(কবি হারিসুল হক প্রিয়বরেষু)
কলেরার মতো কোনো মহামারি রোগে
এখন আগের মতো আমাদের স্বজনেরা কেউ
এদেশে মরে না আর; অথচ আমার
জন্মের অনেক আগে বাস্তবতা এমন ছিল না:
ভয়ংকর কলেরার মর্মান্তিক শিকারের কত কথা ও কাহিনি
আমার শৈশবে শুনেছি মায়ের কাছে;
কেঁদে কেঁদে প্রায় মা বলতেন, ‘মনুরে!
তোর বড় ভাই মচুকে বাঁচাতে পারিনি—
মায়ের বুকটা খালি করে
অকালেই চলে গেল সন্তান আমার!
তোর ছোট মামা
সবংশে জগৎ সংসারকে বিদায় জানালো;
প্রতি ঘর-বাড়ি থেকে
এমনি আরও কত লোক কত শিশু
কলেরার রোষানলে অকালে মরেছে—
রোগে শোকে না-ভুগেই টুপ করে ঝরে যায়
এক রাতে হাজার জীবন।’
মা বলতেন,
এ বজ্জাত রোগে কেউ যখন আক্রান্ত হতো
তখন অন্যরা বাড়িঘর ছেড়ে
জঙ্গলে আশ্রয় নিতো, জঙ্গলেই ছিল
মানুষের একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়কানন।
তখন উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো
কলেরার চেয়ে মারাত্মক
অন্য কোনো মহামারি, রোগ এ দেশে ছিল না।
আমার মায়ের কাছে শোনা কথা,
এ ভয়ের দাগ ও আতঙ্কের চিরস্থায়ী স্মৃতি
কখনো মুছবে না? কী করে মুছবে!
মা আমার, মা গো!
এখন কোথায় তুমি—কোন শূন্যলোকে অজানায়
অদৃশ্য নদীর জলে ঢেউ ভেঙে ভেঙে ভেসে যাচ্ছো বিরতি বিহীন?
দুর্বিনীত দুঃসময়ে তুমি চলে গেলে
দেখিনি তোমার মৃত মুখ:
আমার প্রায়শ ইচ্ছে করে
এ গায়ের চামড়া কেটে কেটে সেলাই দিয়ে তৈরি করি
তোমার কাফন; আকাশটাকে কফিন বানিয়ে
তোমাকে জড়িয়ে রাখি—পারি না, পারি না...
আমার সমস্ত কষ্ট ভয় বেদনার লেলিহান ছায়া
শূন্যতার ধূ ধূ চরে গুলিবিদ্ধ হরিণীর মতো ছুটছে
জঙ্গলে পালাতে—ছুটছে তো ছুটছে...
কে তাকে থামাতে পারে,
কেউ নেই আমাদের বকুলতলায়?
আছে আছে
দুঃসময়ে রক্তাক্ত পতাকা হাতে
যে এসে আমার পাশে সহাস্যে দাঁড়ায়
সে আমার সহোদরা—ফাতেমা জান্নাত,
প্রসবান্তে আঁতুড়েই যার মৃত্যু:
আমার মায়ের সেই কন্যা-সন্তান হারানো শোকে
আত্মীয়-স্বজন সেদিন বরফ দিয়েছিল,
কিন্তু কলেরায় তার পুত্র, ভাই
মারা গেল যেদিন, সেদিন
কোনো ডাক্তার ছিল না,
ঔষধ বা পথ্য বলে কিছুই ছিল না;
কে তাকে সান্ত্বনা দেয়?
এ যেমন এখন
করোনায় আতঙ্কিত জনপদ সব প্রিয়জন!
কে কাকে সান্ত্বনা দেবে—
কার পাশে কে দাঁড়াবে
শোনাবে আশার কথা,
কে দেখাবে অন্ধকারে আলো?
যখন এসব প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসে বারবার
তখন তাকিয়ে দেখি মেঘ কেটে কেটে
বাইরে ধীরে ধীরে নেমে আসছে রৌদ্রসিঁড়ি;
রৌদ্রের ভেতরে অসীম সাহসে মানবিক শক্তি বুকে
মৃত্যুর বিরুদ্ধে নামে সব ভয় আতঙ্ক উপেক্ষা করে
আমার অনুজ কবি ডাক্তার হারিস—
প্রফেসর হারিসুল হক, আরও আছে এক বীর
মুক্তিযোদ্ধা অগ্রজের তিনকন্যা—নিগার জিনাত নীশা
এরকম হাজার হাজার আমাদের সাহসী সন্তান, ভাই, বন্ধু
রণাঙ্গনে অবিরাম অদম্য আবেগে যুদ্ধ করছে,
আর এই মহাযুদ্ধে সবারই সামনে থেকে নিরলসভাবে
একজন জাতিকে পিতার মতো পথ দেখাচ্ছেন—
যেন অবিকল সেই নির্দেশনা শুনতে পাচ্ছি:
‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো।’