X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

টেলিভিশন ভুবনের হাল-হকিকত

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
০৪ মার্চ ২০২০, ১৪:০৪আপডেট : ০৪ মার্চ ২০২০, ২০:০৪

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা দ্বিতীয়বারের মতো ব্রডকাস্ট কনফারেন্স করছে সম্প্রচার সাংবাদিকদের সংগঠন ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার। এই শুক্রবারে অনুষ্ঠিতব্য এবারের সম্মেলন এমন একসময় হতে চলেছে যখন বাংলাদেশের সম্প্রচার জগৎ, বিশেষ করে টেলিভিশন এক নিরুদ্দেশ পথে যাত্রা করেছে। ৩৪টি চ্যানেলের হাজার হাজার কর্মী দিনরাত একটি প্রশ্নের মুখোমুখি এখন—চতুর্থ স্তম্ভের সবচেয়ে সক্রিয়, সতেজ মাধ্যম, টেলিভিশন বাঁচবে তো? একমাত্র আয়ের উৎস বিজ্ঞাপন কমতে কমতে এমন এক অবস্থা হয়েছে যে, এখন নিয়মিত বেতন দেওয়া, কর্মী ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছে উদ্যোক্তাদের জন্য।
অনলাইনের বিকাশ ও বিস্তার, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে লাইভসহ ভিডিও কনটেন্ট, দেশের বিজ্ঞাপন পাচার হয়ে যাওয়া, হ্রাস পাওয়া, ক্যাবল অপারেশন থেকে কোনও অর্থ না আসাসহ নানাবিধ আঘাতে প্রমোদ গুনছে বাংলাদেশের টেলিভিশন খাত।
দুই দশক আগে একুশে টেলিভিশন যে বিপ্লব শুরু করেছিল, সেই খাত এখন রুগ্‌ণ। একসময় যা ছিল তারুণ্যের কাছে স্বপ্নের ভুবন, সেই টেলিভিশন এখন আর কারও জন্য ক্যারিয়ার নয়। প্রায় প্রতিদিনই অপ্রত্যাশিতভাবে কর্মহীন হয়ে যাচ্ছেন অনেকে, তাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লেও কেউ যেন দেখার নেই। টেলিভিশন এখন কাউকে চাকরি দেয় না, বরং পূর্ণ বেকার তৈরি করে। কোনও কোনও চ্যানেল বার্তাকক্ষ গুটিয়ে ফেলেছে, কোনও আগাম ঘোষণা ছাড়াই চলছে সাংবাদিক ও কর্মী ছাঁটাই।

দুই-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া খুব কম চ্যানেলই প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়েছে। প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, কর্মী বিমা কিছুই নেই। এর অর্থ হলো উদ্যোক্তারা মরিয়া হয়ে টেলিভিশনের লাইসেন্স নিয়েছেন, কিন্তু প্রতিষ্ঠান গড়ার কথা ভাবেননি। শুরু থেকেই টেলিভিশনের কোনও বিজনেস কেস বা মডেল চিন্তা করা হয়নি। গত দুই দশকে এদেশে টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু বিকাশের পথে হাঁটেনি। এই খাতে বড় পুঁজির প্রবেশ ঘটেছে, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকতা আসেনি।

আগেই বলেছি, টেলিভিশনের একমাত্র আয়ের উৎস বিজ্ঞাপন। দেদার লাইসেন্স দেওয়ায় চ্যানেলের সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু বিজ্ঞাপন কমছে। আর বিজ্ঞাপনের দরপতনের কথা শুনলে শেয়ারবাজার ধসের কথা ভুলে যাবে মানুষ। 

বড় আঘাত এসেছে দুই জায়গা থেকে। একটি হলো মধ্যস্বত্বভোগী একদল অসৎ ব্যক্তির মাধ্যমে বিদেশি চ্যানেলে দেশীয় বিজ্ঞাপন চলে যাওয়া। বড় বড় কোম্পানির বিজ্ঞাপন চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। এসব বিজ্ঞাপন দেশের বাইরে চলে যাওয়ায় বড় আর্থিক ক্ষতিতে আজ দেশীয় চ্যানেলগুলো। আরেকটি হলো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের আগ্রাসন। গুগল, ইউটিউব আর ফেসবুকে চলে যাচ্ছে বহু বিজ্ঞাপন।

অনেকে বলতে পারেন, মানুষ যা চায় সেই কনটেন্ট পাচ্ছে না বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোতে। একথা যেমন সত্য, আবার এটাও মানতে হবে, একটা সময় এ দেশের মানুষ আমাদের কনটেন্টেই সন্তুষ্ট ছিল। বাংলাদেশে বিভিন্ন দেশের বহু পে-চ্যানেল এবং অসংখ্য ফ্রি চ্যানেল সম্প্রচারিত হচ্ছে। বিদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন প্রচারের নামে শত শত কোটি টাকা মূলত চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। আয় কমে যাওয়ায় আমাদের চ্যানেলের কনটেন্টের মান বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে চ্যানেলগুলোর দর্শক কমছে আর বেকার হচ্ছেন আমাদের কর্মীরা। প্রায় বিনে পয়সায় কনটেন্ট বানিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে চ্যানেলগুলো।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায়, গুজব আর জঙ্গি আতঙ্ক প্রতিরোধে আমাদের চ্যানেলগুলো এখনও বড় ভূমিকা রাখছে। একটি দেশের টেলিভিশন মানে তার দেশের সংস্কৃতির বাহন, যা কখনও কোনও বিদেশি চ্যানেল হতে পারে না। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভটির ওপর নির্ভর করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা এবং সর্বোপরি সামাজিক দায়বদ্ধতা। সংকটের তীব্রতায় টেলিভিশনের জন্য এ কাজগুলো কঠিন হয়ে পড়ছে।

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটকে ব্যবসায়িক সফলতা এনে দিতে উদ্যমী হয়ে বিশ্বসেরা সেবা দেওয়া এপস্টার ছেড়ে এলো বাংলাদেশের বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো। কিন্তু আজ নিজেদের অস্তিত্বই বিলীনের মুখে।

এমন কঠিন বাস্তবতায় সরকারের সাহায্য বড় করে প্রয়োজন। টেলিভিশন মালিক, কর্মী, বিজ্ঞাপন এজেন্সিসহ নানা স্তর থেকে দাবি ওঠার পর গত বছর ১ এপ্রিল সরকার উদ্যমী হয়ে বিদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন বন্ধ করতে উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এখনও চলছে এই কাণ্ড। অথচ সরকারের নোটিশে উল্লেখ ছিল, ২০০৬ সালের ক্যাবল অপারেটর আইনে ১৯-এর ১৩ ধারায় যেখানে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে বাংলাদেশে বিদেশি চ্যানেল সম্প্রচারিত হবে ক্লিন ফিডে, অর্থাৎ কোনও প্রকার বিজ্ঞাপন ছাড়া। ১৩ বছর ধরে এই আইন বর্তমান, অথচ আজ এত পরে এসেও আইনের বাস্তবায়ন করতে এসে পারা যায় না। এই আইন বাস্তবায়নের দাবি উঠবে নিশ্চয়ই এবারের সম্মেলনে।

প্রিন্ট মিডিয়াকে সরকার নানা ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করে। নিউজপ্রিন্ট আমদানিতে শুল্ক সুবিধা দেয়, কোটি কোটি টাকার সরকারি বিজ্ঞাপন পায় পত্রিকাগুলো। সরকারি যেকোনও উদ্যোগ বা ঘোষণা পত্রিকায় প্রকাশ করে বিজ্ঞাপন দিয়ে। সব জাতীয় ও অন্যান্য দিবসে বড় অঙ্কের ক্রোড়পত্র পায়। অথচ এসবই টেলিভিশনে সরকার প্রচার করছে বিনা পয়সায়। অডিয়েন্স রিচের কথা ভাবলে পত্রিকার চেয়ে টেলিভিশন অনেক বেশি সংখ্যক মানুষকে সংযুক্ত করে। যারা সরকারি ডকুমেন্টারি তৈরি করে, তার অর্থ পেলেও পায় না কেবল টেলিভিশন।

গণমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের উদ্যোগ প্রয়োজন। ‘টেলিভাইজড’ নিউজ গণমাধ্যমের অগ্রণী স্বর হিসেবে সমাজ আর রাষ্ট্রের যোগসূত্রের কাজ করে। আধুনিক সমাজে রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে সক্রিয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম হলো টেলিভিশন। তথ্য-যুক্তির বিন্যাসে সমাজের পক্ষে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনই এর প্রাথমিক কাজ। সমাজের নানা সম্ভাবনা আর প্রত্যাশা রাষ্ট্রের কাছে তুলে ধরছে সে। সরকার-পরিপন্থী কোনও দায়িত্ব পালন তার কাজ না, কিন্তু সময়বিশেষে কঠিন প্রশ্ন তুলে ধরতে হয় তাকেই। আবার সরকারি পরিকল্পনা, কর্মকাণ্ডের বয়ানও সর্বজনের কাছে নিয়ে যাওয়াও টেলিভিশনের দায়।

সমাজ বা রাষ্ট্রের অক্ষমতা আর দুর্বলতা ঢেকে দিতে পারে ইমেজ দুনিয়া। সেই ইমেজ দুনিয়াই টেলিভিশন সংবাদ। আগামীতে রাষ্ট্র ও সমাজের যে নয়া সম্পর্ক তৈরি হতে চলেছে, সেখানে এরাই জনপ্রতিনিধি। রাষ্ট্র ও সমাজের বিভাজন রেখা বড় করতে না চাইলে টেলিভিশনকে বাঁচানোই দায়িত্ব সবার—রাষ্ট্রের, উদ্যোক্তাদের, কর্মীদের, সমাজের সবার।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা

/এসএএস/এমএমজে/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
যুদ্ধ কোনও সমাধান আনতে পারে না: প্রধানমন্ত্রী
যুদ্ধ কোনও সমাধান আনতে পারে না: প্রধানমন্ত্রী
শপথ নিলেন আপিল বিভাগের নতুন তিন বিচারপতি
শপথ নিলেন আপিল বিভাগের নতুন তিন বিচারপতি
চীনে আমেরিকার কোম্পানিগুলোর প্রতি ন্যায্য আচরণের আহ্বান ব্লিঙ্কেনের
চীনে আমেরিকার কোম্পানিগুলোর প্রতি ন্যায্য আচরণের আহ্বান ব্লিঙ্কেনের
সারা দেশে আরও ৭২ ঘণ্টার ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি
সারা দেশে আরও ৭২ ঘণ্টার ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ