X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

রবীন্দ্রনাথ, একজন অধ্যাপক এবং একটি লিগ্যাল নোটিশ

আমীন আল রশীদ
৩০ আগস্ট ২০২০, ১৬:২৮আপডেট : ৩০ আগস্ট ২০২০, ১৬:৩০

আমীন আল রশীদ আপনি আমার সব মতের সঙ্গে একমত হবেন না—এটিই স্বাভাবিক;এটিই গণতন্ত্র। কোটি কোটি মানুষের ভিন্ন ভিন্ন মতামতকে ধারণ করেই পৃথিবী এগিয়ে যায়। সবাই সব বিষয়ে একমত হলে পৃথিবীতে বৈচিত্র্য থাকতো না। আবার আপনি একজনের কোনও মত বা ধারণার সঙ্গে একমত না হলে সেটি প্রকাশের ভদ্রোচিত এবং মার্জিত ভাষা রয়েছে, তরিকা রয়েছে। আপনাকে কেউ অহেতুক গালি দিলে আপনি কীভাবে তার প্রতিবাদ বা মোকাবিলা করবেন—সেটি নির্ভর করে আপনার শিক্ষা-রুচি-বেড়ে ওঠা তথা সামগ্রিকভাবে আপনার বিচার-বিবেচনার ওপর। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একজন অধ্যাপকের লেখা আপনার পছন্দ নয় বলে আপনি উকিল নোটিশ পাঠাবেন—এটি শুধু ধৃষ্টতাই নয়, বরং হাস্যকরও। পত্রিকায় প্রকাশিত একজন লেখকের লেখা পছন্দ না হলে পত্রিকায় পাল্টা আরেকটি বা প্রয়োজনে আরও অধিক লেখা যেতে পারে। যদি লেখাটি সুনির্দিষ্টভাবে কোনও ব্যক্তির জন্য মানহানিকর বা ক্ষতির কারণ হয়, তাহলে তার আইনি প্রতিকার চাওয়ারও অবকাশ রয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একজন অধ্যাপকের লেখা পছন্দ হয়নি বলে উকিল নোটিশ পাঠানো হয়েছে—এমন দৃশ্যও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর ঠিক আগের বছরে এসে বাংলাদেশের মানুষকে দেখতে হলো।

এ ঘটনাকে ‘বিচ্ছিন্ন’ বলে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, যখন সোশ্যাল মিডিয়া বা গণমাধ্যমে কারও কোনও মতামত বা বক্তব্য পছন্দ না হলেই গণহারে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ঠুকে দেওয়ার যে ভয়াবহ প্রবণতা শুরু হয়েছে, এই উকিল নোটিশ সেই ধারাবাহিকতারই অংশ। সুতরাং রবীন্দ্রনাথের অপরিহার্যতা নিয়ে লেখার কারণে একজন অধ্যাপককে যে কেবল একটি উকিল নোটিশ পাঠানোর বাইরে আর কিছু করা হয়নি, অর্থাৎ তার বিরুদ্ধে যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়নি এবং ওই অধ্যাপক যে এখনও গ্রেফতার হননি– সেটিই বরং স্বস্তির।
প্রসঙ্গত, গত ৭ আগস্ট দৈনিক যুগান্তরে ‘রবীন্দ্রনাথ কেন জরুরি’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও লেখক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। যেখানে এই সময়ে কেন রবীন্দ্রনাথ আমাদের জন্য জরুরি– তিনি তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। অধ্যাপক চৌধুরী লিখেছেন, ‘বাঙালির ঐক্য ও মুক্তি তিনি সর্বতোভাবে কামনা করেছেন; সে জন্য সাম্প্রদায়িকতা তো অবশ্যই শ্রেণিদূরত্বও ঘোচাতে চেয়েছেন। পারেননি। সে-ব্যর্থতা তার নয়। তার দেশবাসীর। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন যে সমাজে একটি নয়, দুটি সম্প্রদায় রয়েছে। মুসলমানরা পিছিয়ে আছে বটে, কিন্তু তাদের বিবেচনার মধ্যে না আনলে সমস্যার সমাধান তো হবেই না, সমস্যা প্রবল থেকে প্রবলতর হবে, এবং তা হয়েছেও, হয়ে বঙ্গভূমিকে দুই টুকরো করে ফেলেছে। মধ্যখানে নদী নেই, নদী যাচ্ছে শুকিয়ে, যাতে প্রবলতর হচ্ছে দূরত্ব।’
প্রবন্ধের একটি জায়গা তিনি লিখেছেন, ‘অনেক কারণেই রবীন্দ্রনাথ আমাদের জন্য জরুরি, এবং জরুরি থাকবেন। আমরা তাকে নিয়ে গর্ব করবো, তার পরিচয়ে নিজেদের পরিচয় দেওয়া অব্যাহত রাখবো।’ কিন্তু অধ্যাপক চৌধুরীর এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত না হয়ে একটি উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন দৈনিক আল ইহসান ও মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকার সম্পাদক মুহম্মদ মাহবুব আলম। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শেখ ওমর শরীফ স্বাক্ষরিত ওই নোটিশটি পাঠানো হয় ১৬ আগস্ট। আগেই বলা হয়েছে, একজন লেখকের সব বক্তব্যের সঙ্গে পাঠক একমত নাও হতে পারেন। এমনকি কোনও কোনও বক্তব্য পাঠককে ক্ষুব্ধ ও মর্মাহতও করতে পারে। কিন্তু সেই ক্ষুব্ধ বা মর্মাহত হওয়ার প্রতিক্রিয়াটি কী হবে? আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়ে একজন পাঠক কোনও একজন লেখককে উকিল নোটিশ পাঠাবেন।
নোটিশে বলা হয়, ‘রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গর্ব করা এবং তার পরিচয়ে নিজেদের পরিচয় দেওয়ার আবদারটি বাস্তবতা বিবর্জিত।’ দেখা যাচ্ছে, এখানে নোটিশদাতা একজন লেখকের মন্তব্যকে ‘আবদার’ হিসেবে বিবেচনা করছেন।

বাঙালি মুসলমানরা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কেন গর্বিতবোধ করবেন– এমন প্রশ্নও তুলেছেন নোটিশদাতা। বাস্তবতা হলো, একজন লেখক বা শিক্ষক তার প্রবন্ধে যদি কোনও মতামত প্রকাশ করেন বা পরামর্শ দেন, সেটি সব পাঠক একবাক্যে গ্রহণ করবেন– এমনটিও নাও হতে পারে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নোটিশদাতা গর্ববোধ করবেন কী করবেন না, সেটি তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে লেখকের এই মতামতকে তিনি ‘আবদার’ হিসেবে উল্লেখ করবেন এবং এই বক্তব্য প্রত্যাহার না করলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেবেন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা ওই প্রবন্ধের বক্তব্যকে নোটিশদাতা ‘অসত্য বিকৃত ও আপত্তিকর’ বলেও মন্তব্য করেছেন। বস্তুত রবীন্দ্রনাথের মতো একজন বিশ্ব নাগরিককে নিয়ে একজন স্বনামধন্য অধ্যাপকের বক্তব্যকে ‘অসত্য বিকৃত ও আপত্তিকর’ বলাটাই বরং আপত্তিকর।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর পক্ষে গত ২৩ আগস্ট এই লিগ্যাল নোটিশের জবাব দেন আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। যেখানে বলা হয়, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী পঁয়ষট্টি বছরের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি করেন এবং সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। কিন্তু লেখালেখির কারণে কখনোই তিনি এরকম আইনি নোটিশ পাননি। জবাবে বলা হয়, ‘উল্লিখিত প্রবন্ধে অধ্যাপক চৌধুরীর নিজস্ব মতামতের প্রতিফলন ঘটেছে, যার পেছনে রয়েছে তাঁর নিজের মতো করে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য পাঠ। এই মত প্রকাশের অধিকার সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত। তাছাড়া অধ্যাপক চৌধুরীর প্রবন্ধে কাউকে অপমান বা হেয় করার কোনও উপদান ছিল না। যদি আইনগত অধিকার ভঙ্গের ব্যাপার না থাকে, তাহলে কোনও বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা লেখকের মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই নয়। নির্দোষ সাহিত্য আলাপের ওপর সংক্ষুব্ধ হয়ে আইনি নোটিশ পাঠানোর ঘটনা বিরল।– অস্বীকার করার উপায় নেই, এ ধরনের উকিল নোটিশ একজন নাগরিকের মত প্রকাশের স্বাধীনতায় কেবল অযাচিত হস্তক্ষেপই নয়, বরং এটি অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতো একজন দেশবরেণ্য ব্যক্তির যে মানসিক পীড়নের কারণ হয়েছে, তার বিরুদ্ধেই বরং এখন আইনি ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

উল্লেখ্য, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে যে দীর্ঘ উকিল নোটিশটি পাঠানো হয়েছে, সেখানে এটি স্পষ্ট যে নোটিশদাতা নিজেও রবীন্দ্রনাথ পড়েছেন এবং সেই আলোকে তিনি বেশ কিছু রেফারেন্স দিয়েছেন। সেক্ষেত্রে তার নোটিশে উল্লিখিত বক্তব্যগুলো নোটিশদাতা নিজের পত্রিকায়, এমনকি যে পত্রিকায় অধ্যাপক চৌধুরীর লেখাটি ছাপা হয়েছে, সেই পত্রিকাতেও ছাপা হতে পারতো এবং এটিই হতো বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা। কিন্তু সেই পথে না গিয়ে নোটিশদাতা আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়ে যে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন, সেখানে বুদ্ধিবৃদ্ধিক দেউলিয়াত্বেরই প্রকাশ ঘটেছে।
প্রশ্ন হলো, নোটিশদাতা বলেছেন বাঙালি মুসলমানরা কেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গর্ব করবেন? তার প্রতি পাল্টা প্রশ্ন এই যে যারা রবীন্দ্রনাথকে খারিজ করে দিতে চান, তারা কি রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘আমার সোনার বাংলা’-কে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে অস্বীকারের সাহস রাখেন বা জাতীয় সংগীত বদলে ফেলতে হবে– এই দাবিতে রাস্তায় নামতে পারবেন? যদি সেই শক্তি ও সাহস তাদের থাকেও, তারপরও দেশের বৃহত্তর শান্তিকামী সাধারণ মানুষ কি এই উদ্ভট দাবির পক্ষে দাঁড়াবে?

পরিশেষে এটুকুই বলার যে আমরা একটি ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীল, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন সংবেদনশীল মানুষের সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন থেকে যেহেতু এখনও ঢের দূরে– সুতরাং এ কারণেই আমাদের জন্য রবীন্দ্রনাথ জরুরি।
রবীন্দ্রনাথ জরুরি বলে মন্তব্য করায় অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে উকিল নোটিশ পাঠানোর ঘটনায় এটি আবারও প্রমাণিত হয়েছে যে রবীন্দ্রনাথ আমাদের জন্য আসলেই কতটা জরুরি।


লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দোকান থেকেই বছরে ২ লাখ কোটি টাকার ভ্যাট আদায় সম্ভব
দোকান থেকেই বছরে ২ লাখ কোটি টাকার ভ্যাট আদায় সম্ভব
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অতীত ফিরিয়ে আনলেন শান্ত-রানারা
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অতীত ফিরিয়ে আনলেন শান্ত-রানারা
হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে করণীয় ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শ জেনে নিন
হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে করণীয় ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শ জেনে নিন
হাতিরঝিলে ভাসমান অবস্থায় যুবকের মরদেহ
হাতিরঝিলে ভাসমান অবস্থায় যুবকের মরদেহ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ