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা, ১৯৭১-এর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এক বিস্ময়কর আকর্ষণ চরমপত্রের লেখক ও পাঠক এম আর আকতার মুকুল। তিনি ভাষা আন্দোলন নিয়ে তাঁর স্মৃতিকথা লিখেছেন, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস লিখেছেন এছাড়া ‘রূপালী বাতাস সোনালী আকাশ’ নাম দিয়ে অদ্ভুত আকর্ষণের এক স্মৃতিকাহিনিও লিখে রেখে গেছেন। তাঁর অনেক বই এখন আর বাজারে পাওয়া যায় না। এসব বইয়েও তিনি অনেক কথা লিখতে পারেননি। হয়তো সচেতন থেকেই লেখেননি। কারণ, তিনি জানতেন ১৯৪৬-এর দাঙ্গা, ১৯৪৭-এর দেশভাগের পরে মাত্র পাঁচ ছয় বছর না যেতেই তারা কয়েক তরুণ মিলে সৃষ্টি করতে পথে নেমে ছিলেন ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের এক ইতিহাস, এক পথচলা। তাই সে সময়টা কোনোখানেই তাদের জন্যে সুসময় হবে না।

১৯৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারির পরে নিজেকে জেলজীবন ও হুলিয়ার জীবন থেকে বাঁচানোর জন্যে এম আর আকতার মুকুল সীমান্ত পার হয়ে পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। থেকে ছিলেনও অনেক দিন। তবে সে সময়টি তাঁর জন্যে সার্বিক সুখকর হয়নি। হয়তো তাঁকে পূর্ববাংলায় থেকে পাকিস্তানের জেলে যেতে হয়নি। নিজেকে কিছুটা নিরাপদ দূরত্বে রাখতে পেরেছিলেন। কিন্তু বিপরীতে তিনি এখানে মুসলিম লীগ সরকারের কাছ থেকে যে আচরণ পেয়েছিলেন, তাদের প্রতি যে আচরণ করতো মুসলিম লীগের কট্টর লোকজন, তার অনেকখানি কাছাকাছি আচরণ পেয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের অনেক স্থানে। পার্থক্য শুধু মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। অর্থ একই। পূর্ববাংলায় এই ভাষা সংগ্রামীরা তখন চিহ্নিত হয়েছিলেন হিন্দুদের দালাল হিসেবে। আর হিন্দু অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় গিয়ে তিনি বুঝতে পারেন তাকে মুসলমান হিসেবেই দেখছেন অধিকাংশ জন। তাঁরা যে একটি অসাম্প্রদায়িক ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ইতিহাস সৃষ্টিতে নেমেছেন, এ কথাটি পশ্চিমবঙ্গের কম মানুষই উপলব্দি করেছিলেন সেদিন। বরং তাকে দেখা হয়েছিল পাকিস্তানের একটি মুসলিম ছেলে হিসেবে।
পরিণত বয়সে এসে এম আর আকতার মুকুল বুঝতেন, আসলে ধর্মের নামে এই যে ভাগ, এর শেকড় অনেক গভীরে। এখান থেকে সব মানুষকে বের করে আনা অনেক কষ্টের। আবার এগুলোতে প্রতিক্রিয়া দেখালে, প্রকাশ করলে ভিন্ন অর্থ দাঁড়ায়। অনেক সময় সাম্প্রদায়িক শক্তি লাভবান হয়। তাই তিনি লিখিতভাবে কখনোই তাঁর পশ্চিমবঙ্গের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা কখনোই প্রকাশ করেননি। তবে জীবনের একটি প্রান্তে এসে আমরা যাতে বাস্তববাদী হই, পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করে এগুতে পারি, সেজন্য অতি আপনজন মনে করে অনেক কিছুই স্মৃতি থেকে বের করে এনে বলতেন, যা আজ আমাদেরও সত্যকে উপলব্ধি করতে শিখিয়েছে। কারণ, আজ হেফাজতকে যখন সরকারিভাবে তোষণ করা হয় তখন অনেক বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকের প্রতিক্রিয়া থেকে আমাদের প্রতিক্রিয়া ভিন্ন থাকে। যদিও প্রধানমন্ত্রীর হয়ে এই হেফাজতের সঙ্গে যারা কাজ করেছেন, তাদের অনেকের প্রকৃত ইতিহাস একসময়ে বের হয়ে আসবে। তাতে তাদের মুখোশ উন্মোচন হবে, তবে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থানের কোনও ক্ষতি হবে না। কারণ, তিনিও এম আর আকতার মুকুলের মতো জীবনের ঘাত প্রতিঘাত দিয়ে অনেক বাস্তবতাকে দেখেছেন। আর আমরা যারা এম আর আকতার মুকুলের মতো বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে কথা বলি, তাদের আওয়ামী লীগের দলীয় লোক বলা হয়। প্রশ্ন তোলা হয় আমাদের এত বছরের পেশায় নিবেদিত থাকার অবস্থানকে নিয়ে। যাক, এটা বড় কথা নয় বা এ লেখার কোনও বিষয় নয়। শুধু ধর্মীয় গোড়ামির অবস্থান আমাদের সমাজে কত গভীরে সে কথা বোঝার জন্যেই এ উদাহরণ টানা।
তবে তারপরেও ধর্মীয় গোড়ামি বাঙালি জাতির সবটুকু নয়। এগুলো উপসর্গ মাত্র। এ কারণেই এম আর আকতার মুকুলের মতো মানুষ কেবল ব্যক্তিগত আলোচনায়, কথাগুলো বলেছেন। তবে এই বাস্তবতা তুলে ধরলেও এম আর আকতার মুকুল মূলত প্রকাশ করার চেষ্টা করতেন বা বোঝানোর চেষ্টা করতেন সাম্প্রদায়িকতার শেকড়টি কত গভীরে। এই মানুষগুলো বিশেষ করে আমাদের ভাষা আন্দোলনের নেতাদের ভেতর একটি চেতনায় সব সময়ই দৃঢ় থাকতে দেখেছি তাদের জীবনের শেষ মুহূর্ত অবধি যে, ভাষা সব মানুষের, ভাষা মানুষের শ্রমের সঙ্গে সংযুক্ত, ভাষা কখনোই কোনও ধর্মীয় বা সম্প্রদায়ের বিষয় নয়। যেমন আরবি ভাষাও মুসলমানের নয়, সংস্কৃত ভাষাও হিন্দুর নয়। সব ভাষাই সৃষ্টি হয়েছে মানুষের সংস্কৃতি ধরে, আর যেকোনও সংস্কৃতিই ওই এলাকার মানুষের শ্রমের ফসল। আর ভাষার মতো সর্বজনীন চরিত্র অর্জন ছাড়া কখনোই মানুষ হওয়া যায় না। নিজের জীবনবোধ ও নিজেকে এমনই সর্বজনীন করেছিলেন এম আর আকতার মুকুল।
১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনে যে ছাত্রসভা থেকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত হয়, ওই ছাত্রসভার সভাপতি ছিলেন গাজীউল হক। আজীবন ভাষার প্রশ্নে এক আপসহীন মানুষ ছিলেন। পিতৃব্যের মতোই তাকে দীর্ঘসময় কাছ থেকে দেখেছি, দেখেছি কী বিশাল ছিলেন মানুষটি। পৃথিবীর তাবৎ ভাষা যেমন সব মানুষকে ধারণ করে, আপন সত্তার মতো আবির্ভূত হয়, আবার প্রমাণ করে ভাষাটি নিজস্ব ভূখণ্ডের শ্রমজীবী মানুষের—গাজীউল হকের ব্যক্তিজীবনও ছিল তেমনি। তাঁকে কাছ থেকে দেখে, তাঁর সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নানান বিষয় নিয়ে আলোচনা করে বিস্মিত হতাম এই ভেবে, একটি ভাষা কত জীবন্ত হলে একজন জীবন্ত মানুষের চরিত্র আর ভাষার চরিত্র এক হতে পারে। ভাষাকে ভালোবেসে গাজীউল হক কী কী করেছেন, তা লিখতে গেলে অনেক বড় বই লিখতে হবে। হয়তো জীবনে সময় পেলে সে কাজ করতে পারবো, হয়তো বা করা হবে না। কারণ, মানুষের সব আশা পূরণ হয় না। তবে গাজীউল হকের ওপর অনেক কাজ এ দেশে হবে। শুধু গাজীউল হক নয়, ১৯৫২-এর সব ভাষা সংগ্রামীর জীবনের ওপর। তবে গাজীউল হক কীভাবে নিজেকে একটি ভাষার মতোই সব ধর্ম ও বর্ণের ঊর্ধ্বে রেখেছিলেন সেটা সত্যিই এক বিস্ময়কর বিষয়। তবে এখান থেকে একটি বিষয় বোঝা যায় যে তাঁরা যে ভাষা আন্দোলনটি করেছিলেন, সেই আন্দোলনটি তাঁদের নিজেদের কোনও স্বার্থের আন্দোলন ছিল না। ছিল সম্পূর্ণরূপে তাঁদের বিশ্বাসের একটি আন্দোলন। আর সে বিশ্বাস থেকে তাঁরা জীবনে কখনোই কোনও পরিস্থিতিতে সরে আসেননি। বরং শত প্রতিকূলতার মাঝে নিজেকে আরও বিশ্বাসের প্রতি আস্থাবান করেছেন,ঋজু করেছেন নিজের অবস্থানকে। আর এর থেকে বোঝা যায়, তাঁরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন তখনই এ আন্দোলন করলেও কোনোরূপ হুজুগে আন্দোলন করেননি, ভাষাভিত্তিক একটি চেতনাকে সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি ও জীবনে ধারণ করেই সেই আন্দোলন করেন। আর তাদের সেই ভিত্তিটি এতই শক্ত ছিল যে সেখানে চারাগাছটি কেবলই বড় হয় সারা জীবন ধরে।
৫২-এর ওই ভাষা আন্দোলনের আরেক নেতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। নিজে খুব ভালো বাংলা ও ইংরেজি জানতেন। আইনজীবী হিসেবে অনেক বড় ছিলেন। আর রাজনীতিক হিসেবে কত বড় ছিলেন তা তার জীবনের শেষ বয়সে এসেও ১/১১ পরবর্তী সময়ে প্রমাণ করে গেছেন। তিনি উদাহরণ রেখে গেছেন শান্ত মাথায় কত বড় আন্দোলন করা যায়। দুঃসময়ে রাজনীতিককে কতটা ধীরস্থির ও সৎ থাকতে হয়। তবে বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর দায়বোধ দেখে মাঝে মাঝে বিস্মিত হয়েছি। অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ একটা বাংলা লেখা তৈরি করে তিনি চলে আসতেন তার বন্ধু গাজীউল হকের কাছে। কারণ, গাজীউল হক শুধু একজন রাজনীতিক ও ভাষা আন্দোলনের নেতা ছিলেন না। তিনি যেমন রাজনীতিবিদ তেমনি ছিলেন কবি, গীতিকার, সুরকার, গায়ক ও চমৎকার গদ্য লেখক। পাণ্ডিত্য ছিল তাঁর অপরিসীম। নিজের বন্ধুর এই পাণ্ডিত্যকে শ্রদ্ধা করতেন জিল্লুর রহমান। তাই মাঝে মাঝেই নিজের কোনও লেখা নিয়ে উপস্থিত হতেন গাজীউল হকের কাছে। বলতেন চোখ বুলিয়ে দিতে। সংশোধন করতে। গাজীউল হককে প্রায় বলতে শুনেছি, জিল্লুর তুমি অনেক ভালো লেখো। এরপরেও কেন তুমি এমনটি করো। কেন এগুলো আমাকে দেখতে বলো। বিনয়ী জিল্লুর রহমান প্রায়ই বলতেন, দেখো গাজী, মাতৃভাষা নির্ভুল ও সুন্দর করে লেখা উচিত। ভাষার প্রতি এই দায়বোধই শুধু শ্রদ্ধার নয়, অনুসরণ করারও। সর্বোপরি, তাকেও দেখেছি, ধর্মের সব বাড়াবাড়ির ভেতর নিজের অবস্থানকে ঠিক রাখতে। ওই এম আর আকতার মুকুলের মতো। তিনিও বুঝতেন একদিনে কোনও একটি সুন্দর অবস্থানে যেতে পারবো না বা কোনও মানব সম্প্রদায় যেতে পারে না। তারপরে ১৯৪৬, ১৯৪৭ ও ভারত ভাগ সাম্প্রদায়িকতাকে এই উপমহাদেশে যেখানে নিয়ে গেছে সেখানে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ প্রোথিত করা অনেক শক্ত কাজ। তারপরেও মাটির প্রদীপের মতো সবাই আলো জ্বেলে জ্বেলে আলোকিত রাখতে হবে পৃথিবীকে—যতক্ষণ না অবধি সূর্য এসে আলো দেয়।

/টিটি/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ