X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

আত্মঘাতী প্রয়াস

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
১২ আগস্ট ২০২০, ১৫:৩০আপডেট : ১২ আগস্ট ২০২০, ১৫:৪৬

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যার পর পুলিশের ভাবমূর্তি অনেকটা করোনা পূর্ববর্তী পর্যায়ে ফিরে গেছে। গত কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন মহল থেকে পুলিশের ‘অনুভূতিহীন’ ব্যবহারের কথা বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে পুলিশের আরও মানবিক হওয়া প্রয়োজন। প্রশ্ন উঠছে, পুলিশ সদস্যরা কবে মানুষের পুলিশ হয়ে উঠবেন?
প্রথমেই বলে রাখার দরকার, পুলিশ এ সমাজেরই অংশ। সমাজ ও রাষ্ট্রের ভালো-মন্দ তাকে স্পর্শ করে। ১৮৬১ সালের উপনিবেশ সময়ের আইন দ্বারা পরিচালিত হয়ে, তুমুল কাঠামোবদ্ধভাবে পরিচালিত পুলিশ যতটা বাহিনী হয়েছে, ততটা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হতে পারেনি। তাই এর দায় কেবলই পুলিশের—একথা বলা যাবে  না।
আসলে এই যে পুলিশের হৃদয়হীনতার কথা বলা হচ্ছে, সমাজের নানা স্তরে তা নিয়ে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে, এসব কিন্তু আজকের বিষয় নয়। আচমকাই পুলিশের একাংশ অনুভূতিহীন হয়ে পড়লো, ওসি প্রদীপরাই সব, তারা সবাই নিজেদের অতি ক্ষমতাবান বলে ভাবতে শিখেছেন, ব্যাপারটা সে রকম নয়। সাবেক সেনা কর্মকর্তা হত্যার ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে, কে কতটুকু জড়িত, কার কী ভূমিকা, সব আস্তে আস্তে বেরোবে। 

সিনহা রাশেদ হত্যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ঘটনা। ক্ষোভে মানুষ নানা কথা বলছে। সবাই বিচার চায়। নাগরিক সমাজ স্বভাবতই শোরগোল তুলেছে। আমি মনে করি খারাপ ঘটনা অনেক সময় ভালো কিছু করার সুযোগ সৃষ্টি করে। প্রথমেই নীতিনির্ধারকদের ভাবনার জগতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন যে, মাদক, সন্ত্রাসসহ ভয়ংকর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বন্দুকযুদ্ধ সমাধান কিনা। ২০০২ সালে ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ নাম দিয়ে খেলাটা শুরু করেছিল জামায়াত-বিএনপি সরকার এবং এসব কাজের জন্য ‘খেলোয়াড়দের’ ইনডেমনিটি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছিল। 

কথিত বন্দুকযুদ্ধ নিয়ে পুলিশ বা র‌্যাবের বক্তব্যই প্রচার করে চলেছে বাংলাদেশের মিডিয়া। একজন পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় কীভাবে তার কাছে অস্ত্র আসতে পারে বা অভিযুক্তকে সঙ্গে নিয়ে কেন অস্ত্রের খোঁজে যেতে হবে, কিংবা দলের একজন ধরা পড়েছে এটা জানার পরেও সহযোগীরা গা ঢাকা না দিয়ে কেন পুরনো আস্তানায় থাকবে—এসব নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন জনমনে। কিন্তু সেগুলো যাচ্ছে না। 

এই ঘটনাই যেন বাংলাদেশের শেষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয় এমন দাবি করেছেন নিহত সেনা কর্মকর্তা রাশেদ সিনহার মা নাসিমা আক্তার। এই ভাবনাটাই বড় জায়গা পাক আমাদের সবার আলোচনায়, ভাবনায় আসুক পুলিশের সংস্কার প্রসঙ্গটিও। 

বহু বছর ধরে দেশে পুলিশ বিভাগের সংস্কারের কথা চলছে। একের পর এক কমিশন গঠিত হয়েছে, প্রকল্প হয়েছে। বহু রিপোর্টে ধুলো জমেছে। কিন্তু কাজ হয়নি। বিচার পাওয়া মানুষের মৌলিক অধিকার, সেখানে পুলিশি তদন্ত, রিপোর্ট বড় ভূমিকা রাখে। ফৌজদারি মামলার তদন্তের দায়িত্ব পুলিশের। তাই ফৌজদারি বিচার প্রক্রিয়ার সংস্কারের ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। ফৌজদারি তদন্তবিধি অনুসারে পুলিশ অনুসন্ধান করে দুই ধরনের রিপোর্ট পেশ করতে পারে, হয় বলতে পারে, যার বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে, তিনি কোনও অপরাধ করেননি; অথবা পুলিশ চার্জশিট দিতে পারে। কিন্তু আমরা দেখছি লাখ লাখ মামলা রয়েছে যেগুলোর পুলিশি তদন্ত শেষ হচ্ছে না বছরের পর বছর। 

পুলিশের বিরুদ্ধে বড় কোনও অভিযোগ উঠলে, বা প্রতি বছর পুলিশ সপ্তাহ এলে পুলিশ সংস্কারের প্রসঙ্গটি উচ্চারিত হয়। পুলিশ সংস্কারের জন্য প্রস্তাবিত ‘বাংলাদেশ পুলিশ অধ্যাদেশ-২০০৭’ আজও আলোর মুখ দেখেনি। সেই অধ্যাদেশটি বিচার বিশ্লেষণ করে, পরিবর্তন, পরিমার্জন করে হলেও বিবেচনা করা প্রয়োজন বলে বলছেন অনেক সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা।  

পুলিশের সংস্কার সময়ের দাবি। এই বাহিনীতে কর্মী সংখ্যা কত হওয়া প্রয়োজন, কর্মী-নিয়োগ, তাদের প্রশিক্ষণের পদ্ধতি কী হবে, এবং সেই বাহিনীতে কী ধরনের শৃঙ্খলা প্রয়োজন; কী ধরনের অস্ত্র, এবং আনুষঙ্গিক রসদ প্রয়োজন, আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্বের থেকে তদন্তের দায়িত্বকে কীভাবে পৃথক রাখা হবে, পুলিশের হাতে কতখানি ক্ষমতা থাকবে এবং তার কর্তব্য কী হবে, কীভাবে নথি বজায় রাখা হবে, কীভাবে বাহিনীর অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির মোকাবিলা করা হবে এবং পুলিশের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক কী হবে—এরকম বহু প্রশ্নের উত্তর স্বচ্ছভাবে মানুষের সামনে তুলে ধরা দরকার। সরকারের বহু বিভাগ, সংস্থা, বাহিনী আছে, কিন্তু পুলিশকে অনেক বেশি কাজ করতে হয় মানুষের মাঝে, ফলে তার কাজ দৃশ্যমানও বেশি। সে কারণেই যুগোপযোগী হওয়া দরকার এমন দৃশ্যমান একটি বাহিনীর আইন ও বিধি। 

দেশের প্রতিটি মানুষের বিচার চাওয়ার অধিকার আছে, এটা হলো একাডেমিক কথা। আর বাস্তব প্রত্যাশা হলো বিচার পাওয়া যায়। যদি যথার্থ বিচার না-ই পাওয়া যায়, তবে বিচার চাওয়ার অধিকার থেকে লাভ কী? সেই বিবেচনা থেকেই পরিবর্তনের ভাবনা প্রয়োজন। সমাজ বদলাচ্ছে, পরিবর্তন হচ্ছে মানুষের জীবন। পাল্টাচ্ছে অপরাধের ধরন। যথাযথভাবে সঠিক সময়ে পুলিশের সংস্কার না করা হলে জনগণের সঙ্গে পুলিশের দূরত্ব তৈরি হবে। ফলে পুলিশকে জনমুখী ও জনবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে  পুলিশের যেটুকু বিশ্বাসযোগ্যতা জনমানসে থাকলেও থাকতে পারে, ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের মতো ঘোরতর অভিযোগ, কোন কোন সদস্যের নিষ্ঠুরতা ও দুর্নীতি যেন সেটুকু খোয়াতে তাদের নিজেদেরই আত্মঘাতী প্রয়াস। মানুষ বলছে, একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা না হলে কক্সবাজারের ঘটনা নিয়ে কোনও আলোচনাই হতো না। সমাজের এমন ভাবনা আসলে আইনের শাসনের সার্বিক সংকট।

লেখক: সাংবাদিক 

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
লোকসভা নির্বাচন: মণিপুরে ভোটকেন্দ্রে সংঘর্ষ
লোকসভা নির্বাচন: মণিপুরে ভোটকেন্দ্রে সংঘর্ষ
ওঠানামা করছে মুরগির দাম, বাড়ছে সবজির
ওঠানামা করছে মুরগির দাম, বাড়ছে সবজির
শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে
শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ