X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ওয়াইসির জিন্নাহ্ হতে চাওয়া আত্মঘাতী হবে

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৬:১১আপডেট : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৬:২৮
বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী আসাদউদ্দীন ওয়াইসি ভারতের মুসলমান সম্প্রদায়ের জনপ্রিয় একজন নেতা। তিনি সর্বভারতীয় মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন দলের প্রেসিডেন্ট। হায়দ্রাবাদ থেকে তিনি তিনবার লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ১৫তম লোকসভায় শ্রেষ্ঠ কৃতিত্বের জন্য ২০১৪ সালে তিনি সংসদ রত্ন পুরস্কার লাভ করেন। সোশ্যাল মিডিয়ায়ও বেশ আলোচিত কোটি কোটি টাকার মালিক ওয়াইসি। তিনি এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রত্যেক নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উত্তর প্রদেশ, হায়দ্রাবাদ অর্থাৎ যেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলমান বসবাস করে সেখানে তার সংগঠনের পক্ষ থেকে নির্বাচনে প্রার্থী দেবেন এবং মুসলমানদের সমর্থন নিয়ে তার প্রার্থীকে জেতানোর চেষ্টা করবেন।
আগামী মাসে বিহারের ২৪৩টি বিধানসভার নির্বাচন। আসাদউদ্দীন ওয়াইসির এমআইএম গতবার সেখানে ছয়টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল, তবে এবার তার অনুসারীদের মতে তারা ৫০টিরও বেশি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সম্ভাবনা রয়েছে। পাটনাতে একটি মিডিয়া কনফারেন্সে ওয়াইসি নিজেও এমনটা ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, তার দল সেখানে একজন প্রান্তিক খেলোয়াড়। তবে, লালুর রাষ্ট্রীয় জনতা দল এবং কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ওয়াইসিকে বলেছে ‘বিজেপির দালাল’। সংখ্যালঘুদের ভোট ভাগ করার জন্য সে প্রার্থী দিচ্ছে। মুসলমানরা বিহারের জনসংখ্যার প্রায় ১৬ শতাংশ। তাদের কয়েকটি বিধানসভা আসনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে এবং কমপক্ষে ৫০টি বিধানসভা আসনের ভাগ্য নির্ধারণ করে মুসলমানেরা।
 
মুসলমানরা ঐতিহ্যগতভাবে কংগ্রেসের ভোটার ছিল, ‍কিন্তু ১৯৮৯ সালে ভাগলপুর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরে লালু প্রসাদ যাদবের প্রতি আনুগত্য শুরু করে। তখন থেকেই যাদবদের সঙ্গে তারা আরজেডির মূল ভোট শক্তি। তবে এখন এমআইএম-এর প্রবেশের সঙ্গে সেই গণনায় পরিবর্তন হতে পারে।
 
২০২১ সালের এপ্রিল-মে মাসে পশ্চিম বাংলার বিধানসভার নির্বাচন। পশ্চিম বাংলায় ত্রিশ শতাংশ মুসলমান। বিহার, উত্তর প্রদেশে, হায়দ্রাবাদেও মুসলমানের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। এতদিন সমস্ত প্রদেশে মুসলমানেরা তাদের বন্ধুভাবাপন্ন স্থানীয় দলগুলোর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করেছে এবং দেখা গেছে মুসলমানদের সমর্থন নিয়ে তারা প্রায় সময় নির্বাচনে জিতে যায় এবং সরকার গঠন করে। উত্তর প্রদেশে মুলায়েম সিং যাদব ও মায়াবতি, বিহারে নিতিশ কুমার ও লালুপ্রসাদ, পশ্চিম বাংলায় মমতা ব্যানার্জী—এরা সংখ্যালঘু মুসলমান ভোটারের সমর্থন দৃঢ়ভাবে প্রত্যাশা করতো এবং সমর্থন নিয়ে বারবার জিতেছেও।
 
২০২১ সালের বিধানসভার নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে সর্বশক্তি নিয়োগ করে তৃণমূল কংগ্রেসের মমতাকে হটিয়ে বিজেপি সরকার গঠনে প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে। বাংলাদেশকে কোনও বিষয়ে চোখ রাঙাতে হলেও পশ্চিম বাংলায় বিজেপির ক্ষমতায় থাকা প্রয়োজন। সুতরাং এবার তারা কঠোরভাবে মাঠে থাকবে পশ্চিম বাংলার ক্ষমতা কব্জা করার ফিকিরে। হেন কোনও অশুভ তৎপরতা বাকি রাখবে না জেতার জন্য। এই তৎপরতায় বাংলাদেশে তাদের এজেন্টদের মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করে দাঙ্গা বাধানোর পরিকল্পনাও তাদের মাথায় আছে। বাংলাদেশের মানুষ এবং সরকারের এ বিষয়ে সতর্ক থাকা দরকার।
 
ভারতের মুসলমানদের এখন কঠিন সময়। সারা বিশ্বে মুসলিম নির্যাতনের কাতারে ইসরায়েলের নেতানিয়াহুর সরকারের সঙ্গে ভারতের নরেন্দ্র মোদির সরকারের নামও উঠেছে। তার সরকার মুসলমানদের নাগরিকত্বহীন করার চেষ্টা করছে, কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন হরণ করেছে। সবকিছুর কারণ ভারতের কেন্দ্রে হিন্দু মৌলবাদী দল বিজেপি ক্ষমতায়। নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহের মতো কট্টর সাম্প্রদায়িক, মুসলিমবিদ্বেষী ব্যক্তিরা সেখানে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। নরেন্দ্র মোদি যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী আর অমিত শাহ তখন সেখানে উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তখনই গুজরাটের নির্মম দাঙ্গা হয় আর কয়েক হাজার মুসলমানকে প্রাণ হারাতে হয়েছিল।

নরেন্দ্র মোদি কিছু দিন আগে ঠাকুর নগরের পূর্ণ ব্রহ্ম শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের ভক্ত ও অনুসারীদের সমাবেশে বক্তৃতা দিয়েছেন। তারা চেষ্টা করছেন তাদের ভোট একতরফাভাবে বিজেপিকে প্রদান করানোর জন্য। হরিচাঁদ ঠাকুরের বাড়ি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানিতে। উভয় বাংলায় তার লাখ লাখ ভক্ত ও অনুসারী রয়েছে। পশ্চিম বাংলায় হরিচাঁদ ঠাকুরের ভক্ত ও অনুসারীদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শান্তানু ঠাকুর। তিনি হরিচাঁদ ঠাকুরের ষষ্ঠতম বংশধর। এখন তিনি ঠাকুর নগর থেকে বিজেপি দলীয় লোকসভার সদস্য।
যেভাবে নরেন্দ্র মোদি মাঠে নেমেছেন অনুরূপ অবস্থায় মুসলমান ভোটে যদি আসাদউদ্দীন ওয়াইসি প্রত্যেক আসনে তার সংগঠন থেকে মুসলমান প্রার্থী দিয়ে ভোট বিভক্ত করে ফেলেন তবে বিজেপির বিজয় অবধারিত। আবার শুনেছি ফুরফুরার হজরত মাওলানা আবু বকর ছিদ্দিকীর সন্তানেরাও নতুন দল গঠন করে প্রত্যেক আসনে প্রার্থী দিচ্ছেন। ফুরফুরার হজরত মাওলানা আবু বকর ছিদ্দিকী ব্রিটিশের সময় থেকে প্রথিতযশা পীর এবং মুসলিম স্বার্থের দ্বারক-বাহক। মুসলমানদের মাঝে তাদেরও প্রভাব প্রতিপত্তি রয়েছে।
এমনিভাবে যদি মুসলিম ভোট বিভক্ত হয় তবে কার্যকর ক্ষমতা মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে যাবে এবং মুসলমানদের অসহায় অবস্থা সৃষ্টি হবে। সুতরাং আসাদউদ্দীন ওয়াইসি এবং ফুরফুরার পীর সাহেবের সন্তানদের মুসলমান ভোট বিভক্তির বিষয়টা পরিত্যাগ করে প্রয়োজনে স্থানীয় একটা শক্তিশালী দলের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন করাই উত্তম হবে। মুসলিম ভোটের যে কোনও বিভক্তি মুসলিম স্বার্থের পরিপন্থী হবে।
গত শতাব্দীর আশির দশকে সাহাবুদ্দীন নামে এক মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতা বিহার থেকে লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। হায়দ্রাবাদের দাঙ্গার সময় লোকসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, মুসলমানরা প্রয়োজনে ভারতের ভেতরে আরেক পাকিস্তানের দাবি উত্থাপন করবে। সাহাবুদ্দীনের অনুরূপ বেফাঁস কথা তখনকার সময়ে বিহারের মুসলিম সম্প্রদায়টাকে অহেতুক বিপদে ফেলেছিল। বিপদগ্রস্ত লোককে ভেবেচিন্তে কাজ করতে হয়। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করে পদক্ষেপ দিতে হয়। যা সম্ভব হয় সে কথা বলে অহেতুক বিপদ ডেকে আনার কোনও যৌক্তিকতা নেই। সুতরাং এখন ভারতীয় মুসলমানদের উচিত হবে স্থানীয় রাজ্যভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক দলগুলোর সঙ্গে মিলেমিশে নির্বাচন করা। আর আসাদউদ্দীন ওয়াইসি দেশভাগের আগের মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ হননি যে তার দলকে ভোট দেওয়ার জন্য মুসলমানরা একজোট হবে।

 

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ