X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাবরি মসজিদের স্থলে রাম মন্দিরের যাত্রা

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
০৬ আগস্ট ২০২০, ১৪:৫৯আপডেট : ০৬ আগস্ট ২০২০, ১৫:০১

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী নীরদ চন্দ্র চৌধুরী তার লেখায় বলেছেন, ‘একাদশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী জুড়ে প্রাচীন হিন্দু নগরগুলোতে আগ্রাসী মুসলমান বিজেতাদের ধ্বংসলীলা চলে।’ অতিকথন থাকলেও নীরদ চন্দ্র চৌধুরীর এই কথার যে কিছুই যথার্থতা নেই তা নয়। তবে নির্বিচারে ধ্বংসলীলা চলে একথা যথার্থ নয়—তার অনেক নিদর্শন এখনও বিদ্যমান। আমরা দেখেছি মথুরায় কৃষ্ণের মন্দিরের পাশে আওরঙ্গজেব একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। ভারত বিভক্তির পর এলাহাবাদ হাইকোর্ট হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ পরিহার করার জন্য মসজিদ ও মন্দিরটির মাঝখানে প্রাচীর নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। ১৯৫২ সালে নির্মিত সেই প্রাচীর এখনও বিদ্যমান।
মথুরা মন্দিরের শহর। এই শহরের সাড়ে সাত হাজার মন্দির রয়েছে, কিন্তু এলাহাবাদ হাইকোর্টের সিদ্ধান্তের নিরিখে মসজিদটির কোনও ক্ষতি কৃষ্ণ ভক্তরা করেনি। মসজিদটিতে এখনও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কায়েম হয়। ১৯৮৪ সালে মথুরা সফরের সময় দেখেছি চেক লুঙ্গি পরে মাথায় টুপি দিয়ে মুসলমানেরা সেখানে অবাধে হাঁটাচলা করছে। তেমন কোনও ভয় ভীতি আছে বলে মনে হলো না। কৃষ্ণের মন্দিরে কীর্তন হচ্ছে, তার প্রাচীরের অপরদিকে মসজিদে জামাত হচ্ছে, মিলাদ হচ্ছে। কোনও ঝগড়া-বিবাদ নেই দুই পক্ষের মধ্যে। তখন কিন্তু আরএসএস, বজরং দল, শিবসেনা, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ অর্থাৎ সংঘ পরিবার এত সংঘবদ্ধ ছিল না।

অবশ্য গত শতাব্দীর তৃতীয় দশক থেকে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের স্থলে রাম মন্দির ছিল এমন একটি কথা তুলে বাবরি মসজিদের স্থলে রাম মন্দির নির্মাণের দাবি নিয়ে রাম ভক্তরা সোচ্চার হয়। বহু মামলা-মোকদ্দমা হয়েছে, কিন্তু মসজিদের স্থানে আগে মন্দির ছিল তা কখনও রাম ভক্তরা প্রমাণ করতে পারেনি। সর্বশেষ গত ৯ নভেম্বর ২০১৯ সর্বোচ্চ আদালতের রায়েও সেখানে মন্দিরের অস্তিত্ব ছিল দাবি করা হয়নি, তবে সেখানে মন্দির নির্মাণের পক্ষে রায় দিয়েছে।

সেই রায়ের সূত্র ধরে, প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো বাবরি মসজিদের জায়গায়, যেটি ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর হিন্দু মৌলবাদীরা ভেঙে দিয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বুধবার ৫ আগস্ট ২০২০ রাম মন্দির নির্মাণের সূচনা করেছেন। মসজিদ ভাঙার ২৯ বছর পর জাঁকজমকভাবে কাজটি শুরু করতে গিয়ে রামায়ণের পঙ্‌ক্তি দিয়ে মোদি সেখানে তার ভাষণ শুরুই করেন। তিনি বলেন, ‘ভগবান রামের কাজ না করলে আমার শান্তি কীসে হবে?’

ধর্মকে জনপ্রিয়তা লাভের হাতিয়ার হিসেবে রাজনীতিবিদরা ব্যবহার করে থাকেন। বাবরি মসজিদ ছিল সেরকম একটি ব্যাপার। বিজেপি লাল কৃষ্ণ আদভানি, মুরলী মনোহর যোশী, উমা ভারতী বাবরি মসজিদের স্থলে রাম মন্দির ছিল, মুসলমান বিজেতারা তা ধ্বংস করে বাবরি মসজিদ বানিয়েছে, সেই মসজিদ ধ্বংস করে রাম মন্দির বানাতে হবে—এই প্রচারণায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। এই ইস্যুতে জনমত সৃষ্টির জন্য ১৯৯০ সালে লাল কৃষ্ণ আদভানি গুজরাটের সোমনাথ মন্দির থেকে রথযাত্রা শুরু করলেন। কথা ছিল অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ পর্যন্ত রথ যাবে। কিন্তু তার অনেক দূরে থাকতেই বিহার সীমান্তে প্রবেশ করলে তখনকার বিহারের মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ যাদব আদভানিকে গ্রেফতার করেন।

এই ঘটনার পর আদভানি রথ যাত্রার জনসমর্থন কুড়াতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে আর এক কর্মসূচি দিয়ে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর  আদভানি, মুরলী মনোহর যোশী, উমা ভারতীরা বাবরি মসজিদ ভাঙায় সফল হন। তখন কেন্দ্রে ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস আর প্রধানমন্ত্রী ছিল নরসিমা রাও। ইচ্ছে করলে মসজিদ বাঁচাতে পারতো, কারণ মসজিদের অনতিদূরে ফৈজাবাদে সামরিক বাহিনী ছিল। কেন্দ্রে মসজিদ ভাঙার খবর পৌঁছেনি এমন কথা বলে নরসিমা রাও তখন বাঁচতে চেয়েছিলেন। অবশ্য তখন থেকেই উত্তর প্রদেশে কংগ্রেস যে মুসলমানদের সমর্থন হারিয়েছিল তা এখনও ফিরে পায়নি। সেই ঘটনা দিয়ে নরসীমা রাওয়ের রাজনৈতিক মৃত্যু হয়েছে। তাকে বিজেপি নেতাদের থেকেও বড় হিন্দু মৌলবাদী হিসেবে দেখা হতো বলে মরার পর তার লাশ পার্টি অফিসে পর্যন্ত নিতে দেওয়া হয়নি।

বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময়ে রাম মন্দির আন্দোলনের নেতৃত্ব যারা দিয়েছিলেন, সেই লাল কৃষ্ণ আদভানি, মুরলী মনোহর যোশী অথবা উমা ভারতীরা ৫ আগস্ট অযোধ্যায় যাননি। মোদি ছাড়া ভূমিপুজোর কাছাকাছি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রধান মোহন ভগবত এবং উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ সহ অতি বিশিষ্ট কয়েকজন হাজির ছিলেন। মোদির প্রধান হিন্দুত্বাদী লাঠিয়াল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও ছিলেন না। তিনি করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আছেন। অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি রাম মন্দির আন্দোলনের আরেক শরিক মহারাষ্ট্রের শিবসেনা দলের কাউকেও। তারা ভূমিপুজো চলাকালীনই জানান, ‘কর সেবকদের আত্মত্যাগ যারা রাম মন্দিরের ভূমিপুজোর দিনে ভুলে যায়, তাদের ‘রামদ্রোহী’ বলা উচিত।’ উপস্থিত ছিলেন প্রায় তিন দশক ধরে চলতে থাকা রাম মন্দির আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সাধু-সন্তরাও। 

২০০৫ সালে এল কে আদভানি একবার পাকিস্তান সফরে গিয়েছিলেন। তিনি মোহাজের, সিন্ধুর লোক। দেশ বিভক্তির পর ভারতে এসেছিলেন। সেখানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ প্রসঙ্গে বলেছিলেন মসজিদ ভাঙার দিনটি তার জীবনের কৃষ্ণতম দিবস। তিনি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর একটি বক্তৃতা উদ্ধৃত করে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতাকে অসাম্প্রদায়িক নেতা বলেছিলেন। এই নিয়ে ভারতে এলে বিক্ষোভের মধ্যে পড়েছিলেন। সংঘ পরিবারের চাপের মুখেও তিনি তার কথা প্রত্যাহার করেননি। শেষ পর্যন্ত দলের সভাপতির আসনও হারান। রাম মন্দির নির্মাণ নিয়ে এখন আদভানি কী বলছেন জানতে পারিনি।

গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির নির্বাচনি ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি ছিল কাশ্মিরের ৩৭০ ধারা বিলুপ্ত করবে এবং বিশেষ মর্যাদা রোহিত করবে। বিজেপি গত বছর ৫ আগস্ট তা করেছে। বিজেপির দ্বিতীয় প্রতিশ্রুতি ছিল রাম মন্দির নির্মাণ করবে। সেটাও কাশ্মিরের অধিকার হরণের প্রথম বার্ষিকীর দিনে শুরু করেছে তারা। মন্দিরের কাজ শেষ হতে প্রায় সাড়ে তিন বছর সময় লাগবে। কেবল মন্দির নির্মাণেই খরচ পড়বে প্রায় তিনশ’ কোটি রুপি। মন্দিরের আশপাশের অন্যান্য স্থাপনা ও উন্নয়ন কাজে ব্যয় হবে আরও হাজার কোটি রুপি।

অবশ্য সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে মন্দিরের জন্য ৩ কাঠা জায়গা দিয়েছে, মসজিদের জন্য ৫ কাঠা জায়গা দিয়েছে। সরকার মুসলিমদের যে জমি দিতে চাচ্ছে সেটি অযোধ্যার বাইরে। বাবরি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাবরের সেনাপতি মীর বাকী। ভারত সরকারের উচিত ছিল মীর বাকীর সমাধির পাশে একটি দৃষ্টিনন্দন মসজিদ তুলে দেওয়া। এতে মনে হয় হিন্দুদের আবেগকে সম্মান দেওয়ার পাশাপাশি মুসলমানদের আবেগকেও কিছুটা হলেও সম্মান জানানো হতো। বাবরি মসজিদ ধ্বংস করায় ভারতের মুসলমানেরা দুঃখিত হয়েছে তা নয় শুধু, সমগ্র উপমহাদেশের মুসলিম সম্প্রদায় দুঃখিত হয়েছে।

বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, রাম মন্দির নির্মাণ উপলক্ষে সারা দেশেই হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা উৎসব করলেও ভারতের মুসলমানদের অনেকেই দিনটিকে কালো দিবস হিসেবে পালন করছেন–নিজেদের সামাজিক মাধ্যমের প্রোফাইলে কালো রঙ দিয়ে। অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড এক টুইট করে জানিয়েছে, ‘বাবরি মসজিদ একটা মসজিদ ছিল আর থাকবে। আয়া সোফিয়া আমাদের কাছে একটা বড় উদাহরণ।’ ‘অন্যায্য, লজ্জাজনক এবং সংখ্যাগরিষ্ঠকে খুশি করার মতো একটি রায়ের সুযোগ নিয়ে জমির দখল নেওয়া হলেও তার অবস্থান বদলাতে পারবে না কেউ। ভেঙে পড়বেন না। অবস্থা চিরকাল একরকম থাকবে না।’

৫৩৭ সালে নির্মিত গ্রিক অর্থোডক্স চার্চ নানা রূপ বদলে আবার যদি আয়া সোফিয়া নামে মসজিদ রূপে তুরস্কে ফিরে আসতে পারে; ১৫২৭ সালে মন্দির ভেঙে বাবরি মসজিদ তৈরি হয়েছে দাবি করে মসজিদটি ভেঙে সেখানে আবার যদি মন্দির হতে পারে–আরও কয়েক শ’ বছর পরে এটি যে মসজিদ বা জাদুঘর হবে না–সেই গ্যারান্টি কে দিতে পারে!

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক 

[email protected]

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ