পার্বত্য জেলা রাঙামাটির পর্যটন খাত সম্ভাবনাময় হলেও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে আকর্ষণীয়ভাবে গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি আজও। কাপ্তাই লেক সৃষ্টির সময় পর্যটনকে অন্যতম আয়ের উৎস ধরা হয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ীদের মন্তব্য, তেমন কোনও উন্নয়ন ও অবকাঠামো তৈরি না হওয়ায় পর্যটকরা রাঙামাটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
শহরের ডিসি বাংলা পার্ক, জেলা প্রশাসকের রাঙামাটি পার্ক, জেলা পুলিশের তত্ত্বাবধানে পলওয়েল পার্ক ও সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে আরণ্যক হ্যাপি আইল্যাল্ডে জেলার ভ্রমণপ্রেমীদেরই বেশি দেখা যায়। ব্যক্তি উদ্যোগে কিছু পর্যটন স্পট তৈরি হলেও পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকায় আশা পূরণ হচ্ছে না।
ডিভাইন লেক অ্যাইল্যান্ডের স্বত্বাধিকারী মো. ইমতিয়াজ আসাদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা নিজ উদ্যোগে কিছু রিসোর্ট করেছি। পর্যটন আকর্ষণের জন্য জেলা পরিষদ অনেক উদ্যোগ নিলেও গত কয়েক বছরে কিছুই চোখে পড়েনি। বর্তমানে পর্যটকরা রাঙামাটি এসে হতাশ হয়ে ফিরে যান। কারণ গত ১০ বছরে তেমন কোনও পরিবর্তন আসেনি পর্যটন খাতে।’
জেলা শহরের বাইরে কাপ্তাই যাওয়ার পথে আসামবস্তি সেতু, বেরান্না ও বরগাংয়ে প্রতিদিন শত শত ভ্রমণপিপাসু বেড়ান। কিন্তু এসব স্থানে বিদ্যুতের সুবিধা না থাকায় জেনারেটর চালিয়ে জ্বালানি কিনে ব্যবসা করতে হচ্ছে। এ কারণে আগ্রহ থাকলেও নতুন করে কেউ ব্যবসায় নামতে চাচ্ছেন না।
রাঙামাটি সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান অরুণ বিকাশ চাকমা মনে করেন, পর্যটন খাত যেহেতু জেলা পরিষদের হাতে ন্যস্ত, তাই উন্নয়নের উদ্যোগ নিতে হবে তাদেরই। স্থানীয় উদ্যোক্তাদের ব্যবসার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিতে জেলা পরিষদকে সহায়তা করার আহ্বান জানান তিনি।
পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী ২০১৪ সালে জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করা হয় স্থানীয় পর্যটনের ৩৩ ভাগ। পর্যটন করপোরেশনের লাভের ১০ শতাংশ পরিষদকে দেওয়ার কথা রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মন্তব্য, মূলত এ নিয়ে টানাটানিতে আটকে আছে পর্যটনের উন্নয়ন।
পাহাড়ি পর্যটন জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তরের পরও উল্লেখযোগ্য তেমন উন্নয়ন হয়নি বলে অভিযোগ স্থানীয় উদ্যোক্তাদের। গত ছয় বছরে পর্যটন করপোরেশন কোনও টাকা দেয়নি বলে দাবি জেলা পরিষদের। একইভাবে জেলা পরিষদ কোনও অবকাঠামো তৈরিতে তেমন একটা আগ্রহ দেখায়নি। প্রতিবছর জেলা পরিষদের বাজেটে বরাদ্দ রাখা হলেও বছর শেষে কোনও খরচ করা হয় না।
যদিও রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বৃষ কেতুর দাবি, ‘স্থানীয় পর্যটন নামেমাত্র হস্তান্তর হয়েছে। এটাকে কোনোভাবেই হস্তান্তর বলা যাবে না। পর্যটন থেকে বছর শেষে ১০ ভাগ লভ্যাংশ দেওয়ার কথা থাকলেও ২০১৪ সালের পর এখনও এক টাকাও আমাদের দেওয়া হয়নি। আর আমরা যে বাজেট প্রণয়ন করি তার বাইরে কোনও অর্থ খরচ করা সম্ভব নয়। পর্যটনের উন্নয়নের জন্য আলাদা বাজেট প্রয়োজন।’
চেয়ারম্যান উল্লেখ করেন, জেলা পরিষদ রাঙামাটিকে পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রায় ১২০০ কোটি টাকার প্রকল্প তৈরি করে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর দুই বছর পর পেরিয়ে গেছে। পার্বত্য মন্ত্রণালয় কাটছাট করে ৩০০ কোটি টাকার প্রকল্প জমা দিতে বলেছে। সেটি এভাবেই ঝুলে আছে। তবে তার আশা, ‘বরাদ্দ পাওয়া গেলে এবং কাজ শেষ হলে রাঙামাটি ইতিবাচকভাবে বদলে যেতে পারে।’
জেলার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সুনীল কান্তি দে বলেন, ‘কাপ্তাই লেক যে কয়টি সম্ভাবনার কথা ভেবে সৃষ্টি হয়েছে, তার মধ্যে পর্যটনের উন্নয়ন অন্যতম। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনার অভাবে তা এগিয়ে যেতে পারছে না। শুনেছিলাম পর্যটনের উন্নয়নে ১২০০ কোটি টাকার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে জেলা পরিষদ। কিন্তু দুই বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও তা আলোর মুখ দেখেনি।’
প্রবীণ এই সাংবাদিক মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘পর্যটনের উন্নয়ন করতে গিয়ে পাহাড় যেন কাটা না হয়। প্রকৃতিকে ঠিক রেখেই পর্যটন উন্নয়ন করার কথা ভাবা জরুরি।’
এদিকে আজ বিশ্ব পর্যটন দিবস। কিন্তু রাঙামাটিতে শোভাযাত্রা ও আলোচনা সভার মধ্যেই সীমিত থাকে দিবসটি। অবশ্য রাঙামাটি পর্যটন করপোরেশনের ব্যবস্থাপক সৃজন বিকাশ বড়ুয়া বাংলা ট্রিবিউনকে সুখবর দিয়ে জানান, বিশ্ব পর্যটন দিবস ও মুজিববর্ষ উপলক্ষে ৫৪ শতাংশ ছাড় দেওয়া হয়েছে।