(আমি তাকে প্রশ্ন করেছি শুধু। আদিম প্রেমের স্বরে একের পর এক জবাব দিয়েছে সে।
আমি সেই সরলতার অনুবাদ করছি মাত্র। এই কবিতার তিনিই মূলতঃ কবি। সরল কবি জীবন তার।
এখানে আছে সাতদিন তার। শনি রবি সোম এভাবে আবার একটা শনিবারের হাটবার ফিরে এলেই
এই গল্প ফুরিয়ে গেছে। জীবনটা হেটে চলেছে শহরজুড়ে)
রচনাকাল: মধ্য মার্চ থেকে এপ্রিল ২০২০
'আমি মান্দাত থ্যাকা আচ্চি বাপ।
চিনা পারোনি? লগাঁও মান্দা।'
কবিতার মতো স্থায়ী উচ্চারণে আমাকে
বলেছে সে, শুধু চাল আর কাঁচাবাজারের জন্যই
শহরের হাতছানিতে সাড়া দেয়, সাত বছর হয়
এরই মধ্যে সেলাই মেশিন ছেড়ে রিকশার প্যাডেল
গ্রামের কেউ জানে না। জানানো হয় না।
কোথাও ছবি তুলি না আমি।
এমনকি বলি না কাউকে নিজস্ব ডাকনাম
মনেও করি না আজকাল। হাতের রেখা নাই
মুছে গেছে রিকশার হাতলে ঘষতে ঘষতে
এই শুন্যহাতে গ্লাভস পরবো কীভাবে?
আমার জন্য বরাদ্দ নাই আমি জানি।
আমি চাই, দু’মুঠো চাল আর কাঁচাবাজারে
উপচে পড়ুক আমার বাজারের ব্যাগ
আমি তাই মানুষ টানি, মাল টানি
কাঁধে করে এ শহর টানি।
এ শহর ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না।
ছবিও তুলবো না
এ শহরের অলিতে গলিতে ছবি আছে আমার।
থেকে যাবে বহুকাল।
২
এখন নিঃসঙ্গ শহরের চোখে মৃত্যুভীতি স্পষ্ট
উদাসীন গ্রামেও সন্ত্রস্ত জীবন, স্বল্পদৈর্ঘ্য স্বপ্ন
কোথা থেকে কখন উড়ে আসে
ধূলিকণার থেকেও ছোট মারণাস্ত্র
ভ য়। সংক্রমণের ভয়
করোনার থেকেও দ্রুত সংক্রমিত হচ্ছে ভয়
চিরায়ত মৃত্যুভয়, ভেঙে দিচ্ছে অহংকার
ভেঙে দিচ্ছে ধর্মের কাঠিন্য, বর্ণের ভাইরাস
বলে যাচ্ছে অদৃশ্য ভাইরাস, সুপ্ত আছে বহু
তখন কেমন হবে আমাদের পৃথিবী আবার?
করোনা বিরতি শেষে আবার হবে কি বৈষম্যহীন
আমাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট?
মানুষের হাতে হাত রাখবে কি ভালোবাসা
নাকি আঙুলের ফাঁকে লেগে থাকবে
তখনো ভাইরাস?
সন্ধ্যায় আর থাকবে না ভালোবাসার ভীড়-ভাট্টা?
কেমন হবে সেই পৃথিবীর ফটোগ্রাফ?
৩
ঘরে ফিরে যাও হৈ চৈ আড্ডা
ঘরে ফিরে যাও সন্ধ্যার চা
ঘরে ফিরে যাও ফুটপাত
ঘরে ফিরে যাও হাটবার
এখানে এখন লকডাউন
না ঘুমোন জংশন, টার্মিনাল
তোমরা ঘুমাও, শান্তির ঘুম
ব্যাস্ত এয়ারপোর্ট, বিশ্রামে যাও
আকাশ এখন পাখিদের শুধু
ঘরে থাকো আন্তঃনগর
ঘরে থাকো দূরপাল্লা
ক'টাদিন মাটি ছুঁয়ে থাকো
বোয়িং সেভেন থ্রি সেভেন
এখন প্রতিটি মানুষ গৃহবাসে
খোঁজ নিও
কোয়ারেন্টাইন শেষ হলে
প্রতিটি ঘরেই এখন সিজদা
প্রতিটি ঘরই এখন মন্দির
প্রতিটি ঘরই সাদামাটা আশ্রম
ছুটে চলা জীবনের জটিল সম্ভ্রম
আইসোলেশন, আইসোলেশন
ঘরে ফিরে যাও, ফিরে যাও
৪
শহরের অলিতে গলিতে বিরান বৈশাখ
গ্রামগঞ্জে জনশূন্য হাটবার
করুণ মহামারি-দিন! ফিরে যাও
আমাদের ছেড়ে যাও, লোকালয় ছেড়ে যাও
দ্যাখো, চৈত্রের দুপুরের মতো খাঁ খাঁ শহর
কনকনে শীতের রাতের মতো নির্জন রাস্তা
থমকে দাঁড়ানো বটমুল, শান্তি মিছিল নাই,
গান নাই, নাচ নাই। তবু তোমার লজ্জা নাই?
জেঁকে বসে আছো আমাদের পৃথিবীতে।
এখানে আছে প্রাণ, আছে গান। আছে শিশুর হাসি
এদের সকলের দোহাই, করুণ মহামারি-দিন
দূর হও, দূর হয়ে যাও।
৫
আমরা মূলত একা
ফাঁকা সড়কের মতো একা
নদীর মতো একা।
আমরা শহরের মতো একা
ভীড়-ভাট্টা, গায়ে ধাক্কা অথচ
কেউ কাউকে চিনি না
এমনকি একই ফ্লাটে
একই ঘরে একা হয়ে
প্রত্যেকে পৃথক বাস করি
মনে মনে আলাদা থাকি
মূলত একাই তো থাকতে
চেয়েছি। জন্মের পর থেকে
মার কাছ থেকে একা হয়েছি
দূরেই চলে গেছি তো!
বাবার থেকে দূরে।
বোনের থেকে দূরে
ভাইয়ের থেকে দূরে
বন্ধুর থেকে দূরে
সকল অসহায় স্বজনের
থেকে যত দূরে পারা যায়
স্বজনের শরীর থেকে দূরে
তাদের মনে পড়তেই ভেবে নিই
মনে নাই তোমাদের, ভুলে গেছি
তোমাদের সবাইকে ভুলে গেছি
শহরের মতো ভীষণ
একা হয়ে ভালো থাকার
সাধনা করেছি কত!
সহস্র সুযোগ এড়িয়ে
সাধনা করেছি
একা ভালো থাকবো বলে
অথচ
আজও তো একাই আছো
চাইলেও ছোঁয়া পাবে না সেই স্বজনের
নিতান্ত বাধ্য একাকিত্বের মুখোমুখি
এক অদৃশ্যের কবলে কত অসহায়
আমাদের অহং। সামনে সীমানা প্রাচীর
মৃত্যুভয় আর একাকিত্বও অদৃশ্য
উল্টোপিঠে ভালোবাসাও অদৃশ্য
ভেবে দেখো, কে হবে জয়ী?
অদৃশ্য ভালোবাসা না ভয়?
ভালোবাসাকে কখনো
ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না
শুধু ভালোবাসা যায়।
সবাইকে ভালোবাসা যায়।
পাখির মতো ভালোবাসা যায়
ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে চলা যায়
মূলত ততোটা একা নই আমরা
যতটা একা হলে
খাদ্য-শৃঙ্খল ভেঙে পড়ে।
৬
এখনও তাহারাই সামনের সারি
মত-বিনিময় আর ব্যাংকলোন যারা
সে এখনো পিছনে, এখনো পিছনে
শুধু মোটা ভাত, ডাল চেয়েছিলো যে
প্রতি দুপুরে সে নিজেকেই বলে
দু’মুঠোয় চলে দু’বেলা,
না হয় তিনবার ছবি তোলো,
তিনবেলায় যে খেতে চায়
আমার কোলের রাখাল।'
পেছনের সারি এখনও সে
তিন ফসলি জমি ছেড়ে আসা
এখনও তিনবেলা খাদ্য সঞ্চয়হীন
তিনবেলা ছবি, তিনবেলা খাবি?
৭
ছবিগুলো ফিরে আসছে
টাইমলাইনে বর্ষপূর্তি
বছরে বছরে আসবে
মনে পড়ছে বন্দিকালের স্মৃতি
কিন্তু
বেসরকারি স্মৃতিতেও ফিরছে না
কোনো কোনো মৃতদেহের, এতটুকু গন্ধ
এসব ভাবতে ভাবতে আবার সকালের দৌড়
পাড়ার মোড়ে টানানো ছবির ফ্রেম থেকে
কে একজন বেরিয়ে আসছে আমাকে দেখেই
অবাক তাকিয়ে আছি, মনে পড়ছে, পড়ছে না
'চিনা পারিচ্চো? কোইচলাম না? মান্দাত থ্যাকা আচ্চি,
একন এই টাউনই হামার বারি। কুটে যামু বাপ?'