X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

ক্ষমতার পঠন : ইতিহাস আর উপন্যাসের বোঝাপড়া

সুমন রহমান
২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৫:৩০আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৩:৪৬

বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক কাজী আনিস আহমেদ-এর ৫০তম জন্মদিন আগামীকাল শনিবার। তার লেখালেখির সূচনা কৈশোরেই, বাংলা ও ইরেজি ভাষায়। ‘চল্লিশ কদম’ উপন্যাসিকা প্রথম প্রকাশিত হয় আমেরিকার মিনেসোটা রিভিউ-এ, ২০০০ সালে। গল্পগ্রন্থ ‘গুড নাইট মি. কিসিঞ্জার অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ বাংলাদেশে প্রকাশ করে ইউপিএল, ২০১২ সালে এবং যুক্তরাষ্ট্রে দ্যা আননেম্ড প্রেস, ২০১৪ সালে। উপন্যাস ‘দ্যা ওয়ার্ল্ড ইন মাই হ্যান্ডস’ প্রকাশ করেছে ভিনটেজ/র‌্যানডম হাউজ, ২০১৩ সালে। তার সবগুলো বই কাগজ প্রকাশন থেকে বাংলায় অনূদিত হয়েছে।

কাজী আনিস আহমেদের জন্ম এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা ঢাকাতেই, সেন্ট জোসেফ ও নটরডেম কলেজে। উচ্চতর শিক্ষা আমেরিকায়-ব্রাউন, ওয়াশিংটন ও নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে যথাক্রমে সাহিত্যে ব্যাচেলর, মাস্টার্স ও ডক্টরেট। তিনি ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব)-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং ঢাকা ট্রিবিউন-বাংলা ট্রিবিউনের প্রকাশক।

কাজী আনিস আহমেদের ৫০তম জন্মদিন উপলক্ষে কবি শামীম রেজার সম্পাদনায় বাতিঘর  প্রকাশ করছে একটি মূল্যায়ন-গ্রন্থ ‘অধরা বিশ্বের প্রতিভূ’। উক্ত সংকলন থেকে লেখাটি প্রকাশ করা হলো। 

ক্ষমতার পঠন : ইতিহাস আর উপন্যাসের বোঝাপড়া বাংলা সাহিত্য হচ্ছে মধ্যবিত্ত সাহিত্যিকদের একটি নিম্নবর্গীয় কল্পনাপ্রপঞ্চ, অর্থাৎ এখানে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সাহিত্যিক তার দেখা ও অদেখা নিম্নবর্গ নিয়ে যাবতীয় আহাজারি জারি রাখবেন! এটি এক অতি প্রবল রুচিগত দাবি-এতটাই প্রবল যে ‘মধ্যবিত্ত’ সাহিত্যিক হয়ে হুমায়ূন আহমেদ যখন ‘মধ্যবিত্ত’ জীবন নিয়ে সাহিত্য রচনা করতে শুরু করলেন, আমরা তাকে আখ্যা দিলাম ‘মধ্যবিত্ত জীবনের রূপকার’ হিসেবে। মানে, এটা ব্যতিক্রম। তিনি ‘মধ্যবিত্ত’ জীবন নিয়ে লিখছেন। এমন হওয়ার কথা নয়। তাঁর কাহিনিতে কুবের মাঝি নেই। কপিলা নেই। এটা অস্বাভাবিক। ফলে প্রথম জীবনের রচনাগুলো তিনি যথেষ্ট সিরিয়াস ভঙ্গিতে লিখবার পরও হুমায়ূন আহমেদকে লোকে তখনো ঠিক ‘সিরিয়াস’ সাহিত্যিকের কাতারে জায়গা দিতে চায়নি। কেননা তার কাহিনির পাত্রপাত্রী খুব সিরিয়াস ধরনের ‘গরিব’ না। বৈপ্লবিক সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয় না! বললে অত্যুক্তি হবে না যে হুমায়ূন নিজেও শেষ দিকে ‘সিরিয়াস’ পাঠকরুচির এই ফাঁদে পড়েছিলেন। নয়তো তিনি কেন লিখবেন ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ কিংবা ‘মধ্যাহ্ন’র মতো উপন্যাস? আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, বহু লোকে হুমায়ূনের এই রচনাগুলোকেই তাঁর সেরা লেখা হিসেবে মানেন!

কাজী আনিস আহমেদের উপন্যাস ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইন মাই হ্যান্ড’ দ্বিতীয়বার পড়তে গিয়ে এই কথাটা মনে হলো। প্রথমবার যখন পড়েছিলাম, তখন আখ্যানের তুখোড় গতি আর কাজী আনিসের সেরিব্রাল ভাষারীতির কারণে অতখানি ভেবে ওঠার অবকাশ হয়নি। এবার যখন বাংলা অনুবাদটি (হাতের তারায় বিশ্ব খেলে, ভাষান্তর : তপন শাহেদ) হাতে পেলাম, বাংলা সাহিত্য তখন মনের কোণে উঁকিঝুকি মারতে শুরু করল। কিঞ্চিৎ ভ্রূকুটিসহ। কারণ, এই উপন্যাস উচ্চবিত্ত জীবনের আখ্যান। বিশ্বসাহিত্যে তলস্তয়-তুর্গেনেভ প্রমুখের কল্যাণে উচ্চবিত্ত জীবনের স্বাদ পাওয়া গেলেও বাংলাদেশের সাহিত্যে এটি একান্তই নতুন ঘটনা। কাজী আনিস আহমেদ বাংলা সাহিত্য না করলেও বাংলাদেশের কাহিনিই তো বলছেন। তাঁর উপন্যাসে ‘পাণ্ডুয়া’ নামক যে দেশটা আছে, সেটা মার্কেজের ‘মাকোন্দো’র মতো কোনো কল্পনার গ্রাম নয়। নির্ভেজাল গরিবি বাংলা। সেই বিশাল গরিবি বাংলায় যে মুষ্টিমেয় কিছু উচ্চবিত্ত মানুষ বসবাস করেন, বাংলা সাহিত্যের পাঠকের পক্ষে তা জানবার কোনো উপায় ছিল না। বাংলা চলচ্চিত্রের দর্শক অবশ্য খানিকটা জানত। ডুপ্লেক্স বাড়ির দোতলা থেকে স্লিপিং গাউন পরে নেমে আসা ভিলেন গোলাম মুস্তাফার কল্যাণে! অবশ্য বাংলা সিনেমার উচ্চবিত্ত এমন আহামরি ধরনের উচ্চবিত্ত নয়। তাদের সংলাপ থেকেই বোঝা যায়, মধ্যবিত্তের বিদ্বেষ আর অতিকল্পনা দিয়ে বানানো হয়েছে তাকে, গরিবের প্রতিপক্ষ হিসেবে।

উচ্চবিত্ত এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হলেও কেন্দ্রীয় ঘটনা অবশ্যই নয়। কেন্দ্রীয় ঘটনাটি আরও অভিনব, সেই তথাকথিত ওয়ান-ইলেভেন বা এক-এগারো। এক-এগারোর একটা শ্রেণি-ডিঙানো রাজনৈতিক তাৎপর্য থাকলেও বাংলা সাহিত্যে এটি এখনো কাঁচামাল হয়ে আসেনি। অথচ এক যুগের বেশি সময় কেটে গেল! সবচেয়ে সমসাময়িক যে রাজনৈতিক ঘটনাগুলো আমাদের প্রতিষ্ঠিত লেখকদের উপন্যাসে এসেছে, সেগুলোও বহু আগেকার-পঁচাত্তরের বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড (হুমায়ূন আহমেদ, দেয়াল), এবং কর্নেল তাহেরের জীবনালেখ্য (শাহাদুজ্জামান, ক্রাচের কর্নেল)। এমনকি এরশাদের মতো বর্ণাঢ্য চরিত্রের স্বৈরাচারকেও বাংলা উপন্যাসে সেভাবে হাজিরা দিতে হয়নি এখনো, এর চেয়ে দুঃখের আর কী হতে পারে? সেই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের একজন লেখক যখন ২০০৭ সালে ঘটে যাওয়া ওয়ান-ইলেভেন নিয়ে উপন্যাস লিখতে বসেন-তা যে ভাষাতেই হোক-সেটি বাংলাদেশের সাহিত্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।

অবশ্য এটা ওয়ান-ইলেভেন কি না, কিংবা ঘটনাটি বাংলাদেশে ঘটেছে কি না, সেসব প্রামাণ্যচিহ্ন উপন্যাসে নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর নাম, শহরের নাম, সেনা প্রতিষ্ঠানের নাম সবকিছুই বদলে দেয়া হয়েছে উপন্যাসে। এটি কাজী আনিস কেন করলেন? বাহুল্য বিতর্ক এড়ানোর জন্য? হতে পারে। কারণ, তিনি জ্যান্ত ইতিহাস সামলাচ্ছেন, যার দগদগে ঘা বহুলোকের হৃদয় থেকে এখনো মুছে যায়নি। এ কারণেই আমার মনে হয়, এই নাম বদলের মধ্য দিয়ে তিনি বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হেজিমনিক প্রভাব থেকে কাহিনিটাকে বাঁচাতে চেয়েছেন। যেসব নামের উল্লেখ হয়তো কাহিনিকে ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করতে পারত। যে গল্পটি যতখানি নিরাসক্তভাবে বলতে তিনি চাইছেন, ততখানি নিরাসক্তভাবে বলতে না-ও পারতে পারতেন। কারণ, তাঁর এই উপন্যাসের সব চরিত্র জীবন্ত, সব প্রতিষ্ঠান জীবিত-তাদের এহেন সক্রিয় ও সক্ষম জীবদ্দশায় তাদেরই জীবনের সবচেয়ে সংবেদনশীল গল্পগুলো বলে ফেলা কতখানি ঝুঁকিপূর্ণ, সেটা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না।

নিরাসক্তি প্রসঙ্গে আরও একটু বলে নেয়া ভালো। আগেই বলেছি, গল্পটি উচ্চবিত্তের। উচ্চবিত্ত বিষয়ে গরিব নিম্নবর্গ মানুষের যে কিছুটা ‘অহেতু বিদ্বেষ’ আছে সেটি যেমন কাজী আনিস বলছেন, আবার কোনোভাবেই ছাড় দিচ্ছেন না তাঁর উচ্চবর্গীয় চরিত্রদের। অর্থাৎ আমরা যাকে বলি ‘অ্যাপোলোজেটিক’, কাজী আনিস উচ্চবিত্তের প্রতি তেমনটা খুব বেশি হননি। তাঁর কাহিনির অন্যতম প্রধান চরিত্র কায়সারকে যখন ঘুষ দেয়া-সংক্রান্ত মামলায় জড়িয়ে জেলে ঢোকানো হয়, সেই অভিযোগ থেকে তাঁকে, এমনকি বেনিফিট অব ডাউটও দিতে চাননি লেখক। কিংবা তাঁর বন্ধু ও পত্রিকার উপসম্পাদক হিশামও যখন সম্পাদক হতে চান, সেই উচ্চাকাক্সক্ষার দৌড়ে বন্ধুকে জেলে ঢোকানোর ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে অবদান রাখেন, সেটিও নিরাসক্তভাবে ন্যারেটিভে হাজির রাখেন কাজী আনিস। ফলে এই উচ্চবর্গ মধ্যবিত্তের তুলিতে আঁকা মেলোড্রামাটিক গোলাম মুস্তাফা যেমন নয়, তেমনি ধোয়া তুলসিপাতাও নয়। এটিকেও দাগিয়ে রাখতে হয়, কারণ ঔপন্যাসিকের এইটুক জীবনবীক্ষাও এ দেশে দুর্লভ। প্যাঁচপেঁচে চরিত্র চিত্রণ আর ম্যাড়ম্যাড়ে ঘটনা বয়ান-সমসাময়িক বাংলাদেশের সাহিত্য থেকে এর বেশি প্রসাদ খুব কমই পাওয়া গেছে।

অবশ্য কাজী আনিস আহমেদের উপন্যাস নিয়ে আলোচনায় বাংলা সাহিত্যের বেশি বেশি রেফারেন্স টানা বাহুল্য মনে হতে পারে। তিনি তো বাংলা ভাষায় উপন্যাসটি লেখেননি। তাঁর পাঠক বিশ্বজোড়া ইংরেজিভাষী পাঠক। কিন্তু ভাষা ব্যবহার না করেও কাজী আনিস সমসাময়িক বাংলাদেশের সাহিত্যিকদের যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন, একই সময়ের বাংলা ভাষার সামান্য লেখক হিসেবে সেটি আমি অনুভব করতে বাধ্য হয়েছি। সেই চ্যালেঞ্জ বিষয়বস্তুর, পর্যবেক্ষণের এবং বিচক্ষণ সাহসিকতার। ‘পঁচাত্তর’ নিয়ে যদি দুই হাজার উনিশে বা আঠারোয় সাহিত্য রচিত হয়, তবে দুই হাজার সাত সালের ঘটনা বাংলা উপন্যাসে আসতে আসতে আরও অন্তত দুই দশক বাকি! ২১ আগস্ট নিয়ে আমাদের দেশে কোনো দিন কি কোনো উপন্যাস বাংলায় লেখা হবে? কিংবা বিডিআর বিদ্রোহ কিংবা হেফাজত-প্রপঞ্চ নিয়ে? এমন দগদগে, ঝলমলে এবং সাংঘাতিক রকম জটিল রাজনৈতিক ন্যারেটিভগুলোর দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে যখন বাংলা সাহিত্যের দিকে তাকাই, তখন সাহিত্যকে সাংঘাতিক অপ্রস্তুত মনে হয়। মেয়াদোত্তীর্ণ খেলনার মতো লাগে।

কাজী আনিস আহমেদকে এ কারণেই ধন্যবাদ দিতে হয় যে তিনি বাংলা সাহিত্যের এই হতাশাজনক উত্তরাধিকার বহন করেননি। সেটা কি তিনি ইংরেজি ভাষায় লিখেছেন বলে? অবশ্যই না। তাঁর সময়ের ইংরেজিভাষী লেখক জিয়া হায়দার রহমান, তাহমিমা আনাম কিংবা ঝুম্পা লাহিড়ি কিন্তু এমন জটিল এবং সংবেদনশীল সমসাময়িক গল্প কখনোই বলবার কোশেশ করেননি। তাঁরা গল্প বলার আনন্দে গল্প বুনে গেছেন, ডানে-বাঁয়ে তাকানোর দরকার পড়েনি। কিন্তু কাজী আনিসকে প্রতি পলে পলে বোঝাপড়া করতে হয়েছে, ভীষণ রাজনৈতিক, কৌশলগত ও দার্শনিক বোঝাপড়া। জ্যান্ত, প্রভাববিস্তারী এবং পরিবর্তনশীল একটি ক্ষমতাকেন্দ্রকে উপন্যাসে হাজির করতে হলে অন্য রকম দক্ষতা লাগে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশে। ফলে ‘চল্লিশ কদম’ কিংবা ‘গুডনাইট কিসিঞ্জার’-এর লেখককে তাঁর প্রথম উপন্যাসে তাই অন্য রকম একটি লড়াইয়ে জড়াতে হয়েছে।

উপন্যাসের মূল আখ্যানটি আবর্তিত হয়েছে কয়েকটি চরিত্রকে ঘিরে: একটি পত্রিকার উপসম্পাদক হিশাম হাবীব, একজন সেনা কর্মকর্তা বখতিয়ার, একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী কায়সার ও তার স্ত্রী নাতাশা এবং একজন সমাজকর্মী নারী দুনিয়া। পত্রিকার উপসম্পাদক হিশাম সেনা অভ্যুত্থানের পক্ষের লোক, কিন্তু তার বন্ধু ও পত্রিকার শেয়ারহোল্ডার ব্যবসায়ী কায়সার এই অভ্যুত্থানের বিরোধী। এই ব্যবসায়ী শিল্পপতির স্ত্রী নাতাশার সঙ্গে পত্রিকার উপসম্পাদকের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের ইতিহাস আছে, তাদের যৌনতাহীন পারস্পরিক টানের সম্পর্ক এই আখ্যানের অন্যতম আকর্ষণীয় অংশ। নারী সমাজকর্মী দুনিয়াকে আমরা হিশামের প্রেমিকা হিসেবে পাই কাহিনির একপর্যায়ে। তিনি তাঁর আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটসমেত আশ্চর্যজনকভাবে হিশামের প্লাতোনিক বান্ধবী নাতাশার ব্যাপারে যথেষ্ট অনুদার। হিশাম কিন্তু পত্রিকার পূর্ণ সম্পাদক নন। ফলে সেই পদে যাবার উচ্চাশা তাঁকে ঘটমান সেনা অভ্যুত্থানের সমর্থকে পরিণত করে। সেনা কর্মকর্তা বখতিয়ার এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে দৈনিক পাণ্ডুয়া পত্রিকাটিকে অভ্যুত্থানের পক্ষের মিডিয়া কাভারেজ দেয়ার কাজে সুচারুভাবে ব্যবহার করেন। সেনাশাসিত রাষ্ট্রের পয়লা আক্রোশের শিকার হতে শুরু করেন রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ী। এরই ধারাবাহিকতায় ব্যবসায়ী কায়সারকে আমরা সেনাদের হাতে নিগৃহীত এবং কারাবন্দি হয়ে পরবর্তী সময়ে মরে যেতে দেখি। কায়সারের কারাবরণ হিশামকে একটুখানি নৈতিক দ্বিধার মধ্যে ঠেলে দেয়। তিনি তার বন্ধুকে ছাড়িয়ে আনার অনেক চেষ্টা করেন বটে, কিন্তু তাতে তার বন্ধুত্ব আর ফেরত আসে না। এভাবেই ধীরে ধীরে ছায়া-সেনাশাসনের ব্যাপারে জনতার প্রতিরোধের ঘটনা ঘটতে শুরু করে। উপায়ান্তর না দেখে দেশকে আবার রাজনীতিবিদদের হাতে ফেরত দিতে উদ্যোগী হন তারা। তাতে হিশামের মতো আরও অনেকেরই স্বপ্নভঙ্গ হয়। তবুও হিশাম আর দুনিয়ার স্বল্পস্থায়ী প্রেমটুকু পরিণতির দিকে যেতে পারত, যাচ্ছিলও, কিন্তু মোক্ষম মুহূর্তে মারা গিয়ে হিশামের এই ব্যক্তিগত প্রাপ্তির সুযোগটাকেও নাগালের বাইরে ঠেলে দেন হিশামের বন্ধু ব্যবসায়ী কায়সার। ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের কার্যালয় থেকে হিশামকে তাই বন্ধুর শেষকৃত্যে ছুটে যেতে হয়। এতে করে তিনি একদিকে তার সম্ভাব্য জীবনসঙ্গীকে হারান, অন্যদিকে হারান শৈশবের বান্ধবীকে, যে মৃত ব্যবসায়ীর স্ত্রী। এভাবেই আমরা প্রাপ্তিশূন্য হয়ে যেতে দেখি ওয়ান-ইলেভেন সমর্থক পত্রিকার একজন উপসম্পাদককে।

গোটা আখ্যানে একমাত্র হিশামকেই আমরা নৈতিক টানাপোড়েনের শিকার হতে দেখি। বাদবাকিরা সবাই নিজেদের নৈতিক অবস্থান নিয়ে মোটামুটি সন্তুষ্ট এবং নিশ্চিত। কায়সারের কোনো সন্দেহ নেই যে সেনাশাসন অন্যায্য। সেনা কর্মকর্তার কোনো সন্দেহ নেই যে দেশ শাসনের ভার রাজনীতিবিদদের হাতে থাকলে দেশের ক্ষতি। এমনকি হিশাম কিংবা কায়সারের গাড়িচালকেরাও এই সেনাব্যবস্থা পছন্দ করছেন না। রাজনীতিবিদেরা সংগত কারণেই কোনো নৈতিক চরিত্র হিসেবে আখ্যানে আবির্ভূত হন না। দু-একজন ‘দলত্যাগী’ রাজনীতিবিদ যদিও উঁকিঝুকি মারেন নানান সময়ে, তাদের নৈতিক বোঝাপড়া বা সংকট এই আখ্যানে বেশি দূর গড়ায়নি। বরং তাদের নানা রকম দুর্নীতি আর কুকর্মের প্রমাণকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তাদের এই হাইব্রিড শাসনব্যবস্থার অসহায় সমর্থকে পরিণত করা হয়। কিন্তু আমরা যদি ধরে নিই যে কাজী আনিসের গল্পটি ওয়ান-ইলেভেন নিয়েই, তবে ঐতিহাসিকভাবে স্মরণ রাখতে হয় যে ওয়ান-ইলেভেন সামান্য হলেও একটু দ্বিধা তৈরি করেছিল সমাজের কিছু কিছু স্তরে। সেনাশাসিত সরকার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছিল কিছু বিশেষ ব্যক্তিবর্গকে, যাঁরা সমাজে গ্রহণযোগ্য ছিলেন। শুরুতেই তারা দুর্নীতি দমন অভিযানের নামে অনেক ব্যবসায়ী আর রাজনীতিবিদদের গ্রেপ্তার করে জেলে পুরেছিল, জনসমর্থন পাবার আশায়। এতে প্রাথমিকভাবে কিছু সাফল্যও তারা পেয়েছিল। কিন্তু এ রকম একটি ব্যবস্থার জবাবে যখন রাজনীতিবিদদের বিচক্ষণ ও সাধু অংশটি শান্তভাবে রুখে দাঁড়িয়ে গেল, তখন এই হাইব্রিড সেনাশাসনের অন্যায্যতার চেহারা মানুষের কাছে পরিষ্কার হতে শুরু করল। আমরা বুঝলাম, যত হাইব্রিড সিভিল সোসাইটি আকারেই আসুক না কেন, এই ব্যবস্থা আদতে সামরিক শাসন ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু এর ভোল পাল্টানো চেহারা কিছু মানুষের জীবন চিরদিনের জন্য বদলে দিয়েছে। আমাদের সম্পাদক হিশাম হাবীব তাঁদেরই একজন। ধর তক্তা মার পেরেক টাইপ হাইব্রিড ব্যবস্থার অকার্যকারিতা বিষয়ে হিশামের ভাবনার প্রতীকায়ন ঘটেছে তার বই পোড়ানোর গল্পে : যখন তিনি শুধু দর্শনের বই ছাড়া বাদবাকি বিভিন্ন ধরনের ম্যানুয়াল, সেল্ফ-হেল্প, পর্নোগ্রাফি কিংবা ধর্মপুস্তক সবই পুড়িয়ে দেন। পরে যখন দেশ গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে ফেরত যায়, নাতাশা হিশামকে সম্পাদকের পদ থেকে ছাঁটাই করেন। চাকরি হারিয়ে হিশাম তখন বøগ লিখতে শুরু করেন। ব্লগ কারা লেখে? সীমিত প্রতিভা আর সীমাহীন নীচতা যেসব বুদ্ধিজীবীদের, ব্লগ তাদেরই অন্তিম ঠিকানা। এই কথা নাতাশাকে তাঁর ছেলে সাইমন জানায়।

উপন্যাসে এই একবারই ভ্যালু জাজমেন্ট করেছেন কাজী আনিস, তাঁর আখ্যানের প্রধান প্রোটাগনিস্ট হিশাম হাবীব সম্পর্কে। সেনাদল ব্যারাকে ফিরে গেছে, রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতে ফেরত এসেছে, কুশীলবদের অনেকেই দেশ ছেড়েছে। স্বামী এবং বাবাকে হারিয়ে নাতাশা-সাইমন পরিবারটিও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিজেদের ফিরে পেয়েছে, সামলে নিয়েছে। শুধু হিশামসহ কতিপয় সুবিধাবাদী উচ্চাকাক্সক্ষী মানুষ এই ঘটনার মধ্য দিয়ে বিশাল পরিচয়সংকটের আবর্তে পড়ে গেছে।

অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে ‘পাণ্ডুয়া’ নামক দেশে নাজিল হওয়া সেনাশাসিত হাইব্রিড একটি শাসনব্যবস্থার কয়েকজন কুশীলব ও তার ভিক্টিমদের দুয়েকজনকে চিত্রিত করেছেন কাজী আনিস। গল্পটি বলেছেন হিশাম হাবীবের পাটাতনে দাঁড়িয়ে। আমরা বুঝতে পারি, হিশাম হাবীবের পাটাতন ব্যক্তি কাজী আনিসের বিশেষ পছন্দ নয়। কিন্তু ঔপন্যাসিককে তো সবচেয়ে সুবিধাজনক জায়গায় দাঁড়িয়েই গল্পটি বলতে হবে! এ কারণেই হিশাম হাবীব এই আখ্যানের মূল প্রোটাগনিস্ট হয়ে ওঠেন। আর তাতে কাজী আনিসের ভাষাও হয়ে ওঠে ক্ষুরধার এবং কৌতুকপ্রবণ। কায়সার, নাতাশা এমনকি সেনা কর্মকর্তা বখতিয়ারের চরিত্রে বেশি ভর দিয়ে গল্পটি বলবার চেষ্টা করলে হয়তো এর অন্তর্নিহিত নৈতিক টানাপোড়েনটুকু হারিয়ে যেত। ওয়ান-ইলেভেনের জটিল এবং অনন্য চরিত্রটুকুকে কাহিনির পরিসরে ধরা সম্ভব না-ও হতে পারত।

তবু এই আখ্যান কেবলই হিশাম হাবীবের আখ্যান নয়। ঔপন্যাসিকের সবচেয়ে জরুরি দক্ষতা হলো ডিটেইলিংয়ের দক্ষতা। কাজী আনিস যে চিরায়ত ঔপন্যাসিকদের স্কুল থেকে বেরিয়েছেন, তাঁর ডিটেইলিং দেখে এ কথা যে কেউ মানতে বাধ্য হবেন। সেটা তাঁর উচ্চবিত্ত সমাজের বয়ান হোক, পত্রিকা সম্পাদকের প্রতিদিনের ফিরিস্তি হোক কিংবা সেনা সদরের ন্যারেটিভই হোক। তাঁর পুরুষেরা যতখানি বর্ণিল আর জটিল, নারীরা সে তুলনায় সোজাসাপ্টা এবং অনুমেয়। তবে ঐতিহাসিক ওয়ান-ইলেভেন হরে-দরে জটিলতর পুরুষদেরই গল্প। মাত্র দুজন নারীর সোজাসাপ্টা ও সাহসী ভূমিকার কারণেই ওয়ান-ইলেভেনের হাইব্রিড ব্যবস্থা টিকে থাকতে পারেনি। বাস্তবের সেই দুজন নারী অবশ্যই নাতাশা ও দুনিয়া নয়। কিন্তু নাতাশা ও দুনিয়ার মধ্যে কাঠামোগতভাবে সেই মেজাজটুকু হাজির থাকে। যাঁরা এই প্রেক্ষাপটটুকু অবগত না থেকে উপন্যাসটি পড়তে যাবেন, তবে এই উপন্যাসের নারী চরিত্রগুলো তাঁদের কাছে খানিকটা নিষ্প্রভ ও স্টেরিওটাইপড লাগতে পারে।

কিন্তু ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইন মাই হ্যান্ড’ অবিস্মরণীয়ভাবেই সমসাময়িক বাংলাদেশের সবচেয়ে বর্ণিল এবং জটিল একটি অধ্যায়কে এর আখ্যানের মধ্যে হাজির করতে পেরেছে। এর বর্ণিলতা ও জটিলতার সঙ্গে সমান-সমানে লড়েছেন এই ঔপন্যাসিক। এর ফলে আখ্যানের মধ্যে কত নাম-ধাম পাল্টে দিতে হয়েছে তাঁকে! সব রকমের আইনি, নৈতিক ও হেজেমনিক ক্ষমতাকাঠামোর অনুমেয় চোখরাঙানি মোকাবিলা করে আমাদের উপহার দিয়েছেন অনুপম একটি গল্প। জরার হিসেবে একে পলিটিক্যাল থ্রিলার বলাই সংগত, কিন্তু বহু জায়গায় কাজী আনিস জরা ভেঙেছেন। নির্দিষ্ট কোনো জরায় আটকে থেকে গল্পটা বলতে চাননি। সংগত কারণেই এই উপন্যাস পাঠের অভিজ্ঞতা নানা দিক দিয়ে স্মরণীয় হয়ে উঠেছে।

আরও এক-দুই যুগ পরে, যখন ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলব আর ভেতর-বাইরের পাত্রপাত্রীরা নিরাসক্ত ইতিহাসের আরও গভীরে থিতিয়ে যাবে, তখন কাজী আনিস আহমেদের এই আখ্যান কেবলই সাহিত্যিক আখ্যান হিসেবে পঠিত হবে না। আমার ধারণা, বাংলাদেশের শাসকশ্রেণির ক্ষমতাচর্চার ক্রিটিক্যাল অধ্যয়ন এবং ইতিহাসের বিকল্প হিসেবেও তার প্রকাশ্য পঠন জারি থাকবে।

আরও পড়ুন :

জীবন লিখতে লিখতে | জহর সেনমজুমদার 

 স্বপ্ন নেই, আশাভঙ্গও নেই | সেবন্তী ঘোষ 

বি-উপনিবেশায়নের জ্বালামুখ | হামীম কামরুল হক 

দোটানার বৃত্ত | আফসানা বেগম 

বিস্ময়মুগ্ধতা ও ডুবসাঁতার | মোস্তাক আহমেদ

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
যুক্তরাষ্ট্রের টি-টোয়েন্টি দলে নিউজিল্যান্ডের সাবেক অলরাউন্ডার
যুক্তরাষ্ট্রের টি-টোয়েন্টি দলে নিউজিল্যান্ডের সাবেক অলরাউন্ডার
‘আ.লীগকে বর্জন করলেই অন্য পণ্য বর্জনের প্রয়োজন হয় না’
‘আ.লীগকে বর্জন করলেই অন্য পণ্য বর্জনের প্রয়োজন হয় না’
বিজিএপিএমইএ’র নির্বাচনের প্যানেল ঘোষণা, শাহরিয়ার নতুন প্যানেল নেতা
বিজিএপিএমইএ’র নির্বাচনের প্যানেল ঘোষণা, শাহরিয়ার নতুন প্যানেল নেতা
রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত
রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!