X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘না হইয়া ডাক্তার, হইলাম না কেন আক্তার’

প্রভাষ আমিন
২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ২০:১৪আপডেট : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ২০:১৬

প্রভাষ আমিন এ যেন রিলে রেস। স্বাস্থ্য অধিদফতরের বরখাস্ত হওয়া হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবজাল হোসেনকে যেদিন ১৪ দিনের রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হয়, সেদিনই গ্রেফতার হন স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাড়িচালক আব্দুল মালেক। পরদিন তাকেও ১৪ দিনের রিমান্ডে পাঠানো হয়েছে। আবজালের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে হাজার কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগ এসেছে। আর আবজালের যোগ্য উত্তরসূরি মালেকের শত কোটি টাকার সম্পদের খোঁজ মিলেছে। ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই মালেকের হাত ধরে আরও সম্পদের দিকে এগিয়ে যেতে পারবো আমরা।
বরখাস্ত হওয়ার আগে আবজাল ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। বেতন পেতেন সাকুল্যে ৩০ হাজার টাকা। আর গ্রেফতার হওয়ার আগে আব্দুল মালেক ছিলেন স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালকের গাড়িচালক। বেতন পেতেন ২৬ হাজার টাকার মতো। তাহলে স্বাস্থ্য অধিদফতরে কি আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ পাওয়া যায়? নাকি ওখানে কোনও গুপ্তধন আছে? নইলে এমন শত কোটি, হাজার কোটি আসে কোত্থেকে, কীভাবে? গত ১৫ জুলাই এই কলামে ‘স্বাস্থ্য খাতের কালো বেড়ালের খোঁজে’ শিরোনামে লিখেছিলাম, ‘স্বাস্থ্য অধিদফতরের দুর্নীতি রীতিমতো রূপকথার মতো। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর হাজার কোটি টাকা— এই গল্প তো রূপকথার বইয়েই পাওয়া যায়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের আবজাল সেই রূপকথাকে বাস্তব করেছেন। তবে স্বাস্থ্য খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরে আবজাল একজন নয়, সেখানে আবজালদের ছড়াছড়ি, আবজালদেরই রাজত্ব। হয়তো কোনও কারণে এক আবজাল ধরা খেয়ে গেছে। এখন আবার মিঠু সিন্ডিকেটের নাম শুনছি। স্বাস্থ্য অধিদফতরে যেহেতু কেনাকাটা বেশি, তাই দুর্নীতিও বেশি। অপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনা, বেশি দামে কেনা, এক জিনিস দেওয়ার কথা বলে আরেক জিনিস গছিয়ে দেওয়া– দুর্নীতির হরেক রকমের মাত্রা আছে স্বাস্থ্য অধিদফতরে।
বিভিন্ন হাসপাতালে এমন সব জিনিস কেনা হয়, যা কোনোদিন খোলাই হয় না। দেখা গেলো কোনও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এমআরআই মেশিন আছে, কিন্তু অপারেটর নেই। ৯ লাখ টাকার জিনিস কেনা হয় ৯০ লাখ টাকায়। বিল করা হয় আমেরিকান পণ্যের, সরবরাহ করা হয় চাইনিজ। ঠিকাদারদের দায়িত্ব গছিয়ে দেওয়া। টেবিলের দুই প্রান্তের মানুষের মধ্যে সমঝোতা থাকলে ‘গছাগছি’তে সমস্যা হয় না। দুই প্রান্তে সমঝোতা থাকলে লেনদেন টেবিলের ওপর দিয়েই হতে পারে, পণ্যের মান বা প্রয়োজন থাকুক বা না থাকুক।’ পরিস্থিতি বদলায় তো নাই-ই, বরং মালেক ড্রাইভার প্রমাণ করলেন স্বাস্থ্য অধিদফতরে আবজাল-মালেকদেরই রাজত্ব।
চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী আবজাল হাঁকান হ্যারিয়ার গাড়ি। ঢাকার উত্তরায় তার বাড়ি আছে পাঁচটি, আরেকটি আছে অস্ট্রেলিয়ায়। দেশের বিভিন্ন এলাকায় আছে অন্তত ২৪টি প্লট ও ফ্ল্যাট। দেশে-বিদেশে আছে বাড়ি-মার্কেটসহ হাজার কোটি টাকার সম্পদ। আর মালেকের আছে ২৪টি ফ্ল্যাট, ৩টি বাড়ি, গবাদিপশুর খামার। তিনি অবশ্য আরও চালাক। আবজালের মতো গাড়ি কেনেননি। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালকের পাজেরো গাড়িটিই তার পছন্দ ছিল। সেই পাজেরো চালানোর জন্য মালেক আবার ড্রাইভার নিয়োগ দিয়েছিলেন। আমার জানতে ইচ্ছা করছে, মালেক সাহেবের ড্রাইভার কীভাবে নিজের পরিচয় দিতেন? আমি ড্রাইভার স্যারের ড্রাইভার নাকি আমি ড্রাইভার স্যারের গাড়ি চালাই। পুরো বিষয়টাই পিলে চমকানোর মতো।
একজন মানুষের কয়টি বাড়ি লাগে, কত টাকা লাগে? তারচেয়ে বড় কথা হলো, ২৫-৩০ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করে হাজার কোটি টাকা কামানোর উপায় কী? আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের দৈত্যের কথা বলেছি বটে। কিন্তু আমার মনে হয় দৈত্যের পক্ষেও এত দ্রুত এত টাকা কামানো সম্ভব নয়। আবজাল আর মালেক যদি ‘টাকা কামানোর সহজ তরিকা’ নামে একটা বই লেখেন সেটাও বেস্ট সেলার হবে। তারা কীভাবে এত টাকা অর্জন করেন? এই প্রশ্নের জবাবেই লুকিয়ে আছে সব রহস্য। স্বাস্থ্য অধিদফতরের দুর্নীতির কথা সংশ্লিষ্ট সবাই জানেন। আমি জীবনে কখনও স্বাস্থ্য অধিদফতরে যাইনি। উড়তে উড়তে আমার কাছেই যত দুর্নীতির খবর আসে। যারা ভেতরে থাকেন, তারা নিশ্চয়ই আরও বেশি করে জানেন। কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাই বিচারহীনতার সুযোগে আবজাল-মালেকরা বেড়ে উঠেছে। মনে করার বা বিশ্বাস করার কোনও কারণই নেই যে স্বাস্থ্য অধিদফতরে শুধু এই দুজনই দুর্নীতি করেন। আর বাকিরা সব সাধু। তেমন হলে এই দুজন অনেক আগেই ধরা পড়তেন। বরং এর উল্টোটা হওয়া সম্ভব। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ইট-পাথরও নাকি দুর্নীতি করে। দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাস্থ্য অধিদফতরের আরও ৭৫ জনের সম্পদের অনুসন্ধান করছে। এদের বেশিরভাগই তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। তাতে একটা ধারণা হতে পারে, স্বাস্থ্য অধিদফতরে শুধু কর্মচারীরাই দুর্নীতি করেন, কর্মকর্তারা ধোয়া তুলসি পাতা। এটা একটা রহস্য বটে। কিন্তু আবজাল বা মালেকের তো কোনও কিছু অনুমোদন করার বা কাউকে চাকরি দেওয়ার ক্ষমতা নেই। তারা নিশ্চয়ই কাউকে দিয়ে কাজ করান। কোনও ক্ষমতা না থাকা আবজাল-মালেকদেরই যদি হাজার কোটি, শত কোটি টাকা থাকে; তাহলে স্বাস্থ্য অধিদফতরে যাদের সত্যিকারের ক্ষমতা আছে তাদের সম্পদ কত? আবজাল-মালেকরা যাদের মাধ্যমে কাজ হাসিল করেছেন, তারা কারা, তারা কোথায়? অবশ্য যে প্রতিষ্ঠানের গাড়িচালক আর মহাপরিচালক দুদকের তালিকায়, সেই প্রতিষ্ঠান নিয়ে খুব বেশি আলোচনা করে লাভ নেই। হয়তো দুর্নীতিটাই সেখানে স্বাভাবিক নীতি।
করোনাকালে স্বাস্থ্য অধিদফতর আলোচনার কেন্দ্রে। তেমনটাই হওয়ার কথা। করোনা ব্যবস্থাপনায় তারা কতটা সফল বা ব্যর্থ, আলোচনা হতে পারতো সেটা নিয়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো, আলোচনা হচ্ছে দুর্নীতি নিয়ে। এন-৯৫ মাস্ক কেলেঙ্কারি, জেএমআই, রিজেন্ট, জেকেজি, সাবরিনা, সাহেদ, আজাদ, আবজাল, মালেকরাই আলোচনায় রেখেছে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে। অবশ্য শুধু স্বাস্থ্য অধিদফতর নয়, গোটা বাংলাদেশেই দুর্নীতিই এখন স্বাভাবিক নীতিতে পরিণত হয়েছে। এখন কার চেয়ে কে কম দুর্নীতি করেন, সেটা মাপা হয়। কম বেশিটা কিন্তু হয় সুযোগের ওপর। সুযোগ পেলে যেন বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষই এখন দুর্নীতিতে জড়াবেন। এখন কেউ যদি ঘুষ নিয়ে কাজ করে দেন, তাহলে পরোপকারী, ভালো মানুষ, মানুষের সেবা করেছেন বলা হয়। সত্যিকারের দুর্নীতিবাজ হলো তারা, যারা টাকা নিয়েও কাজ করে দেয় না। যেমন ড্রাইভার মালেক নাকি স্বাস্থ্য সহকারী পদে শতাধিক মানুষকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ধরে নিচ্ছি, সেই একশ’ জনের কাছ থেকেই তিনি মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছিলেন। আমার ধারণা, মালেককে টাকা দিয়ে নিয়োগ পাওয়া স্বাস্থ্য সহকারীদের কাছে তিনি ভালো মানুষ, টাকা নিয়ে চাকরি তো দিয়েছেন। দুর্নীতি সম্পর্কে আমাদের পারসেপশনটাই বদলে গেছে। বিয়ের আলোচনায় ছেলের ‘উপরি আয়’ নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হয়। ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত আবজাল-মালেকরা সমাজে নন্দিত। আমরা না হয় জানি না, কিন্তু আবজাল বা মালেকের পরিবারের সদস্য, স্বজন বা প্রতিবেশীরা কেউ কি কোনোদিন তাদের প্রশ্ন করেছেন, সামান্য ড্রাইভার বা কেরানি হয়ে তুমি এত টাকা কোথায় পেলে? সামাজিক প্রতিরোধ এবং সম্মিলিত ঘৃণা ছাড়া দুর্নীতি ঠেকানো খুব কঠিন। কিন্তু হয় উল্টোটা। দুর্নীতি করে অর্জিত অর্থে দান-খয়রাত করে দুর্নীতিবাজরা এক ধরনের সামাজিক সম্মানও কিনে নেন।
তবে এই দুর্নীতি সাম্প্রতিক প্রবণতা নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল হাসান খান সেদিন এক টকশো’তে বলছিলেন, আশির দশকের শুরুতে তারা যখন ছাত্র, তখন মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের মধ্যে একটা স্লোগান খুব জনপ্রিয় ছিল, ‘না হইয়া ডাক্তার, হইলাম না কেন আক্তার’। এই আক্তার তখন স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। কিন্তু অসীম তার ক্ষমতা। সদ্য চাকরি পাওয়া ডাক্তারদের বদলি-পোস্টিং সব তার হাতে। এখনকার ডাক্তাররা হয়তো স্লোগান দেবে, না হইয়া ডাক্তার, হইলাম না কেন ড্রাইভার।
এ যেন এক পরম্পরা। আক্তারদের উত্তরসূরি আবজাল-মালেকরা। শুরুতে যে রিলে রেসের কথা বলছিলাম, মালেকের পর দুর্নীতির ব্যাটন কার হাতে যাবে? তবে আবজাল-মালেকরা তো চুনোপুঁটি। সবাই চুনোপুঁটি নিয়ে ব্যস্ত থাকার ফাঁকে যেন রাঘব বোয়ালরা পার পেয়ে না যায়। দুদকের নজর যেন একটু ওপরের দিকেও ওঠে। 

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাচ্ছেন তাইওয়ানের প্রতিনিধি
যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাচ্ছেন তাইওয়ানের প্রতিনিধি
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ