X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

বি-উপনিবেশায়নের জ্বালামুখ

হামীম কামরুল হক
২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৮:০০আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৩:৪৯

বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক কাজী আনিস আহমেদ-এর ৫০তম জন্মদিন আগামীকাল শনিবার। তার লেখালেখির সূচনা কৈশোরেই, বাংলা ও ইরেজি ভাষায়। ‘চল্লিশ কদম’ উপন্যাসিকা প্রথম প্রকাশিত হয় আমেরিকার মিনেসোটা রিভিউ-এ, ২০০০ সালে। গল্পগ্রন্থ ‘গুড নাইট মি. কিসিঞ্জার অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ বাংলাদেশে প্রকাশ করে ইউপিএল, ২০১২ সালে এবং যুক্তরাষ্ট্রে দ্যা আননেম্ড প্রেস, ২০১৪ সালে। উপন্যাস ‘দ্যা ওয়ার্ল্ড ইন মাই হ্যান্ডস’ প্রকাশ করেছে ভিনটেজ/র‌্যানডম হাউজ, ২০১৩ সালে। তার সবগুলো বই কাগজ প্রকাশন থেকে বাংলায় অনূদিত হয়েছে।

কাজী আনিস আহমেদের জন্ম এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা ঢাকাতেই, সেন্ট জোসেফ ও নটরডেম কলেজে। উচ্চতর শিক্ষা আমেরিকায়-ব্রাউন, ওয়াশিংটন ও নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে যথাক্রমে সাহিত্যে ব্যাচেলর, মাস্টার্স ও ডক্টরেট। তিনি ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব)-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং ঢাকা ট্রিবিউন-বাংলা ট্রিবিউনের প্রকাশক।

কাজী আনিস আহমেদের ৫০তম জন্মদিন উপলক্ষে কবি শামীম রেজার সম্পাদনায় বাতিঘর  প্রকাশ করছে একটি মূল্যায়ন-গ্রন্থ ‘অধরা বিশ্বের প্রতিভূ’। উক্ত সংকলন থেকে লেখাটি প্রকাশ করা হলো। 

বি-উপনিবেশায়নের জ্বালামুখ

১.

যে লেখাকে কোনো ছকে ফেলে দেয়া হয়, সে লেখা ও এর লেখক সীমাবদ্ধ লেখক, নয় কি? সেদিক থেকে মার্কেসের মতো লেখককেও ‘জাদুবাস্তববাদী’ বলে ছকে ফেলে সীমাবদ্ধ করার একটা প্রয়াস তো বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়। আমাদের বিচারের ধাঁতটাই এই যে কোনো না কোনো একটা তত্ত্বে বা ছকে একটা কিছু সেঁটে দিতে না পারলে আমাদের বুঝে ওঠার প্রক্রিয়াটি যেন পূর্ণতা পায় না। সেদিক থেকে যে লেখকদের আমরা দেখি, তারা আগে থেকেই এমন ব্যবস্থা করে গিয়েছেন যাতে তাঁদের কোনো ছকে ফেলা যায় না, আবার একই সঙ্গে সব রকমের ছকে ফেলেই দেখা যায়, তাঁদের বহুমাত্রিক জ্যোতি আমাদের বাছবিচারের সীমাবদ্ধ চোখটাকেই বরং ধাঁধিয়ে দেয়। যেমন দস্তয়েভস্কি। শুরুতে তাঁর নামই করতে হলো; কারণ দেখি ক্রিটিক্যাল তত্ত্বচিন্তায় ইমানুয়েল লেভিনাসের চিন্তার সূত্র তাঁর ‘দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ’ উপন্যাসের পরিস্থিতি এনে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। (অবশ্য এমনটা হোমার-সফোক্লিসকেও আনা যায়, আর আমাদের ‘মহাভারত’ কি রবীন্দ্রনাথের গানের অনুষঙ্গ তো পদে পদে হাজির করা যায়) এর সঙ্গে মিলে যাচ্ছে লেভিনাসের তালমুদের চেতনা; চলে আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হলোকাস্টের অভিঘাত আর জায়নবাদের প্রাসঙ্গিকতা। হাল আমলে বলে আধুনিকতার শনাক্তকরণে জেমস জয়েসকে আঁটানো গেলেও স্যামুয়েল বেকেটকে নানান দিক থেকেই দেখতে হচ্ছে। এমনকি প্রথা ভেঙে দেয়া জয়েসের উপন্যাসকেও বেকেটের তুলানায় প্রথাগত উপন্যাস বলা হচ্ছে। কেউ অবশ্য এর কোনোটাতেই মত দেবেন না। কারণ সামনে এখন টমাস বার্নহার্ড, ড্যানিলো কিছ, জর্জ পেরেকরা; আছেন টমাস পিনসেন থেকে রোবের্তো বোলানিয়োর মতো লেখকরা। আর হোর্হে লুই বোর্হেসের মতো লেখক-কবি-প্রাবন্ধিক তো আছেনই। বিচিত্র স্তরে তাঁদের কাজ। লেখার ভেতরে লেখা, কাহিনির ভেতরে কাহিনি। রচনাপদ্ধতিতে নানান পরত এসে লাগে, কত কত আস্তর পড়ে, বিচিত্র ‘লেয়ারে’ তাঁদের কাজ। তাঁদের বুঝতে হলে লাগে তাঁদের কথাসাহিত্যের বাইরে থাকা তাঁদেরই লেখা নানান গদ্য, প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকার এবং অন্যদের লেখা তাঁদের নিয়ে নানান রচনাবলি, অর্থাৎ প্যারাটেক্সট; বা তাঁদের পড়তে গেলে একই সমান্তরালে তাঁদের অন্যান্য রচনা ও তাঁদের সম্পর্কে অন্যদের রচনা-পাঠ ছাড়া তাঁদের আয়ত্ত করা, কবজা করা একটু কঠিনই বলা যায়। তাঁদের লেখার এক জগতে বহু জগতের উপস্থিতি; আছে ঘরের ভেতরে ঘর, তার ভেতরে ঘর; আর নানান চাবি/কি লাগে একেকটি ঘর খুলতে। আরও মজার বিষয় হলো, ওই চাবি দিয়ে খুলে যেমনটা পাওয়া যাবে বলে আগে কিছুটা ধারণা করা হলো, দেখা গেল, ঘরের অবস্থাতে আরেক চেহারায় দেখা দিচ্ছে তাদের অভিব্যক্তি, তাদের নিহিত বিষয়াবলি। কোথাও কোথাও কেঁচো খুঁড়তে সাপ। কোথাও-বা উল্টোটা।

এদিক থেকে বাংলা সাহিত্যের দশা একটু নাজুক। যদিও আমাদের বঙ্কিম থেকে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো লেখক, বিভূতি-তারাশঙ্কর-মানিক-অতীন-রাঘব-তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লেখক রয়েছেন; রয়েছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, কমলকুমার-অমিয়ভূষণ মজুমদার, অসীম-প্রফুল্ল-দেবেশ-কিন্নর রায়, জ্যোতিরিন্দ্র-মতি নন্দী, শ্যামল-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সৈয়দ শামসুল হক-হাসান আজিজুল হক-মাহমুদুল হক বা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও শহীদুল জহির, স্বপ্নময় চক্রবর্তী বা রবিশংকর বল, শৈবাল-অমর মিত্রসহ আরও আরও লেখক-যাঁদের লেখায় উঠে এসেছে বাঙালি জাতটার নানান সংগতি-অসংগতি ও বিচিত্র খাসলতের বৃত্তান্ত; তাতে এত কিছুর পরও কিছু বিষয় আছে যা প্রায় সবার লেখায় কমবেশি খুঁজে পাওয়া যাবে। কারণ বাঙালির একটা সীমা রয়েছে, বাংলাদেশেরও একটা সীমা রয়েছে।

এ তো গেল, বাঙালির বাংলায় লেখা আধুনিক সাহিত্যের একটা অতিসংক্ষিপ্ত রূপরেখা, এর বাইরেও বাঙালি অনেক লেখকই ইংরেজিতে লিখছেন। রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি প্রবন্ধে পড়েওছিলাম যে, ভবিষ্যতের বাংলা সাহিত্য ইংরেজিতে লেখা হবে। সে যা-ই হোক। তো স্বয়ং অরুন্ধতী রায়ের ভেতরে আছে বাঙালি রক্ত, ভারতী মুখার্জি, অমিতাভ ঘোষ, উপমান্যু চ্যাটার্জি, ঝুম্পা লাহিড়ী, অমিত চৌধুরী, কুনাল বসুসহ আরও অনেক বাঙালি ইংরেজিতেই লিখছেন। এঁদের বেশির ভাগই ভারতীয়। এদিকে ধীরে হলেও একটু একটু করে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইংরেজি-ভাষী লেখকদের যাত্রা শুরু হয়েছে। এঁদের ভেতরে ঔপন্যাসিক হিসেবে জিয়া হায়দার রহমান, তাহমিমা আনাম, কাজী আনিস আহমেদ প্রমুখ রয়েছেন। খুব স্বাভাবিকভাবে অন্য ভাষায় সাহিত্য রচনা করতে গেলে তার অনেক কিছু আর নিজ ভাষার মতো থাকে না। আর আধুনিক সাহিত্যের জটিল নির্মাণের ভেতরে জড়িয়ে পড়ে এমন কিছু বিষয় তাতে-এর টেক্সট কেবল এর ভেতরেই আবদ্ধ থাকে না। আর রোলাঁ বার্তের ‘লেখকের মৃত্যু’র সূত্রে যদিও অনেকটা স্বাধীনভাবে কোনো লেখককে বিচার করার সুযোগ পাওয়া যায়, তবু একদম আরোপিত কিছু তো আর চাপিয়ে দেয়া চলে না। সেদিক থেকে, কাজী আনিস আহমেদের ‘ফোর্টি স্টেপস’ নামের ছোট উপন্যাসটিকে বিচার করার চেষ্টা করা হয়েছে এই রচনায়।

 

২.

কাজী আনিস আহমেদের ইংরেজিতে লেখা একটি ছোট উপন্যাস, যাকে প্রচলিত বাংলায় উপন্যাসিকাও বলা হয়, যা ‘ফোর্টি স্টেপস’ শিরোনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘মিনিসোটা রিভিউ’তে প্রকাশিত হয় ২০০০ সালে। পরে ২০০৬ সালের দিকে ‘চল্লিশ কদম’ নামে এটি বাংলায় অনূদিত হয় মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে। আমরা এ লেখায় একে ‘চল্লিশ কদম’ নামেই উল্লেখ করব।

এর গল্পটি কবরে রেখে আসা হয়েছে শিকদার সাহেবের লাশের জেগে ওঠার গল্প। মৃত ভেবে তাকে রেখে আসা হয়েছে, কিন্তু কবরের ভেতরে চোখ মেলে তাকাচ্ছেন তিনি, আর অপেক্ষা করছেন মুনকার-নাকির কখন আসবেন। গুনছেন শেষ লোকটি চলে যাওয়ার পদক্ষেপগুলো। মুসলিম সম্প্রদায়ের বিশ্বাস অনুযায়ী, মৃতকে সমাহিত করার পর সর্বশেষ ব্যক্তিটি যখন তার কাছ থেকে চল্লিশ পা দূরে চলে যায় তখনই মুনকার-নাকির আসেন তার আমলনামা নিয়ে।-এই দিয়ে কাহিনিটি শুরু হয়। পাঠক এই উপন্যাসিকাটি পড়ার শেষেও একটি ধন্দে পড়ে থাকেন-আদতে শিকদার সাহেবের প্রতীকে, এই উপন্যাসিকাটির নানান ও বিচিত্র চিত্রকল্পে কী ঘটল-মৃত শিকদার সাহেবের চিন্তাপ্রবাহের ভেতর তৈরি হওয়া জামশেদপুরের একটি অঞ্চলের কাহিনিই কি এর মূল উপজীব্য?-নানান প্রশ্ন জেগে ওঠে। পড়ার পরও এর রেশ থেকে যায়; তাড়া করে ফেরে আমাদের।

লক্ষণীয়, বাংলাদেশে স্বাধীনতাও ২০০০ সালে স্বাধীনতার তিনের দশক পাড়ি দিয়েছিল, সামনে চারের দশক। মানে চল্লিশ বছরের দিকে যাবে। পাকিস্তানকে ১৯৭১ সালে কবর দিয়ে আমরা হেঁটে এসেছি ২৯ বছর। সামনে  উনচল্লিশ, তারপর চল্লিশ। শুরু হবে মৃত অখণ্ড পাকিস্তানের অংশ পূর্ব পাকিস্তানের আমলনামা যাচাই-যে পূর্ব পাকিস্তান মৃত হলেও তার মানসিকতায় সজীব দ্বিজাতিতত্ত্বের ভূত। হ্যাঁ, বর্তমানে তো আমরা ৩৯-ও পেরিয়ে গেছি। এই ৩৯ বছরেরও পাকিস্তানি-মানসিকতার হাত থেকে মুক্ত হতে পারেনি এ দেশের মানুষ।-এই দিক থেকে দেখা গেলে তো যেতেই পারে কাজী আনিস আহমেদের উপন্যাসটি; কিন্তু উপন্যাসের ভেতরে গহিনে আছে আরও অনেক বিষয়, তাতে মনে হয়, কেবল পাকিস্তানকে না, আমরা যে ব্রিটিশ শাসনকে মৃত মনে করে কবরস্থ করেছি, আদতে সেই শাসনের অভিঘাত রয়ে গেছে অটুট। আর ‘চল্লিশ কদম’ উপন্যাসিকাটির পটভূমিতে মনে হতে পারে, এটি কেবল পূর্ব বাংলা বা বর্তমান বাংলাদেশে নয়, এটি ঘটেছে ভারতীয় উপমহাদেশের যেকোনো জায়গায়। বা বলা যায় পুরো ভারতীয় উপমহাদেশের অণুবিশ্ব হয়ে উঠেছে ‘চল্লিশ কদম’-এ থাকা জামশেদপুরের এই কাহিনি-যেভাবে উইলিয়াম ফকনার ইউকোনাপাটাউফাকে করে তোলেন আমেরিকার অণুবিশ্ব, আর কে নারায়ণ মালগুড়িতে করে তোলেন ভারতের যেকোনো অঞ্চলের প্রতিরূপ, যেভাবে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্-র ‘লালসালু’র মহব্বতনগর গ্রাম হয়ে ওঠে বাঙালি মুসলমানের অণুবিশ্ব, যেভাবে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস মাকোন্দোকে করে তোলেন লাতিন আমেরিকার বাস্তবতার প্রতিনিধিত্বশীল রচনা, বা সৈয়দ শামসুল হক জলেশ্বরীকে গড়েন বাংলাদেশের যেকোনো অঞ্চলের সারনির্যাসসহ নিয়ে, ঠিক তেমন করে কাজী আনিস আহমেদের জামশেদপুর হয়ে উঠেছে ভারতীয় উপমহাদেশের যেকোনো অঞ্চলের কাহিনি, যে অঞ্চল ব্রিটিশরা ছেড়ে গেলেও রেখে গেছে তাদের মানসিকতার ভৌতিক প্রতিরূপ এর প্রতিটি ক্ষেত্রে।

ইংরেজিতে লেখা ‘ফোর্টি স্টেপস’ এক নির্মেদ কাহিনি। কোথাও বলতে গেলে বাড়তি কিছু নেই। যেখানে যতটুকু যে পরিমাণে প্রয়োজন, তার চেয়ে একরত্তি বাড়তি শব্দ খরচ করেননি কাজী আনিস আহমেদ। বাংলায় অনুবাদ করতে গিয়ে অবিসংবাদিত অনুবাদক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই বিষয়টি বিশেষ দক্ষতার সঙ্গে ভাষান্তরিত করেছেন। সবচেয়ে বড় দিক হলো এ উপন্যাসিকাটি পড়তে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চারপাশ থেকে বর্তমান সময় উবে যায়। আমরা চলে যেতে বাধ্য হই এমন এক জগতে যে জগৎ ছিল কিন্তু এখন নেই, আবার তা না থেকেও গভীরভাবে আছে-এমন একটা আবহ তৈরি হয়েছে ‘চল্লিশ কদম’-এ। যেমন, জামশেদপুরে প্রতœতাত্তি¡করা খননের কাজ করতে এসে একটি মসজিদ পায় যা আগে মন্দির ছিল-তারা এর নানান প্রমাণ পায়; আর এ কথা ছড়িয়ে পড়লে সেখানকার হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বেধে কয়েকটি খুন ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে-এতে স্বাভাবিকভাবে বাবরি মসজিদ-রাম মন্দির বির্তকের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েক দশক ধরে চলা ভারতীয় সাম্প্রদায়িকতার চেহারাটা আমরা ফের দেখতে পাই; যে সাম্প্রদায়িকতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিল ব্রিটিশ শাসকেরা ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নামের ভয়ংকর ইতরসুলভ মানসিকতায়। ‘চল্লিশ কদম’-এর কাহিনি তাই আর অতীতের কাহিনি হয়ে থাকে না, তা বর্তমানেও হানা দেয়। এভাবেই এর জামশেদপুর হয়ে ওঠে ভারতীয় নানান সংকটের প্রতিরূপ।

এ উপন্যাসিকার কুশীলব খুব বেশি নেই। একদিকে শিকদার সাহেব ও ইয়াকুব মোল্লা, অন্যদিকে জহির সাহেব, তার অপরূপা কন্যা নূরজাহান-যাকে সুকৌশলে নিজের জীবনসঙ্গী করতে পেরেছিল শিকদার। কিন্তু কাহিনির ছোট-বড় সব সংকটের যে কটা এখানে হাজির হয়-এগুলোর চূড়ান্তে ছিল ডসন ও নূরজাহানের নিহিত সম্পর্ক, আর নূরজাহানের জন্মেই মরে যাওয়া বা মরেই ভূমিষ্ঠ হওয়া সোনালি চুল নিয়ে শিশুকন্যা।

আমরা দেখি, ইয়াকুব মোল্লা ও শিকদার সাহেবের লক্ষ্য ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি অর্জন। লক্ষণীয় এখানে ধর্ম ও ক্ষমতা যেন জোড়বাঁধা এ আখ্যানের দুজন প্রতিনিধিত্বশীল মানুষের হাতে। জাল দলিল তৈরি, জমি দখল ইত্যাদি কাজ দুজনের যোগসাজশে ঘটতে থাকে; যদিও তা প্রকট করে এখানে হাজির করা হয়নি, বরং শিকদার ও ডসনের সম্পর্কটা যতটা সামনে আসে, শিকদার ও ইয়াকুব মোল্লার সম্পর্ক সে অর্থে প্রচ্ছন্নই থাকে। কারণ একান্ত ব্যক্তিগত জীবনে ইয়াকুব মোল্লা নয়, হানা দেয় ডসন। শিকদারকে শিল্পমোদী তৈরি করতে, নিজের চারুকলার নানান কিছুর সঙ্গে পরিচিত করাতে ডসনকে শুরু থেকে দেখতে পাই। ইউরোপীয় এই যুবক, তথা ইংরেজ এই যুবক, প্রচণ্ড অসুস্থ হলে শিকদার তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে। সেরে ওঠার পরও ঠাঁই পায় তার বাড়িতে। সে হয়ে ওঠে নূরজাহানের ইংরেজি শেখার মাস্টার। এরই সূত্রে দুজনের মধ্যে তৈরি হয় নিবিড় গভীর সম্পর্ক। পরবর্তীকালে ইয়াকুব মোল্লা কৌশলে ডসনকে বাড়ি থেকে সরিয়ে অন্যত্র থাকার ব্যবস্থা করলেও রয়ে যায় আরেকটি কাহিনির সম্ভাবনা; আর সেই সম্ভাবনার বীজে নূরজাহান প্রসব করে মৃত শিশু।

এখানে আমরা শিকদারকে পাই ঔপনিবেশিক মানসিকতার প্রতিভূ হিসেবে। ডসন স্বয়ং উপনিবেশ স্থাপনকারীদের প্রতিনিধি, আর ইয়াকুব মোল্লা হয়ে ওঠে ধর্মীয় রক্ষণশীলতা, কখনো কখনো ধর্মীয় অন্ধত্বের প্রতীক। তাহলে নূরজাহান? তাকে বলা যায়, ঔপনিবেশিকতার বিচ্যুতি; যার ফলে সে জন্ম দিতে গিয়েও মৃত শিশুর জন্ম দেয়। ফলে, পুরো উপন্যাসটি পাঠ করে ফের আমাদের মনে হতেই পারে-আমাদের সাম্প্রতিক প্রায় সমস্ত সংকটের চাবিকাঠি হলো একটি বিশেষ মানসিকতা, আর তা হলো ‘কলোনিয়াল মাইন্ডসেট’ বা ঔপনিবেশিক মানসকাঠামো। ফলে বি-উপনিবেশায়ন ছাড়া আমাদের সামাজিক রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক, সর্বোপরি সামগ্রিক মুক্তি সম্ভব নয়-এই বিষয়টিই যেন ‘চল্লিশ কদম’ পাঠের নিট ফল হয়ে দাঁড়ায়।

মজার ব্যাপার হলো, আখ্যানটি লেখা হয়েছে ইংরেজি ভাষায়, যে ভাষা আমরা ব্রিটিশের কাছেই পেয়েছি, কিন্তু পৃথিবীর নানান স্থানের মতো এই ইংরেজি ভাষাতেই, কি প্রভুত্বকারী শক্তির প্রতিনিধিত্বকারী ভাষাতেই, প্রখরভাবে হাজির হয়েছে সেই লেখকেরা-যাঁরা ঔপনিবেশিক মানসকাঠামোর হাত থেকে মুক্ত করতে চান স্বদেশকে, কি একটি গোটা মহাদেশকে; যেমন এমে সেজায়ার, ফ্রাঞ্জ ফানো, এডওয়ার্ড সাঈদ কি নগগু ওয়া থিয়াঙ্গো কি আশিল এমবেমবের মতো মানুষেরা। আখ্যানের ভেতর দিয়ে সেই বিষয়টি উদ্ভাসিত করেছেন কাজী আনিস আহমেদ বা উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।

কারও কারও মতে, উমবার্তো একোর ‘দ্য নোম অব দ্য রোজে’র সর্বত্র যেমন ইউরোপীয় মধ্যযুগকে দেখা যায়, ‘চল্লিশ কদম’-এর মতো এই ছোট উপন্যাসের সবখানে মূলত ঔপনিবেশিকতা-লাঞ্ছিত ভারতীয় মানস ও মানসিকতা লালিত মানুষদের দেখা যায়। বিশেষ করে, ডসনের মতো সাহেব তথা বিদেশি-বিভাষী লোক মফস্বলে বসবাস করে জামশেদপুরের মতো এক এলাকায়, এতে প্রমাণিত হয়, এটি যদি বাস্তবে দেরাদুন বা দার্জিলিং বা উত্তর প্রদেশ এমনকি পাকিস্তানের লাহোর রয়ালপিন্ডি বা পাঞ্জাবের কোনো অঞ্চল হতেও পারত, আর অবশ্যই বাংলাদেশেরও কোনো অঞ্চল।

 

৩.

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘দ্য থার্ড রেজিগনেশন’-এর মৃত, বা খুশবন্ত সিংয়ের ‘পোস্টথিউমাস’-এর লোকটির মৃত্যুর ছলের সঙ্গে ‘চল্লিশ কদম’-এর মৃত্যুর মিল-অমিল খোঁজা যেতেই পারে। অন্য দিকে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ বক্সীর ‘রক্তের দাগ’ গল্পের ক্যাসানোভা বা ডন জুয়ান ধাঁচের চরিত্র সত্যকামের মতো নয় ‘চল্লিশ কদম’-এর ডসন, কিন্তু নূরজাহানের সঙ্গে সুচিত্রা দাস; এবং শিকদারের সঙ্গে ঊষাপতি দাসের একধরনের মিল আছে বৈকি। নূরজাহান তার উদারমনা পিতা জহিরের প্রশ্রয়ে পুরুষসঙ্গ সুচিত্রার মতো উগ্র পর্যায়ে না করলেও তার দুর্নাম রটে এ নিয়ে। অন্যদিকে জহিরের মতো বিত্তবান শ্বশুর পেয়ে ঊষাপতির মতো শিকদারের শ্রেণিচরিত্র বাহ্যিকভাবে পাল্টে যায়, কিন্তু তলে রয়ে যায় রূপবতী নূরজাহানের বিশেষ চরিত্র যাতে উপ্ত থাকে পরবর্তী সংকটের বীজ।

‘চল্লিশ কদম’-এর মতোই ভারত ভাগের পরপরই তৈরি হয় ‘রক্তের দাগে’র ঘটনা। এবং যে আদিম রিপুর তাড়নায় ছিন্নভিন্ন হয় সত্যকামের জীবন ও বাস্তবতা তার প্রকটতা ‘চল্লিশ কদম’-এর উপরিকাঠামোতে নেই। কিন্তু অবকাঠামোর ভেতরে ফিরে পাই সেই আদিম রিপুরই তাড়না। মোদ্দা কথা, এই যে উপনিবেশের অভিঘাতে যা হয়েছিল ‘রক্তের দাগে’ একভাবে, একটি খুনের ভেতর দিয়ে; অন্যদিকে, তা-ই হয়েছে আরেকভাবে ‘চল্লিশ কদম’-এ, একটি মৃত্যুতে, হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে। দুজায়গায়ই নব্য ধনী হয়ে ওঠা ও লুটপাট দখলের হোলিখেলায় মেতে ওঠা একটি শ্রেণি ও কিছু লোকের বাস্তবতা আমাদের বিমূঢ় করে দেয়। তাই বলা যায়, ঔপনিবেশিক মানসিকতাটি না বুঝলে এই দুই আখ্যানের পরিণতি বোঝায় একটা আবছাপনা রয়ে যাবে।

আবার অন্যদিকও আছে। সেটা আরও নিহিত, আরও গভীর। শিকদারের মৃত্যুর পেছনে নিজের দাম্পত্য সংকট, চাপা অবিশ্বাসের অন্তর্মুখী পচন তো ছিল, নইলে সে ভেতরে-ভেতরে দুর্বল হয়ে গিয়েছিল কীভাবে? আর তার মৃত্যুর পর আপাত-শোকসন্তপ্ত নূরজাহানকে যখন ডসন এসে বলে, ‘ইউ ক্যান নেভার টেল হোয়েন সামথিং উইল হ্যাপেন (কখন যে কী ঘটবে আগে থেকে তুমি জানোই না তো বলবে কী)।’ চকিতে তা জোড়া লাগে বাংলা সাহিত্যের, বলতে গেলে সর্বশেষ ‘সেন্সেশনাল নভেল’ নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘হারবার্ট’-এর সঙ্গে।

তোশক, বালিশ সবসুদ্ধ যখন হারবার্টের মৃতদেহ দাহ করতে বৈদ্যুতিক চুল্লিতে ঢোকানো হয়, দাহ শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণে পুরো শ্মশানের সবকিছু  ধ্বংসস্ত‚পে পরিণত হয়, নেমে আসে অন্ধকার। আসলে তো ওই তোশকের ভেতরে লুকানো ছিল বিস্ফোরক, নকশাল আন্দোলনের সময়ে ধরপাকড়ের সময় লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। পরে পরিস্থিতিকে বর্ণনা করা হচ্ছে এভাবে যে, ‘হারবার্টের রক্তহীন মৃতদেহ দাহ করার সময় যে জঘন্য ঘটনা ঘটেছিল তা অবধারিতভাবে এই ইঙ্গিতই দিয়ে চলে যে কখন, কীভাবে বিস্ফোরণ ঘটবে এবং কে তা ঘটাবে সে সম্বন্ধে জানতে রাষ্ট্রযন্ত্রের এখনো বাকি আছে।’-ঠিক এখানে ‘চল্লিশ কদম’-এ বলা ডসনের কথাটি মিলে গিয়েও আলাদা হয়ে যায়। তদুপরি হারবার্টে বিস্ফোরণ ঘটে গিয়েছিল, কিন্তু ‘চল্লিশ কদম’-এ বিস্ফোরণের বীজ পোঁতা আছে; সেটি বিস্ফোরণ ঘটানোর অভিমুখ তৈরি করেছে মাত্র। আর সেই অভিমুখ হলো যে ভুলে দেশভাগে ঘটেছিল-তার জবাব ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীন বাংলাদেশের উদ্ভব। বলা বাহুল্য ‘চল্লিশ কদম’ পড়তে গিয়ে এটা অন্তত এর আখ্যানের ওপরতলে একেবারেই বোঝা যায়নি। কিন্তু মজার ব্যাপার আরও যে, ঠিক এই ছকেও ‘চল্লিশ কদম’কে এঁটে দেয়া যাচ্ছে না। কারণ, ঔপনিবেশিকতার দিকটি চিহ্নিত করার বেশি আর কিছু বলতে গেলে তা আরোপিতই শোনাবে। কিন্তু শিকদার নামের ঔপনিবেশিকতার আপাত-সমাধি হলেও এবং তার আমলনামা যাচাই-বাছাই করার কাজটি তেমনভাবে শুরু হয়নি-বা হওয়ার অপেক্ষায়-‘চল্লিশ কদম’-এর এই ইঙ্গিত আমাদের নিশ্চয়ই একটি নয়, অনেক এবং অসংখ্য বিস্ফোরণের দিকে যে নিয়ে যেতে পারে, তা জোরদারভাবেই বলা যায়।

আরও পড়ুন :

জীবন লিখতে লিখতে | জহর সেনমজুমদার 

ক্ষমতার পঠন : ইতিহাস আর উপন্যাসের বোঝাপড়া | সুমন রহমান

স্বপ্ন নেই, আশাভঙ্গও নেই | সেবন্তী ঘোষ
দোটানার বৃত্ত | আফসানা বেগম 

বিস্ময়মুগ্ধতা ও ডুবসাঁতার | মোস্তাক আহমেদ

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ক্রিমিয়া উপকূলে রুশ সামরিক উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত
ক্রিমিয়া উপকূলে রুশ সামরিক উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত
হোয়াইট হাউজের বিড়াল নিয়ে বই প্রকাশ করবেন মার্কিন ফার্স্টলেডি
হোয়াইট হাউজের বিড়াল নিয়ে বই প্রকাশ করবেন মার্কিন ফার্স্টলেডি
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
আশরাফুলের হ্যাটট্রিকে আবাহনীর টানা ৮ জয়
আশরাফুলের হ্যাটট্রিকে আবাহনীর টানা ৮ জয়
সর্বাধিক পঠিত
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!