X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘তুই দুর্নীতিবাজ’

বিনয় দত্ত
০৯ আগস্ট ২০২০, ১৬:২৭আপডেট : ০৯ আগস্ট ২০২০, ১৬:৪৪

বিনয় দত্ত হ‌ুমায়ূন আহমেদের ‘তুই রাজাকার’ সংলাপটি সর্বাধিক জনপ্রিয় একটি সংলাপ। ভাবুন তো,এটি কি শুধুই সংলাপ? ঠিকই ভেবেছেন। এটি শুধু সংলাপ নয়। এরমধ্যে এমন একটি সত্তার খোঁজ আছে, যে সত্তার কারণে আজকে আমরা স্বাধীন। ক’দিন ধরে এই সংলাপটি খুব মনে পড়ছে। তার কারণ হলো দুর্নীতি।
সৃজনশীল ও সৃষ্টিশীল মাধ্যমে অনুপ্রেরণার বিষয়টি নতুন নয়। কেউ স্বীকার করেন কেউ বিষয়টি এড়িয়ে যান। আমি হ‌ুমায়ূন আহমেদের ‘তুই রাজাকার’ সংলাপের অনুপ্রেরণায় লিখলাম ‘তুই দুর্নীতিবাজ’। এটি নিছক সংলাপ নয়। এরমধ্যে লুকিয়ে আছে টিকে থাকার যুদ্ধ, অস্তিত্বের লড়াইসহ পুরো
বাংলাদেশের দৃশ্যপট। ১৯৭১-২০২০। বঙ্গবন্ধু-শেখ হাসিনা। দুর্নীতি এবং দুর্নীতিবাজ, দুটোই সজীব। ভাবতে বিস্ময় লাগছে। কিন্তু এইটাই বাস্তবতা।
২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫। জাতীয় সংসদ। বঙ্গবন্ধু এক ভাষণে বললেন, ‘করাপশন আমার বাংলার মজদুর করে না। করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ, যারা আজ ওদের টাকা দিয়ে লেখাপড়া করেছি। আজ যেখানে যাবেন, করাপশন দেখবেন- আমাদের রাস্তা খুঁড়তে যান করাপশন, খাদ্য কিনতে যান করাপশন, জিনিস কিনতে যান করাপশন, বিদেশ গেলে টাকার ওপর করাপশন। তারা কারা? আমরা যে পাঁচ পারসেন্ট শিক্ষিত সমাজ, আর আমরাই করি বক্তৃতা।
আমরা লিখি খবরের কাগজে, আমরাই বড়াই করি। আজ আত্মসমালোচনার দিন এসেছে। এসব চলতে পারে না। মানুষকে একদিন মরতে হবে। কবরে যেতে হবে। কিছুই সে নিয়ে যাবে না। তবু মানুষ ভুলে যায়, কী করে এ অন্যায় কাজ করতে পারে? আর এই দুঃখী মানুষ যে রক্ত দিয়েছে, স্বাধীনতা এনেছে, তাদের রক্তে বিদেশ থেকে খাবার আনিয়ে সেই খাবার চুরি করে খাবে, অর্থ আনবো চুরি করে খাবে, টাকা আনবো তা বিদেশে চালান দেবে। বাংলার মাটি থেকে এদের উৎখাত করতে হবে।’ (১৪.৭.২০২০, সমকাল)
২০২০। জাতীয় সংসদ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাদশ জাতীয় সংসদের অষ্টম (বাজেট) অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে বলেন, ‘দুর্নীতির সাথে জড়িত, অনিয়মে জড়িত, আমরা যাকেই পাচ্ছি এবং যেখানেই পাচ্ছি তাকে ধরছি। আর ধরছি বলেই, চোর ধরে যেন চোর হয়ে যাচ্ছি। আমরা ধরি আবার আমাদেরই দোষারোপ করা হয়। এটাই হচ্ছে দুর্ভাগ্য।’ (৯.৭.২০২০, বিটিভি)
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা, দুর্নীতি এবং দুর্নীতিবাজদের রোধ করার জন্য সর্বোচ্চ সজাগ। কিন্তু এরপরও দুর্নীতি থামানো যাচ্ছে না। কারণ, সমস্যাটা মূলে। যেমন, স্বাস্থ্য খাত নিয়ে এখন সবচেয়ে বেশি আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির খবর একে একে প্রকাশিত হচ্ছে। পূর্বতন মন্ত্রী থেকে জাহিদ মালেক, কেউই দুর্নীতি বন্ধ করতে পারছে না। কারণ, নিচের স্তরে যারা আছে তাদের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতাই দুর্নীতি হয়। তারা এমন কঠিন সিন্ডিকেট তৈরি করেছে সেই সিন্ডিকেট কেউই ভাঙতে পারছে না। মন্ত্রী আসছে, মন্ত্রী যাচ্ছে কিন্তু সিন্ডিকেট অক্ষতই রয়ে যাচ্ছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘দুর্নীতি এক হাতে হয় না। এটা ‘উইন-উইন গেম’। এখানে সাধারণত তিনটা পক্ষ থাকে। ঠিকাদারি বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নামে প্রতারক চক্র আছে। তাদের সুরক্ষা দেয় প্রশাসনের একাংশ, যারা কাগজপত্র প্রক্রিয়াজাত করে। তার সাথে যুক্ত হয় আরও উচ্চতর প্রভাবশালী মহল। এর বিভিন্ন দৃষ্টান্ত প্রকাশ পাচ্ছে। (২১.৭.২০২০, বিবিসি)
ড. ইফতেখারুজ্জামানের এই কথা শতভাগ সঠিক। এই কারণেই দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না। দলের প্রধান দুর্নীতি বন্ধের কঠোর ঘোষণা দিলেও এক পক্ষ দুর্নীতিকে মনেপ্রাণে ধারণ করে বসেছে। তারা দেশপ্রেমিক নয়, দুর্নীতিপ্রেমিক।
২.
কারা দুর্নীতি করে? এই প্রশ্নটা সবসময়ের। চলুন দেখি, আসলে কারা দুর্নীতি করে। কার্ডিয়াক সার্জন ডা. সাবরিনা চৌধুরী ও তার স্বামী আরিফ চৌধুরীর প্রতিষ্ঠান জেকেজি হেলথ কেয়ার করোনা ভাইরাসের ভুয়া সনদ সরবরাহ করতো। ডা. সাবরিনা চৌধুরী ও জেকেজি হেলথকেয়ারের প্রধান নির্বাহী আরিফ চৌধুরীকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার শারমিন জাহানের অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনাল সরকারি হাসপাতালে নকল ‘এন-৯৫’ মাস্ক সরবরাহ করার প্রমাণ মিলেছে। নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুর রহমান মাসুদ পাবনার রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পে বালিশকাণ্ডের প্রধান আসামি। সহকারী অধ্যাপক ডা. গণপতি বিশ্বাস, জুনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. মীনাক্ষী চাকমা, প্যাথলজিস্ট ডা. এএইচএম নুরুল ইসলাম ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহুল আলোচিত পর্দা কেলেঙ্কারির প্রধান আসামি। কুড়িগ্রামের ডিসি সুলতানা পারভীনের দুর্নীতির খবর প্রচার করায় তার নির্দেশে সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন ওয়েজ ওনার্স কল্যাণ বোর্ডের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর নূরজাহান আক্তার কয়েকশ কোটি টাকার মালিক। দুর্নীতির মাধ্যমে পুলিশের ডিআইজি মিজানুর রহমান বিশাল সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছিল।

অসংখ্য দুর্নীতিবাজের ভিড়ে কিছু নমুনা মাত্র। এরকম কতশত দুর্নীতিবাজ আছে, যাদের কথা লিখতে গেলে লেখাটি বেশ বড়ই হবে। এদের কথা লিখে শেষ করা গেলেও তাদের দুর্নীতি কিন্তু শেষ হবে না। মেধাবী, স্বল্পশিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা, এমপি- কে নেই এই তালিকায়।
আমার উদ্দেশ্য তালিকা করা নয়। উদ্দেশ্য হলো বিভিন্ন পেশার, বিভিন্ন মনমানসিকতার মানুষ যে দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত হচ্ছে তা দেখানো। এতেই বোঝা যায়, শুধু একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির বা কোনও নির্দিষ্ট গোত্র, বর্ণ বা ধর্মের মানুষ দুর্নীতি করছে তা নয়, সবাই দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত হচ্ছে। এর কারণ হলো ব্যবস্থাপনা বা সিস্টেম।
দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন ভাতা বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এর কারণ তারা যেন আর দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত না হয়। সেই লক্ষ্যে ২০১৫ সালে সরকারি বেতন কাঠামো পুনর্গঠন করে তাদের বেতন ভাতা বাড়ানো হলো। এরপর কি দুর্নীতি কমেছে? না। বরং বেড়েছে। প্রশ্ন হলো, এরা কেন দুর্নীতি করে?
দুর্নীতিটা শুরু হয় মূলত লোভের জন্য। লোভ বড়ই বিচিত্র, এর কোনও সীমা-পরিসীমা নেই, কোনও আকার নেই। বিষয়টা যদি এমন হতো যে, তিনটা বাড়ি হলে আর লোভ করবে না। তাহলে নূরজাহান আক্তার অনেক আগেই থেমে যেত। ঢাকার মিরপুর ও আশুলিয়ায় তিনটি বাড়ি, বেইলি রোড, চামেলীবাগ, মীরবাগ ও কাকরাইলে চারটি আলিশান ফ্ল্যাট, আফতাবনগরে দুটি প্লট, আশুলিয়া ও কুমিল্লার বাঙ্গরা বাজারে কোটি কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে নূরজাহান-সাত্তার দম্পতির। (২৬.৭.২০২০, সমকাল) এ শুধু চুম্বক অংশ। আরও অনেক আছে। নূরজাহান আক্তারের সম্পত্তি দেখেই বোঝা যাচ্ছে লোভের আসলে সীমা নেই। তবে দ্রুত বড়লোক হওয়ার লোভে দুর্নীতে নেমেছিল শারমিন আক্তার। এই কারণে মানুষের জীবনকে গুরুত্ব না দিয়ে নকল মাস্ক সরবরাহ করতে দ্বিধা করেনি।
দুর্নীতি করার আরেকটি বড় কারণ হলো, ক্ষমতা বা প্রভাব।
আরেক শ্রেণির মানুষ দুর্নীতি করে দেখাদেখি। তারা শুরুতেই বড় ধরনের দুর্নীতি করতে পারে না। বালিশকাণ্ড বা পর্দা কেলেঙ্কারি বা কাবিখা’র টাকায় নিজের নামে পুকুর খনন বা ২০ কোটি টাকা খাবারের বিল ধরা বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পে ৫০০ টাকার সেফটি গগলস ৫০০০ টাকা ধরা, ২০০০ টাকার পিপিই’র দাম ৪৭০০ টাকা ধরা ইত্যাদি। এরা এখনও বড় দুর্নীতিবাজ হয়ে উঠতে পারেনি। এরা অন্যদের দেখাদেখি দুর্নীতি শুরু করেছে। ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠছিল কিন্তু তার আগেই তা ধরা পড়ে যায়। নূরজাহানের দুর্নীতির কাছে এরা কিছুই না। এই ছোটখাটো দুর্নীতিবাজদের রোধ করা যেত যদি ব্যবস্থাপনা বা সিস্টেম থেকে দুর্নীতি বন্ধ করা যেত। কিন্তু তা হচ্ছে না, তাই দুর্নীতিও থাকছে, দুর্নীতিবাজও থাকছে।
৩.
২০২১ সালে সুর্বণজয়ন্তী পালন হবে। ১৯৭১ থেকে ২০২০। এরমধ্যে দুর্নীতি বন্ধ হয়নি। আগামীতে বন্ধ হবে এটা ভাবাও ন্যায়সঙ্গত নয়। তবে দুর্নীতি একেবারে বন্ধ করা সম্ভব না হলেও তা নিয়ন্ত্রণ করা যেত।  ছোট থেকে বড় সব দুর্নীতিবাজকে চিহ্নিত করে ‘দুর্নীতিবাজ’ শিরোনামে ছবি দিয়ে সব প্রচারমাধ্যমে একাধিকবার দেখানো হলে লজ্জায় দুর্নীতি থেকে দূরে সরে যেত তারা।
দুর্নীতিবাজদের কঠোর শাস্তি দেওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই। কিন্তু সেই শাস্তি দেওয়াই হয় না। যেমন বিতর্কের মুখে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিজি আবুল কালাম আজাদ পদত্যাগ করেছেন। এখন তিনি যদি কোনও দুর্নীতি করে থাকেন তবে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি। তবেই দুর্নীতি করার সাহস আর কেউ পাবে না।

নৈতিক শিক্ষা সবচেয়ে বেশি জরুরি। শিশু শ্রেণি থেকে নৈতিক শিক্ষা বা মূল্যবোধের বিষয় জোর দিয়ে পড়ানো উচিত। ধর্মীয় শিক্ষাও থাকবে তবে নৈতিক শিক্ষায় অনেক বেশি জোর দিতে হবে। তাতে শিশুদের মনে নৈতিক মূল্যবোধের বিষয়টি গেঁথে যাবে।
সবশেষ জরুরি বিষয় হলো, দুর্নীতিবাজদের পরিবারে তাদের দুর্নীতি সম্পর্কে অবহিত করা। স্ত্রী, স্বামী, বাবা, মা, ছেলে, মেয়েসহ সব আত্মীয়-স্বজনের দুর্নীতিবাজের মুখোমুখি করে তা জানানো এবং দেখানো। এই লজ্জা দেওয়া চলতে থাকলে মানুষ আপনাআপনি দুর্নীতি বন্ধ করে দেবে। এখন জরুরি হলো, প্রশাসন এসব বিষয় শুনবে, নাকি শোনার ভান করবে। তবে আমার মনে হয় এই প্রক্রিয়াগুলো প্রশাসন থেকে না করলেও মেধাবী তরুণরা এসব যেকোনও সময় শুরু করে দেবে। তখন প্রতিটা দুর্নীতিবাজের ছবির ওপর লেখা থাকবে ‘তুই দুর্নীতিবাজ’।  ছবিসহ সেই পোস্টার সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে। তাতে লেখা থাকবে দুর্নীতির বিবরণ।
সেদিন বেশি দূরে নয়।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কুকি চিনকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা: নুর
কুকি চিনকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা: নুর
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
কান উৎসব ২০২৪১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, সিপিআই-এম ইন্ডিয়া জোট নয়, বিজেপির এজেন্ট: মমতা
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, সিপিআই-এম ইন্ডিয়া জোট নয়, বিজেপির এজেন্ট: মমতা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ