X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

চীন-ভারতের সীমান্ত বিরোধ যে কারণে সহজে মিটবে না

আনিস আলমগীর
৩০ জুন ২০২০, ১৪:১০আপডেট : ৩০ জুন ২০২০, ২০:০৫

আনিস আলমগীর লাদাখের সীমান্ত বিরোধে অস্ত্র ব্যবহার না করার চুক্তি রয়েছে চীন ও ভারতের মধ্যে। দুই দেশের মধ্যে ১৯৯৬ সালের সমঝোতা অনুসারে, ওই এলাকায় কোনও পক্ষই আগ্নেয়াস্ত্র বা বিস্ফোরক বহন করে না। সে কারণে গত ১৫ জুন উভয়ের মধ্যে যে সংঘাত হয়েছে তাতে পাথর ছোড়াছুড়ি আর হাতাহাতি হয়েছে। আর ভারত জানিয়েছে, ২০ জন সৈন্য নিহত হওয়ার পাশাপাশি তাদের ৭৬ জন আহত হয়েছে, তবে চীন তাদের সৈন্য হতাহতের ব্যাপারে কোনও তথ্য জানায়নি।
গত কয়দিন ধরে উভয়ের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলছে আর সৈন্য সরানোর কথাও হয়েছে, কিন্তু সীমান্ত থেকে কেউ সৈন্য সরায়নি বরং রিইনফোর্সমেন্ট হয়েছে এবং সমরাস্ত্রের মজুতও উভয়পক্ষ বাড়িয়েছে। ভারত এখন তার সেনাদের হাতাহাতি পরিহার করে প্রয়োজনে অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। সুতরাং ভবিষ্যতে পুনরায় সীমান্ত সংঘর্ষ হলে ভয়াবহ আকারের হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে। ভারত, চীন ও রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রীরা মস্কোতে সম্প্রতি রাশিয়ার ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে একত্রিত হয়েছিল, কিন্তু রাশিয়া এরমধ্যে কোনও বৈঠকের আয়োজন করেনি। উভয় রাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। রাশিয়া ইচ্ছে করলে বৈঠকের আয়োজন করতে পারতো।

১৯৬২ সালের পরে চীন-ভারতের মধ্যে কোনও নিয়মিত যুদ্ধ হয়নি, কিন্তু বর্তমান লাদাখ সীমান্তে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে যেকোনও পক্ষের সামান্যতম ভুল সিদ্ধান্তের কারণে একটি নিয়মিত যুদ্ধের সূচনা হতে পারে। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, যুদ্ধ হবে না। যুদ্ধ যে হবে না সে কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। অস্ট্রিয়ার যুবরাজের এক ঘটনাকে উপলক্ষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল। ঐতিহাসিকভাবে হিমালয় অঞ্চলের গালওয়ান উপত্যকায় চীন ও ভারত উভয়ের চিহ্নিত কোনও সীমানা নেই। তারা উভয়ে এই অঞ্চলটি তাদের বলে দাবি করে।

লাদাখ একসময় কাশ্মিরের অংশ ছিল। লাদাখের একটা স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব রয়েছে, সেই কারণে লাদাখকে ভারত সরকার কাশ্মির থেকে পৃথক করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করেছে। ৫৯ হাজার ১৪৬ বর্গকিলোমিটার অধ্যুষিত লাদাখে জনবসতি খুবই কম। তিন লাখ মানুষ মাত্র। অর্ধেক মুসলমান আর অর্ধেক লামা বৌদ্ধ। লাদাখের পরেই তিব্বত। তিব্বতের পরেই চীনের জিনজিয়াং প্রদেশ। জিনজিয়াংয়ের উইঘুর মুসলমান নিয়ে চীনের সঙ্গে একটা চলমান বিরোধ আছে। উইঘুর মুসলমানরা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত।

আমেরিকা উইঘুর মুসলমান নিয়ে খেলতে চায়। আমেরিকা সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙে দিতে সমর্থ হয়েছে। এখন সোভিয়েতের পরে দৃশ্যপটে এসেছে চীন। চীনকে ভাঙার পাঁয়তারাও আছে। চীনের উত্থানের পর আমেরিকা তার আটলান্টিকের নৌশক্তি ৬০% প্রশান্ত মহাসাগরে নিয়ে এসেছে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় আমেরিকার মিত্র। ভারতও আমেরিকার মিত্র। ভারতকে শক্তিশালী করতে পারলে আমেরিকারই লাভ। আর এটা হচ্ছে আমেরিকার ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির অংশ। আমেরিকার লক্ষ্য হচ্ছে চীনকে ঘিরে ফেলা, চীনকে ভেঙে ফেলা।

দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের আধিপত্যকে জাপান, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়াকে দিয়ে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ভারতের সামরিক চুক্তি রয়েছে। অস্ট্রেলিয়া ভারতের যেকোনও বিমান ঘাঁটি ব্যবহার করতে পারবে। আবার একই সামরিক চুক্তি আমেরিকার সঙ্গে ভারতের হয়েছে। ভারত আবার ভিয়েতনামের সঙ্গে সামরিক চুক্তি করেছে। ভারত মরিশাসে নৌঘাঁটি স্থাপনের চুক্তি করেছে। দেখা যাচ্ছে, চীনকে লক্ষ করে আমেরিকার ইন্ধনে প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় ধীরে ধীরে উত্তেজনা সৃষ্টি হচ্ছে। আসলে এখনকার লাদাখে চীন-ভারত সীমান্ত বিরোধ তারই একটি অংশ।

আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সৈন্য সমাবেশ ঘটাবে তাদের সেখানকার মিত্রদের প্রয়োজনে। ন্যাটোর সদর দফতর থেকে এই সৈন্য নাকি আনা হবে। ভারত এতদিন পাকিস্তানকে তার প্রতিপক্ষ হিসেবে চিন্তা করতো, কিন্তু নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ভারত এখন চীনকে তার প্রতিপক্ষ স্থির করেছে। নরেন্দ্র মোদি উচ্চাভিলাষী মানুষ। যে কারণে চীন সীমান্তে ভারত যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের কাজ করেছে। ভারতের কোনও কোনও সামরিক অফিসারও ১৯৬২ সালের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার অভিলাষ ব্যক্ত করেছেন।

ভারতের সামরিক শক্তি সামর্থ্য ১৯৬২ সালের পর্যায়ে নেই। চীনেরও একই অবস্থা। উভয় রাষ্ট্র এখন আণবিক শক্তির অধিকারী। আগামী নভেম্বরে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্প কিংবা জো-বাইডেন যে নির্বাচিত হোক, চীনকে সাইজ করার ব্যাপারে কারও কোনও শিথিলতা দেখানোর অবকাশ থাকবে না। আমেরিকা কখনও চাইবে না ক্ষমতার বলয় দক্ষিণ এশিয়ার হাতে চলে আসুক।

চীনের আর্থিক অগ্রগতি জাপান, তাইওয়ান সবারই গাত্রদাহের কারণ হয়েছে। সাংহাইয়ের ইপিজেড থেকে তারা তাদের শিল্প কারখানা সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চীনের ব্যবসাকে প্রতিরোধ করার এই প্রচেষ্টার কারণে চীন তার বাণিজ্য নীতির পুনর্বিন্যাস করবে নিশ্চয়ই। এর সঙ্গে তার সামরিক ব্যবস্থা হয়তো পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন হবে। সুতরাং ব্যবসায়িক সংঘাতের সূচনা হলে তা সামরিক সংঘাতে গড়াবে না এই কথা নিশ্চিতভাবে বলা মুশকিল।

করোনার কারণে বিশ্বকে আর্থিক মন্দার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সুতরাং এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব ব্যবস্থার একটা আমূল পরিবর্তন আসবে। এই পরিবর্তনটা সম্মিলিত প্রচেষ্টার মধ্যে হলে বিশ্ব উপকৃত হতো। কিন্তু কোনও সম্মিলিত প্রচেষ্টার কোনও উদ্যোগ এই পরিবর্তনে আসবে বলে মনে হচ্ছে না। এখানেও একটি সংঘাতের বাতাবরণ তৈরি হতে পারে এবং বিশ্ব পুনরায় দুই ব্লকে বিভক্ত হয়ে থাকবে।

যাই হোক, আমেরিকার দীর্ঘ প্রচেষ্টার ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙেছে। এখন চীনকে ভাঙার উদ্যোগ সফল করতে হলে আমেরিকার ভারতের সহযোগিতা প্রয়োজন। মনে হয় সেই সহযোগিতা প্রদানে ভারত মানসিকভাবে প্রস্তুত। দীর্ঘসময় ভারত চীন সীমান্তে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটাচ্ছে, যা চীন ভালো চোখে দেখার কথা নয়। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে পরাজয়ের পর থেকে ভারত ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ভারতের সে প্রস্তুতি কতটুকু মজবুত ও ব্যাপক, তার কোনও পরীক্ষা চীন কখনও করেনি। এবার লাদাখ সীমান্তে চীন সম্ভবত তা পরীক্ষা করছে। সুতরাং সব মিলিয়ে ভারত-চীন সীমান্তে সংঘাত সহজ বলে মনে হচ্ছে না।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

[email protected]

 

/এসএএস/এমএমজে/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মিয়ানমার-থাই সীমান্তে আবারও বিদ্রোহীদের হামলা, থ্যাইল্যান্ডে পালাচ্ছে মানুষ
মিয়ানমার-থাই সীমান্তে আবারও বিদ্রোহীদের হামলা, থ্যাইল্যান্ডে পালাচ্ছে মানুষ
দেশের ৯ অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির বেশি, পারদ উঠতে পারে আরও
দেশের ৯ অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির বেশি, পারদ উঠতে পারে আরও
ভুয়া অবিবাহিত সনদের মেয়াদ বাড়াতে গিয়ে ধরা পড়লেন এক ব্যক্তি
ভুয়া অবিবাহিত সনদের মেয়াদ বাড়াতে গিয়ে ধরা পড়লেন এক ব্যক্তি
ঢাকায় ‘র‌্যাম্পে হাঁটলো’ উট, ঘোড়া, কুকুরসহ বিভিন্ন পোষা প্রাণী
ঢাকায় ‘র‌্যাম্পে হাঁটলো’ উট, ঘোড়া, কুকুরসহ বিভিন্ন পোষা প্রাণী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ