গত মাসের শেষ দিকে উইসকনসনের কেনোশা শহরে জেকব ব্লেক নামে কৃষ্ণাঙ্গ এক তরুণকে একজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তা সাতবার পিঠে গুলি করার পর থেকে সেখানে সহিংস বিক্ষোভ শুরু হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সফর উত্তেজনা আরও উসকে দিতে পারে এ শঙ্কায় ট্রাম্পকে কেনোশায় না যেতে শহরটির ডেমোক্র্যাটিক মেয়র ও উইসকনসিনের ডেমোক্র্যাটিক গভর্নর দুজনই অনুরোধ জানিয়েছিলেন। ট্রাম্প তাদের অনুরোধ তো রক্ষা করেনইনি, উল্টো কেনোশা সফরে গিয়ে শহরটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য কেন্দ্রীয় তহবিল থেকে ১০ লাখ ডলার, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য ৪০ লাখ ডলার এবং উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যজুড়ে জননিরাপত্তায় ৪ কোটি ২০ লাখ ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
তার সফরের কারণে কেনোশায় জাতিগত সংঘাতের তীব্রতা বেড়েছে। বর্ণবাদী বিদ্বেষ নিরসনের ডাক না দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর ভূমিকার প্রতি দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তাদের গুলিতে কৃষ্ণাঙ্গদের মৃত্যু গত কয়েক বছরে অনেক বেশি সংখ্যায় ঘটছে।
বহু জাতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র। যাকে বলা হয় ল্যান্ড অব ড্রিমস, যেখানে গেলে স্বপ্ন পূরণ হয় বলে এতদিন ধারণা করা হতো। যে স্বপ্নে বিভোর হয়ে সারা পৃথিবী থেকে মানুষ সেখানে ছোটেন। দুই-তিন দিন আগে ১০১ বাংলাদেশিকে কাগজপত্র ঠিক নেই বলে পাঠিয়ে দিয়েছে তারা। মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের প্রশ্নে যে দেশটি পুরো বিশ্বকে প্রতিনিয়ত ছবক দেয়, তাদের মানবাধিকার নিয়ে এখন প্রশ্ন তুলছে, এমনকি চীনারাও!
শ্বেতাঙ্গরা আমেরিকান, অন্য বর্ণের যারা আমেরিকায় বসবাস করেন তারা নন-আমেরিকান—এমন একটি মেকি বিভাজন তৈরি করে ট্রাম্প নিজে আমেরিকানদের নেতা সেজে পূর্বের মতো নির্বাচিত হতে চাচ্ছেন।
শ্বেতাঙ্গদের একটা বড় রকমের ভীতি হচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্র গত কয়েক দশকে যেভাবে পরিবর্তিত হয়েছে এবং আগামীতে যেভাবে পরিবর্তিত হবে তাতে শ্বেতাঙ্গরা আসলে সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে। ট্রাম্প এই ইস্যুকে সরাসরি ব্যবহার করছেন।
আমেরিকা অভিবাসীদের রাষ্ট্র। পৃথিবীর প্রায় অঞ্চল থেকে লোক এসে আমেরিকায় বসবাস করেছে। সুতরাং এখানে বিভাজনের রাজনীতি আমেরিকার সর্বনাশ ডেকে আনবে এমনকি ১৮২০ সালের মতো গৃহযুদ্ধের দামামাও বেজে উঠতে পারে। উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের বিশ্লেষকেরা অনুরূপ পরিস্থিতে যে আমেরিকার অবসান হতে পারে তা নিয়ে চরমভাবে উদ্বিগ্ন। পশ্চিমা বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন সাম্রাজ্যের সূর্য ডুবে গেছে। রাষ্ট্রের ভেতর বর্ণবাদ ও দারিদ্র্য সত্ত্বেও বিশ্বনেতৃত্বের করুণ ও ব্যর্থ প্রচেষ্টায় চালাচ্ছে আমেরিকা এবং বিষয়টি তাদের ভালো করে জানা আছে।
আমেরিকার স্থপতিরা ইংরেজিকে রাষ্ট্রভাষা করে ঐক্যের যে বুনিয়াদ স্থাপন করেছিলেন দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে তা দীর্ঘ ২৪৪ বছর টিকে আছে। কিন্তু ট্রাম্প নির্বাচিত হয়েছিলেন বর্ণবাদকে উস্কিয়ে দিয়ে, যা আমেরিকার সংহতি বিনষ্ট হওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। অথচ ট্রাম্পের আগে দুই দুইবার বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে প্রথমবারের মতো। ট্রাম্পের মতো বর্ণবাদী লোক ওবামার পরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত না হলে এ সৌহার্দ্য হয়তো দীর্ঘায়িত হতো।
বর্ণবাদ, উগ্র জাতীয়তাবাদ ও অভিবাসনবিরোধী মনোভাবকে উসকে দেওয়ার জন্য সবার চোখে ট্রাম্প দায়ী। ২০১৬ সালের নির্বাচনেই এটা শুরু করেছেন তিনি। জো বাইডেন একই ইস্যুকে ঠিক উল্টোভাবে ব্যবহার করে অভিবাসী ও কৃষ্ণাঙ্গদের ভোট আকর্ষণের চেষ্টা করছেন। প্রচারণায় জো বাইডেন ট্রাম্পের ব্যর্থতার কথা বলছেন আর ট্রাম্প ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারস’কে সন্ত্রাসী আন্দোলন বলছেন। শান্তি ভঙ্গের যেকোনও আন্দোলনকে নির্মূলের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। সেই সঙ্গে পোস্টাল ব্যালটের জন্য সোচ্চার তার ক্যাম্প। অর্থাৎ বাড়িতে পাঠানো ব্যালট পূরণ করে চিঠিতে ভোট দেওয়ার সুযোগ।
ট্রাম্প পোস্টাল ভোটকে বানচাল করার চেষ্টা করছেন। করোনার কারণে এবার পোস্টাল ভোট বেশি হওয়ার কথা। আর ডেমোক্র্যাটরা এর মাধ্যমে ভোট কারচুপির চেষ্টা করছে বলে সরাসরি অভিযোগ করেছেন ট্রাম্প। ভোটারদের তিনি ডবল ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। পোস্টাল ভোটও দিতে বলেছেন, আবার উপস্থিত থেকেও ভোট দিতে বলছেন। প্রহসনের নির্বাচন যদি ট্রাম্প করতে পারেন তবে হয়তোবা নির্বাচিত হতে পারেন। তিনি সম্ভবত সে চেষ্টা করছেন। হয়তো জিতবেন নয়তো ভোট বানচাল করে দেবেন। ট্রাম্প ক্যাম্পের উসকানি জো বাইডেন কতটা সামাল দিতে পারবেন তা নিয়ে সন্দিহান অনেকে।
ভোটের প্রচারণা যেভাবে চলছে, সবাই এক বাক্যে স্বীকার করছেন, নিকট অতীতে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে উসকানিমূলক আর নোংরামির নির্বাচন হচ্ছে এবছর। প্রচারণার ধরন, ভাষা ও মেজাজে অনেক পরিবর্তন এবারে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্র যখন বর্ণবাদ ও পুলিশি নির্যাতনের মতো ইস্যুগুলোতে দ্বিধাবিভক্ত, ট্রাম্প তখন শ্বেতাঙ্গ সমর্থকদের ঘাঁটিগুলোতে গিয়ে বিভাজনকে আরও স্পষ্ট করার চেষ্টায় আছেন। বিভিন্ন জনমত জরিপেও ডেমোক্র্যাটিক প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের সঙ্গে তার ব্যবধান কমতে দেখা যাচ্ছে।
ট্রাম্পের বিজয়ী হওয়ার মূল প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে গত চার বছরের তার ব্যর্থতা। করোনা নিয়ন্ত্রণে তার উদাসীনতা। দুই লাখের কাছাকাছি আমেরিকার মানুষ করোনায় মারা গেলো, তা সামাল দিতে ট্রাম্প সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। কর্মসংস্থান করতে পারেননি। এতো ব্যর্থতার বোঝা নিয়ে নির্বাচিত হওয়ার প্রত্যাশা করা খুবই কঠিন। কিন্তু নির্বাচনি প্রচারে তিনি বর্ণবাদের ক্ষত এবং করোনা মোকাবিলায় ব্যর্থতার প্রসঙ্গ এড়িয়ে চলছেন।
এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফলাফল কী হতে পারে? ট্রাম্প যদি বর্ণবাদী উসকানিতে সফল হন তবে পুনরায় নির্বাচিত হওয়া বিচিত্র নয়। বিশ্লেষকরা বলছেন জো বাইডেন শেষ পর্যন্ত জিতবেন। তবে জো-বাইডেন যদি হেরে যায় আর ট্রাম্প যদি জিতে যায়, বিশ্বে আমেরিকার মোড়লি পর্ব দ্রুত অবসান হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।