X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

কার প্রভাবে হাসপাতালে অভিযান বন্ধ?

আমীন আল রশীদ
১০ আগস্ট ২০২০, ১৬:১৪আপডেট : ১০ আগস্ট ২০২০, ১৬:১৫

আমীন আল রশীদ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান পরিচালনা করতে হলে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এরকম একটি নির্দেশনা নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। একজন সিনিয়র সহকারী সচিবের সই করা ওই বিজ্ঞপ্তিতে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে অভিযান পরিচালনা থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ এবং চিকিৎসা শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে জরুরি অভিযান পরিচালনা করা যাবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।
প্রশ্ন হলো, এই ‘জরুরি’ কে নির্ধারণ করবেন? ধরা যাক, র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট গণমাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়ায় জনপ্রতিক্রিয়া দেখে কোনও একটি হাসপাতালে অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিলেন। তখন তাকে যদি স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ এবং চিকিৎসা শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সঙ্গে পরামর্শ ও সমন্বয় করে কাজটি করতে হয়, সেই সমন্বয়ের প্রক্রিয়াটি কী হবে; কত সময় লাগবে; এই প্রক্রিয়া সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জেনে গেলে তারা অভিযান বন্ধের জন্য যে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবে না—তার নিশ্চয়তা কী? এসব ঘটনা যে ঘটবে, তা এই বিজ্ঞপ্তিতেই স্পষ্ট। কারণ কোনও মহলের প্রভাবে মন্ত্রণালয় এরকম একটি বিজ্ঞপ্তি বা নির্দেশনা জারি করেছে, সেটি আন্দাজ করা দুরূহ নয়। 

সরকারের ভেতরেও যে ‘সরকার’ আছে এবং তারা যে কত শক্তিশালী, তা জনগণ মাঝেমধ্যেই টের পায়। হাসপাতালে অভিযান বন্ধের এই সিদ্ধান্তটিও সেই প্রক্রিয়ারই অংশ বলে মনে হয়।

প্রশ্ন উঠেছে, অভিযান চালানোর আগে যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি বা পরামর্শ নিতে হতো, তাহলে করোনার নমুনা পরীক্ষায় প্রতারণার অভিযোগে রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো. সাহেদ বা জিকেজির মালিক ডা. সাবরিনা ও তার স্বামী আরিফ চৌধুরীকে গ্রেফতার করা কি আদৌ সম্ভব হতো? নাকি তাদের মতো লোকেরা ফেঁসে গেছেন এবং তাদের মতো আরও কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি ফেঁসে যেতে পারেন বলে তারা সরকারকে চাপ দিয়ে অভিযান বন্ধের এই নির্দেশনা জারি করিয়েছেন? যদি তাই হয়, তাহলে কি বিষয়টা এরকম দাঁড়াচ্ছে, হাসপাতালগুলো যা খুশি তা-ই করতে পারবে; চিকিৎসার নামে মানুষের গলা কাটবে; সাত লাখ টাকা বিল করেও উলঙ্গ অবস্থায় মরদেহ বুঝিয়ে দেবে (একশো টাকার কাফনের কাপড়ও দেবে না); মৃত ব্যক্তিকে আইসিইউতে রেখে অস্বাভাবিক বিল করবে; তিরিশ মিনিট অক্সিজেন দিয়ে ৫০ হাজার টাকা বিল করবে; ডাক্তার একবারের জন্য রোগী না দেখলেও ২০ হাজার টাকা কনসালট্যান্সি ফি আদায় করবে; পয়সার বিনিময়ে করোনার ভুয়া সার্টিফিকেট দেবে; নমুনা পরীক্ষা ছাড়াই মনগড়া রিপোর্ট দিয়ে দেবে–অথচ হাসপাতালে অভিযান পরিচালনা করা যাবে না? তার মানে কি এই যে, হাসপাতালগুলো সব ধরনের জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে থাকবে? তারা যা খুশি তা-ই করবে, অথচ কেউ কিছু বলতে পারবে না? সরকারের এই নির্দেশনা কি ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়?

সরকার কেন এরকম একটি নির্দেশনা জারি করলো তার কিছুটা উত্তর মিলবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওই নির্দেশনায়–যেখানে বলা হয়েছে, হাসপাতালে একাধিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান পরিচালনা করাতে তাদের স্বাভাবিক চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এই কারণে স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানসমূহে এক ধরনের চাপা অসন্তোষ বিরাজ করছে। এই বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রীর আলোচনা হয়েছে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।

এখানে দুটি বিষয় খুব স্পষ্ট, অভিযুক্ত হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করায় সেখানে চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে এবং সঙ্গত কারণেই সেখানের মালিক ও কর্মীদের মধ্যে চাপা অসন্তোষ বিরাজ করছে।

প্রশ্ন হলো, সব হাসপাতালে তো অভিযান হয়নি; যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, গণমাধ্যমে রিপোর্ট হয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় লোকজন নিজেদের তিক্ত অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন, সেখানে অভিযান পরিচালিত হয়েছে এবং এটিই স্বাভাবিক। আর যেখানে অভিযান হবে, সেখানের কার্যক্রম ব্যাহত হবেই। প্রতিষ্ঠানে কথিত চাপা অসন্তোষ বিরাজ করবে–এই অজুহাতে কি অভিযান বন্ধ করে দিতে হবে? চোরদের অসুবিধা হবে বলে পুলিশ কি কাল থেকে চোর ধরা বন্ধ করে দেবে? 

সরকার যে নির্দেশনা জারি করলো, তাতে বিশেষ করে বেসরকারি হাসপাতালগুলো (যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই) কি আরও বেশি বেপরোয়া হওয়ার সুযোগ পাবে না? এই নির্দেশনা কি তাদের যা খুশি তা-ই করার লাইসেন্স? র‌্যাব যেখানে একাধিক হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে অনেক অনিয়মের সন্ধান পেয়েছে; যা অন্যান্য হাসপাতালগুলোকেও একধরনের ভয়ের মধ্যে রেখেছে; র‌্যাবের যে অভিযান প্রশংসিত হয়েছে এবং সাধারণ মানুষও যেখানে চায় এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকুক, সেখানে কার বা কাদের স্বার্থে এই অভিযান বন্ধের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, সে প্রশ্নও জনমনে রয়েছে। কেউ নির্যাতন বা অন্যায়ের শিকার হবেন, অথচ তার বিচার পাবেন না–রাষ্ট্র এরকম জনবিরোধী নির্দেশনা জারি করতে পারে কিনা, সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকে এমন প্রশ্নও তুলেছেন।

প্রসঙ্গত, হাসপাতালে অভিযান বন্ধ রাখার এই নির্দেশনার আগের দিন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের পূর্ব অনুমতি ছাড়া গণমাধ্যমে অধিদফতরের কর্মকর্তাদের কথা বলার ওপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। গত ৪ আগস্ট পাঠানো ওই নির্দেশনায় বলা হয়, বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে স্বাস্থ্য বিভাগের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা মুখপাত্র হিসেবে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন এবং অধিদফতরের প্রতিনিধিত্ব করেন। নিয়মিত ব্রিফিং ছাড়াও এই সকল বক্তব্য ও মন্তব্যের কারণে অনেক সময় সরকারকে বিব্রত হতে হয়। তাই স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে ব্রিফিং ও সাক্ষাৎকার প্রদান বা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের বিষয়ে মহাপরিচালকের পূর্বানুমোদন নিতে হবে। অংশগ্রহণকারীকে ন্যূনতম পরিচালক পদমর্যাদার হতে হবে বলেও উল্লেখ করা হয়।

এর আগে গত এপ্রিলেও এরকম একটি নির্দেশনার কথা জানিয়েছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। গণমাধ্যমে নার্সদের কথা বলতে বারণের পর কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদেরও কোনও বিবৃতি না দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। উল্লেখ্য, করোনা চিকিৎসায় ভিআইপিদের জন্য ঢাকার শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল প্রস্তুত হচ্ছে বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে সমালোচনার মুখে পড়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সেই খবর নাকচ করে দেন এবং কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোনও ধরনের বিবৃতি না দিতে বা গণমাধ্যমে কথা না বলতে কর্মীদের আহ্বান জানান।

মূলত করোনার প্রকোপ শুরুর পর থেকেই দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা ও অব্যবস্থাপনাগুলো একে একে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। কিন্তু গণমাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতরের কিছু কর্মকর্তার বক্তব্যে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো ফুটে উঠতে থাকলে তাদের মুখ বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়–যাতে সব সত্য প্রকাশিত না হয়। বাস্তবতা হলো, সবাই মুখ বন্ধ রাখলেও সব সত্য গোপন করে রাখা যায় না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মুখ বন্ধ রাখলে টেলিভিশনের সাংবাদিকদের জন্য কিছুটা অসুবিধা হয় বটে, কিন্তু সংবাদপত্র বা অনলাইন পোর্টালের জন্য খুব অসুবিধা হয় না। কারণ অফ দ্য রেকর্ডে তারা অনেক তথ্য পেয়ে যায়। অর্থাৎ কারও নাম প্রকাশ না করেই সংবাদপত্র অনেক বড় সংবাদ প্রকাশ করতে পারে। তবে এটা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের সূত্রের শক্তির ওপরে।  

চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়া বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে চাপা অসন্তোষের অজুহাতে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে অভিযান বন্ধের যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সেখানে আরেকটি বিষয় স্পষ্ট, এ পর্যন্ত যতগুলো অন্যায় ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে বা প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে, সেসব ঘটনার সঙ্গে কিছু সরকারি কর্মকর্তা এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতার (তিনি পুরনো বা অনুপ্রবেশকারী যা-ই হোন না কেন) সংশ্লিষ্টতা রয়েছে–যা প্রকারান্তরে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। প্রশ্ন হলো, এটিও এই নির্দেশনার পেছনে কোনও ভূমিকা রেখেছে কিনা? অন্যভাবে দেখলে এটা সরকারের জন্য ইতিবাচকও। কারণ এসব অভিযানে এটা প্রমাণ করা গেছে বা সরকার এটি বলতে পারছে, ক্ষমতাসীন দলের নেতাদেরও সরকার ছাড় দিচ্ছে না। এটি ক্ষমতাসীন দলের অন্য অপরাধীদের জন্য একটি কঠোর বার্তা হিসেবেও দেখা যেতে পারে। 

করোনার প্রকোপ শুরুর পর স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরই নিজের কঠোর অবস্থানের কথা ঘোষণা করেছেন। বিতর্কের মুখে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদের পদত্যাগ তার একটি বড় উদাহরণ। কিন্তু এটিও নির্মম সত্য, রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী চাইলেও সব সময় সব সিন্ডিকেট ভাঙা কঠিন। তবে যত কঠিনই হোক, জনস্বাস্থ্যই যেখানে মূল প্রশ্ন, সেখানে এই কঠিন কাজটিও নির্মমভাবে করা দরকার–তাতে সরকারের যত ঘনিষ্ঠ লোকজনই অন্যায় ও জনবিরোধী কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকুক না কেন, তাদের ব্যাপারে শূন্য সহনশীল (জিরো টলারেন্স) নীতি গ্রহণ করাই কাম্য। তাতে সরকার ও দল থেকে কিছু আগাছা ঝরে পড়ার পাশাপাশি সরকারের জনপ্রিয়তাও বাড়বে।     

লেখক: সাংবাদিক।

 

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করার বিকল্প নেই
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করার বিকল্প নেই
জনগণ এনডিএ জোটকে একচেটিয়া ভোট দিয়েছে: মোদি
জনগণ এনডিএ জোটকে একচেটিয়া ভোট দিয়েছে: মোদি
সোনার দাম কমেছে, আজ থেকেই কার্যকর
সোনার দাম কমেছে, আজ থেকেই কার্যকর
অতিরিক্ত মদপানে লেগুনাচালকের মৃত্যু
অতিরিক্ত মদপানে লেগুনাচালকের মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ