X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

যৌগবাদী পুরুষ…

সৈয়দা আখতার জাহান
০৮ মার্চ ২০২০, ১৬:১৮আপডেট : ০৮ মার্চ ২০২০, ১৬:১৯

সৈয়দা আখতার জাহান ১৮৭৯ সালে হেনরি ইবসেনের ‘ডলস হাউজ’-এর নায়িকা নোরা বের হয়ে এলো তার অসম্মানের সংসার ছেড়ে। স্বামীর কোড অব কন্ডাক্টের বিধিনিষেধের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতি প্রায় সমান ও পবিত্র দায়িত্ব পালনের ব্রত নিয়ে। নাটকটি নোরার সংসার ছেড়ে বেরিয়ে আসার দৃশ্য দিয়ে শেষ হলেও জানতে ইচ্ছে করে, কোথায় গেলো নোরা? কেননা ধরেই নেওয়া হয়, পৃথিবীটা পুরুষের; মেয়েরা সেখানে বহিরাগত অতিথি, সিমোন দ্য ব্যাভোয়ারের ভাষায়—‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’। পৃথিবী-দেশ-সমাজ-সংসার; পুরুষ হচ্ছেন কর্তা আর নারী তার ইচ্ছা পালনকারী দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষ। তারা না থাকার মতোই মিশে থাকবে পরিবারের অন্যদের সঙ্গে। নারী যদি কখনও নিয়মের বেড়াজাল পেরিয়ে ইচ্ছেকে প্রাধান্য দেন, তখন শুরু হয়ে যায় ‘হায় হায়’।
১৮৪৮ সালের জুলাই মাসে সেনেকা ফলস কনভেনশনে নারী চাইলেন নিজস্ব উপার্জন, নিজস্ব সম্পত্তির অধিকার, শিক্ষার অধিকার, বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার, সন্তানের অধিকার এবং ভোটাধিকার। যে ২৫০ জন নারী এই দাবিপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন, তার মধ্যে মাত্র একজন নারী, সেই সময় যিনি ১৯ বছর বয়সী ছিলেন; ১৯২০ সালে ভোট দিতে পেরেছিলেন। ১৮৬৯ সালে প্রকাশিত হয় জন স্টুয়ার্ট মিল-এর ভাষ্য ‘সাবজুগেশন অব উইমেন’। ইউরোপজুড়ে শুরু হয় লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন। অদম্য নারীরা প্ল্যাকার্ড হাতে প্রেসিডেন্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, ‘Mr. President, what will you do for woman suffrage?’ ১৯ ডিসেম্বর, ১৯১৭ এবং ১৭ অক্টোবর, ১৯১৮; লেলিন দুটি ডিক্রি জারি করেন। যেখানে তিনি নির্ভরশীলদের ওপর পুরুষের একচোখামির অভ্যেসকে পঙ্গু করে দিলেন এবং নারীকে দিলেন অর্থনৈতিক, সামাজিক ও যৌন-আত্মনিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ অধিকার। ঘোষণা করলেন, শিগগিরই মেয়েরা তাদের বাসস্থান,‌ নাম ও পদবি নির্বাচনের সুযোগ পাবে। ১৯২৭ সালে ডিক্রি দুটি আইনের স্বীকৃতি পায়; তাতে নারীকে দেওয়া হয় মাতৃত্বকালীন ছুটি, শ্রমশক্তিতে নারীকে স্বাগত জানিয়ে শিক্ষা, গার্হস্থ্য ও বেতনভোগী শ্রমকে যৌথ দায়িত্বে পরিণত করা হয়। পেরিয়ে গেছে প্রায় ১০০ বছর, তারপরও প্রশ্ন থেকেই যায়, নারী আসলে কোথায় পৌঁছাল?

সমাজ কেমন মেয়ে চায়? একটা মেয়ের কাছ থেকে কী চায়? কোন চেহারায় দেখতে চায়? কী কী পেতে চায়? এগুলো জানার জন্য জনে জনে জিজ্ঞেসা করার দরকার পড়ে না। যেকোনও জাতীয় দৈনিকের ‘পাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপনের পাতায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলেই চলে। যেখানে কাঙ্ক্ষিত পাত্রীর আদর্শ লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে ফর্সা, লম্বা, নম্র, ভদ্র, সুন্দর, শিক্ষিত, নামাজি, ঘরোয়া, উচ্চবংশীয়। বিয়ের বাজারে পাত্রী হতে হবে নিখুঁত। রূপেগুণে অনন্যা। অন্তত সামাজিক চাহিদাগুলো তো তাই বলে। বিজ্ঞাপনের চাওয়াগুলো থেকে আরও জানা যায়, ঢাকার স্থায়ী নিবাসী হতে হবে। বিজ্ঞাপনের এই চাওয়াগুলো সাধারণ নয় বরং অসাধারণ মেয়েদের খুঁজে পেতেই দেওয়া হয়। পাত্রী চাই বিজ্ঞাপনের নারীত্বকে আঁকা হয়—লজ্জাশীলতা, নয়নসুখ চেহারা, নির্ভরতা, প্রশ্নহীন আনুগত্য, আজন্ম অধীনা দিয়ে। এসব পরিমাপহীন চাহিদা সাধারণ মেয়েদের জন্য তৈরি করে অনিশ্চয়তার এক অতল খাদ! বাস্তবতাটা কেমন? আমার এক বন্ধুর স্নাতকে পড়ার সময়ে বিশেষ মেয়ে বান্ধবী ছিল। তার সেই বান্ধবী পড়তো ইসলাম শিক্ষায়। এটা নিয়ে বন্ধুর মন্তব্য ছিল—যে মেয়ে ইসলাম শিক্ষায় পড়ে সে তো জীবনেও চাকরি পাবে না; তাই আমার বন্ধুকে তার স্ত্রীর চাকরির বিপক্ষে মত দেওয়ার ঝামেলা পোহাতে হবে না। নিশ্চিন্তে গৃহিণী স্ত্রী নিয়ে সংসার করতে পারবে। এটা ২০১০ সালের কথা বলছি। ঠিক তার দশ বছর (২০২০) পরের আরেকটি সত্যি গল্প বলি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের জন্য অভিভাবক মহলে বিয়ের পাত্র খোঁজা হচ্ছে। উচ্চশিক্ষিত দু’জন পাত্রের প্রস্তাব এলো দুই পরিবারের কাছ থেকে। পিএইচডি ডিগ্রিধারী দু’জন পাত্রই ধার্মিক ও পর্দানশীন মেয়ে চান। মেয়েকে পর্দা করতে হবে মাস্ট। বোরকা পরতে হবে, নিদেনপক্ষে হিজাব।

ঘরের বাইরে (ক্ষেত্রবিশেষ ঘরেও) নারী ভীষণ একা। বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে গিয়ে নারীকে প্রতিনিয়ত মুখোমুখি হতে হয় নানান প্রতিকূল পরিস্থিতির। ‘করপোরেট উইমেন’ নামে ১৯৮০ সালের মাঝামাঝিতে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে ‘glass ceilings’ নামে একটা টার্ম ব্যবহার করা হয়; এর মাধ্যমে বর্ণনা করার চেষ্টা করা হয়, উচ্চপর্যায়ে মেয়েদের চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে কৃত্রিম বাধা বা সংকটগুলোকে। যে বাধা বা সংকটগুলো ব্যক্তি বা সংগঠনের পছন্দ-অপছন্দ দ্বারা সৃষ্ট’। আমেরিকায় পরিচালিত আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, পুরুষদের প্রতি ৭৬ ডলারের বিপরীতে নারীদের আয় মাত্র এক ডলার। এছাড়া পাঁচশ’টি কোম্পানির ওপর পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, এদের মধ্যে নারী সিইও মাত্র দুই জন এবং করপোরেট অফিসারদের মধ্যে নারীর অংশগ্রহণ মাত্র দশ শতাংশ’। অথচ মারি ড্যালি ‘পুরুষবাদের প্রান্তে এক নতুন মহাকাশ’ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন নারীদের জন্য।

পরিবারে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীর অবস্থান ও অভিজ্ঞতা অসমভাবে অবস্থিত। কর্মস্থলে আট ঘণ্টা কাজ করলেই নারীর কাজ শেষ হয়ে যায় না, বাসায় ফিরে তাকে সংসারের দায়িত্বও পালন করতে হয়। নারীরা ইচ্ছে করলেই ধর্মঘট করতে পারেন না। যদিও প্রজন্মের পর প্রজন্ম, দিনের পর দিন, সামাজিক, পারিবারিক, শারীরিক ও অর্থনৈতিকভাবে পুরুষের ওপর নির্ভর করতে করতে এদেশের অধিকাংশ মেয়ে ভুলেই গেছে তারাও মানুষ। সমাজও নারীদের মুক্তি খুঁজতে গিয়ে ‘নারীদের উপহার দিয়েছে মুক্তিহীনতা’। এই সমাজে গত বিশ বছর ধরে ধর্ষণ এক অবিরাম প্রক্রিয়া। যার মধ্য দিয়ে কাম চরিতার্থ করা ছাড়াও পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ধর্ষণ যে একটা দুর্ঘটনা, যেকোনও মেয়ের জীবনেই ঘটতে পারে, ঘটলেই মেয়েটা বাতিল হয়ে যায় না, সে আগের মতোই জলজ্যান্ত এক মানুষী থাকে, একথা সমাজের ক’জন মানেন সন্দেহ হয়। যদিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্ষণ নিয়ে সরব মানুষের (পুরুষ) সংখ্যা নেহাত কম নয়। তবু বিবাহ নামক প্রথায় একজন ধর্ষিতা নারী গ্রহণযোগ্যতার দেখা মিলে না।

ব্যক্তিজীবনে নারীকে সারাক্ষণ পুরুষের নির্মিত এবং চর্চিত নিয়মের অনুশাসনে লিঙ্গাশ্রয়ী রাজনীতির অধীন থাকতে হয়। নারীকে অবদমিত রাখার মহান দায়িত্ব পুরুষ তুলে নিয়েছেন নিজের কাঁধে। নারীকে নিয়ন্ত্রণের জন্য অপবাদের অস্ত্র প্রস্তুত রাখা ছিল সবসময়, তাই তো ষোল শতকে অধিকার সচেতন শত সহস্র নারীকে ‘ডাইনি’ উপাধি দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। সতীত্ব সর্বস্ব মিথকে মাথায় রেখে নারীকে পর্দায় রাখার কথা বহুলভাবে প্রচার করা হয়। তা না হলে নারী হয়ে যান নষ্টা, চরিত্রহীনা কিংবা সভ্য সমাজে বীরাঙ্গনা। বিয়ে নামক প্রথা নারীকে সারাজীবনের মতো পুরুষের দাসী করেছে, ঘর হয়েছে তাদের সীমানা। নারীকে নিজের সম্পত্তি ভেবেছেন, সে হয় স্ত্রী কিংবা প্রেমিকা। পুরুষ তার মুক্তচিন্তা যতটা বাইরে করেন, ঘরে সেটার দেখা মেলা ভার। তাই তো এই সময়ে দাঁড়িয়ে পারিবারিক নির্যাতিত নারীর সংখ্যা অগণিত। যেসব পুরুষ মৌলবাদের চর্চা করেন তাকে চেনা যায়, কিন্তু যেসব পুরুষ যৌগবাদের চর্চা করেন তাকে চিনবেন কীভাবে?

সত্যি নারী, আসল নারী, বাস্তব নারী নিয়ে আলাদা করে ভাববার সময় এসেছে। ‘নারীবাদ বা ফেমিনিজম’ শব্দটি নিয়ে অনেকের রয়েছে আপত্তি। নারীবাদী এলিস ওয়াকার তাই ফেমিনিজম বদলে নতুন শব্দে বলছেন ‘ওম্যানিজম’। এবার আশা করি আর আপত্তি থাকবে না। সমাজের যেকোনও পরিবর্তন পুরুষের চোখে অনাসৃষ্টি অথচ নারী বলছেন পুনর্নির্মাণ। নারী প্রায়শই ভুলে যায় কী তার সাধ্য, কী তার যোগ্যতা, কী তার মূল্য। উৎপাদনশীল হওয়ার কারণে হয়তো তাদের সহনশীলতাও বেশি। নারীরা তাদের অনুভূতিগুলোকে সুপ্ত রাখেন, অনেক ক্ষেত্রেই তারা সেটা করতে বাধ্য হন এবং অধিকাংশ সময়ই সামাজিক কারণে সেগুলো অপ্রকাশিতই থেকে যায়। পৃথিবীর সব নারী একটা জায়গায় গিয়ে এক, এবং সেটা হলো তারা ‘নারী’। নারীর অধিকার নিয়ে অবিরাম বলতে হবে, অনিঃশেষ প্রশ্ন তুলতে হবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা এবং গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এবার ‘হুব্বা’ নামে হলো গানচিত্র
এবার ‘হুব্বা’ নামে হলো গানচিত্র
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ