X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

স্বাস্থ্যসেবা ও মানুষের আবেগ

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
২৭ মে ২০২০, ১৪:৫২আপডেট : ২৭ মে ২০২০, ১৬:১৫

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা আমার এক বন্ধুর মা ৭০ বছরের বেশি বয়স, এই করোনাকালে হৃদরোগসহ নানা জটিলতায় ভর্তি হয়েছিলেন একটি বেসরকারি হাসপাতালে। তিনি আইসিইউতে ছিলেন। একটা পর্যায়ে তার নিউমোনিয়ার লক্ষণ দেখা দেয় এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীর পরিবারকে চাপ দেয় এই রোগীকে সরিয়ে নিতে। তার শ্বাসকষ্টকে কোভিড সাসপেক্ট বলে মতামত দেয় এবং বলে এই রোগীকে আর রাখা যাবে না। একপর্যায়ে আমিও কথা বলি হাসপাতালের মালিকের সঙ্গে। তবে তার আগেই রোগীর স্বজনদের হাতে রোগী তুলে দেন এবং তারা তাকে আরেকটি অতি নিম্নমানের প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করেন। কয়েকদিনের মধ্যে সে রোগী মারা যান। মৃত্যুর পর রিপোর্ট আসে তার করোনা ছিল না। শুধু সন্দেহের কারণে হাসপাতালের আচরণে একজন বয়স্ক রোগীকে, তার স্বজনদের কী ট্রমার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে ভাবা যায়? একজন আইসিইউতে থাকা রোগীকে কি হাসপাতাল ছাড়তে বাধ্য করা যায়? মেডিক্যাল এথিক্স বলে কি এ দেশে কোনও কিছু সত্যিই প্রতিপালিত হয়?

কবি ফরিদ কবীর তার মা’কে নিয়ে এমনই এক যন্ত্রণার রাত পার করেছেন। করোনা উপসর্গ থাকার কারণে সাধারণ হাসপাতাল তাঁকে নিতে চায়নি। পরে জানা গেলো তার করোনা নেই। করোনা নেই, কিন্তু তার সন্তানরা ঈদের সময়টায় যে যন্ত্রণা সইলেন তার মূল্য দেবে কি এই সমাজ? কারও ডায়রিয়া, ভয়াবহ জ্বর, পেটে ব্যথা, ফুসফুসের সমস্যা থাকলেই তাকে করোনা সাসপেক্ট বলে দিয়ে হাসপাতাল থেকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। ফরিদ কবীর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘করোনা ছাড়াই এ উপসর্গগুলো বা অসুখগুলো মানুষের হতে পারে। যদি আপনার বা আপনার প্রিয়জনের এ ধরনের অসুখ হয় তাহলে নিশ্চিত থাকুন, কোনো হাসপাতালেই আপনাদের জায়গা হবে না।’ দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার এমন হৃদয়হীন চেহারাটা প্রতিদিনই স্পষ্ট হচ্ছে। দ্রুততার সঙ্গে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। কোভিড, নন-কোভিড এবং কোভিড সাসপেক্ট, কোন রোগীর কী চিকিৎসা কীভাবে হবে তার একটা কঠোর নির্দেশনা আসা অতি জরুরি হয়ে পড়েছে।     

গত কয়েকদিনে করোনাভাইরাসের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে দেখা গেছে দেশের শীর্ষস্থানীয় ধনী পরিবারের সদস্যদের। এমন সব পরিবারের লোকজন করোনার কাছে পরাজিত হচ্ছেন বলে সমাজের নানা স্তরে বড়সড় আলোচনা শুরু হয়েছে। এই শ্রেণির মানুষজন সাধারণ সর্দি, জ্বর বা গা ব্যথা হলেও সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, ইউরোপে দৌড়ঝাঁপ করেন। এখন তারা দেশেই বাধ্য হচ্ছেন চিকিৎসা নিতে, অথচ এ দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে কখনও কোনও ভূমিকা রাখেননি তারা। আবার যারা বড় হাসপাতাল করেছেন বা প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ বানিয়েছেন, তারাও শুধু ব্যবসাই করেছেন এবং এখনও মগজে তাদের শুধু ব্যবসাটাই আছে। মানবিকতা, নীতি নৈতিকতার ধারে-কাছেও তারা হাঁটছেন না।

করোনার আগমনে পুরো বিষয়টা পরিষ্কার হলো কতটা অগোছালো, কতটা অক্ষমতা আর অব্যবস্থাপনায় রুগ্ন আমাদের স্বাস্থ্য খাত। স্বাস্থ্য খাতে আমাদের দেশে সামগ্রিক রাষ্ট্রীয় ব্যয় এমনিতেই অনেক কম। আউট অব পকেট বা রোগীর নিজের থেকে খরচ হয় ৬৭ শতাংশ। বাকি ২৩ শতাংশের যেটুকু হয়, ভালো জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার অভাবে সেটাও দুর্নীতি, অনিয়ম আর অদক্ষতায় আক্রান্ত। দাবি করা হচ্ছে, করোনাভাইরাস স্বাস্থ্য বিভাগ করোনা রোগ মোকাবিলায় সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। সংবাদমাধ্যমও তৎপর সেসব খবর দিতে। কিন্তু উত্তর পাওয়া যায় না কিছু প্রশ্নের- কেন করোনা টেস্ট করতে ফুটপাতেই অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকতে হয়? কেন উপসর্গ থাকলেই হাসপাতাল, ক্লিনিক রোগী ফিরিয়ে দিচ্ছে? কেন বয়স্ক রোগীকেও শুধু করোনা সন্দেহের কারণে হাসপাতাল ছাড়তে বলা হয়?

চিকিৎসা আর জনস্বাস্থ্য নিয়ে বড় করে ভাবার সুযোগ করে দিয়েছে করোনাভাইরাস। আমরা হয়তো উন্নত দেশের মতো পারিনি, কিন্তু বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতের একটা শক্ত কাঠামো ইউনিয়ন পর্যন্ত বিস্তৃত। কিন্তু এই মহামারি আমাদের বুঝিয়ে দিলো বড় অধিদফতর আছে, বড় বড় ভবন আছে, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা তৈরি করা হয়নি। মন্ত্রণালয় আছে, বহু বিভাগ আছে, সারা বছর নানা কর্মসূচি পালিত হয়। কিন্তু এ দেশের জনস্বাস্থ্য-উন্নয়ন প্রয়াসে সত্যিকারের নেতৃত্বের দায়িত্ব কে নেবে, সেটাই নির্ধারিত করা যায়নি।

কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্র চারদিক থেকে নিয়ন্ত্রণ করছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে। রোগ বিস্তারের একপর্যায়ে স্বাস্থ্য মহাপরিচালককে দেখা গেলো সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ ( ২০১৮ সালের ৬১নং আইন ) প্রয়োগ করতে। কিন্তু এর বাস্তবায়ন হলো কি হলো না তার কোনও পর্যালোচনা কোনও স্তরেই আর মূল্যায়িত হয়নি।

যেসব বিভাগ স্থানীয় সরকারের বিষয় দেখবে, সামগ্রিক জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় তাদের ভাবনার সুযোগ নেই। জনস্বাস্থ্য কর্মী-বাহিনী চোখে পড়ে না সেভাবে। ডেঙ্গুসহ নানান নির্দিষ্ট রোগভিত্তিক কর্মসূচির মধ্যে আটকে আছে সিটি করপোরেশন আর পৌরসভাগুলো। যেসব সমাজবিজ্ঞানী জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেন, তাদের স্থান নেই জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে। স্বাস্থ্য বিভাগের চিকিৎসকরা ব্যস্ত সংগঠন করা নিয়ে, ব্যস্ত বদলির তদবির সামলাতে। চিকিৎসকদের মর্যাদা আর সুবিধাদি নিয়ে চরম অসন্তোষ ডাক্তারদের ভেতর। তাই সুস্বাস্থ্যের সন্ধান যদি করা হয় কেবল চিকিৎসার পথে তবে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে দেশে।

সরকারি স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে অনেক কথা বলা হলেও মানুষ সেখানে যেতে চায়, বিশেষ করে সাধারণ মানুষ। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালের অস্বাস্থ্যকর আচরণ নিয়ে পরিবেশ উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। কারণ, স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে মানুষজনের আবেগের অন্ত নেই। আবেগটা স্বাভাবিক, কারণ প্রশ্নটা জীবন-মৃত্যুর।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ট্রেনের ৪৫ হাজার টিকিট কিনতে দেড় কোটির বেশি হিট
ট্রেনের ৪৫ হাজার টিকিট কিনতে দেড় কোটির বেশি হিট
নোয়াখালীতে সনি স্মার্ট-এর শোরুম উদ্বোধন
নোয়াখালীতে সনি স্মার্ট-এর শোরুম উদ্বোধন
তাইওয়ানে সহায়তা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি যুক্তরাষ্ট্রের
তাইওয়ানে সহায়তা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি যুক্তরাষ্ট্রের
নারীবান্ধব টয়লেট সুবিধা পান না ৯৩ শতাংশ নারী
জরিপের তথ্যনারীবান্ধব টয়লেট সুবিধা পান না ৯৩ শতাংশ নারী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ