X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

কেউ কি আর স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরতে যাবেন?

আমীন আল রশীদ
০১ অক্টোবর ২০২০, ১৫:৫৪আপডেট : ০১ অক্টোবর ২০২০, ১৫:৫৬

আমীন আল রশীদ সিলেটের এমসি কলেজের ঘটনার পরে এক অজানা আতঙ্ক মনে ভর করেছে। কেননা, বিয়ের পর থেকেই আমি এবং আমার স্ত্রী সুযোগ পেলেই এখানে-ওখানে ঘুরতে যেতাম। বিশেষ করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, পার্ক, নদীর তীর কিংবা রাতে ঢাকার ফাঁকা রাস্তায় ঘুরতাম রিকশা নিয়ে। এখনও সময় পেলে আমরা এরকম ঘোরাঘুরি করি। সম্প্রতি পরপর দুবার গেলাম রাজধানীর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের ওপারে তুরাগের তীরে কাশবন দেখতে। এই জায়াগাটা বেশ নিরিবিলি। কিন্তু সিলেটের ঘটনাটি শোনার পর থেকে কেমন যেন হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। ভাবছি, সিলেটের এমসি কলেজের এরকম কোনও ঘটনা যদি আমাদের জীবনে ঘটতো!
এই ঘটনা শোনার পর থেকে ভাবছি, ভবিষ্যতে দলবল বা একসঙ্গে অনেক পরিচিতজন ছাড়া আলাদাভাবে আমরা দুজন আদৌ কোথাও যাবো কিনা? সেটি ঢাকার ভেতরে হোক কিংবা বাইরে। আমার ধারণা, এরকম ভয় ও শঙ্কা এখন দেশের লাখ লাখ মানুষের মনে ঢুকে গেছে। নদী তীরের সুনসান জায়গা নয়, বরং একটি বিভাগীয় শহরের ভেতরে একটি উচ্চশিক্ষা কেন্দ্রের হলে জোর করে তুলে নিয়ে একজন নারীকে গণধর্ষণ করলো কিছু পাষণ্ড, যাদের পরিচয় ছাত্র এবং যাদের একটি রাজনৈতিক পরিচয়ও রয়েছে!

এই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে গত সপ্তাহের কোনও একদিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে রাজধানীর কাওরানবাজারে সার্ক ফোয়ারার মোড়ের একটি ‘ছোট্ট’ ঘটনা শেয়ার করি। গাড়ি সিগন্যালে পড়লে পূর্ব দিক দিয়ে পশ্চিমে রাস্তাটা পার হচ্ছিলাম। আরও অনেকেই। আমার সামনে হেঁটে যাচ্ছিলেন একজন ভদ্রলোক এবং তার সঙ্গে একজন ভদ্রমহিলা। রাস্তার মাঝখানে তিনজন বখাটে সিগারেট টানছিল এবং হঠাৎ করে দেখলাম বখাটেদের একজন ওই মহিলার খুব কাছে গিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে দিলো। ব্যস্ত রাস্তায় এই দৃশ্যটি দেখার পরে একবার মনে হলো একাই প্রতিবাদ করি। কিন্তু সবারই তাড়া ছিল দ্রুত রাস্তা পার হওয়ার। কারণ সিগন্যাল ততক্ষণে ছেড়ে দিয়েছে। কাওরানবাজারের রাস্তা পার হওয়ার পরে হেঁটে আমার বাসায় পৌঁছাতে মিনিট দশেক সময় লাগে। এই সময়টুকুতে মাথার ভেতরে শুধু এই দৃশ্যটিই ঘুরছিল। ভাবলাম, কী এক অসহায় অবস্থার ভেতরে আমরা এই শহরে থাকি। দুই তিনজন বখাটে প্রকাশ্য রাস্তায় একজন ভদ্রমহিলার মুখের দিকে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে দিলো, কিন্তু তার সঙ্গে থাকা পুরুষলোকটি কিছুই করতে পারলেন না। এমনকি আমি নিজেও, এই সমাজ ও রাষ্ট্রের মোটামুটি একজন শক্ত সামর্থ্য পুরুষ, পেশাগত কারণে যার কিছু আইনি-সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তিও রয়েছে—সেই লোকটিও কোনোরকম প্রতিবাদ না করে বা ওই বখাটেকে না পিটিয়ে তথাকথিত ভদ্রলোকের মতো হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরলাম এবং ভাবলাম—আমার কী? আমার স্ত্রীর মুখে তো সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়েনি! 

যারা এই লেখাটি পড়ছেন, ধারণা করি তাদের অনেকেই রাস্তায় চলতে-ফিরতে, এখানে-ওখানে যাওয়া-আসার পথে এরকম নানারকম তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন বা নিজের জীবনে না ঘটলেও এরকম ঘটনা চোখে দেখেছেন। কেউ হয়তো প্রতিবাদ করেছেন, কেউ হয়তো না দেখার ভান করে কিংবা কিছুই হয়নি বলে মনকে প্রবোধ দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেছেন। কেউ হয়তো আমার মতো ভেবেছেন, আজ যদি সঙ্গে একজন মারকুটে সহকর্মী বা বন্ধু থাকতো, তাহলে বখাটেদের পিটিয়ে লম্বা করে দিতাম!

বাস্তবতা হলো, আমরা এই শহরে মানে রাজধানী ঢাকায় যারা থাকি, তাদের একটা বড় অংশই ভীতু। কারণ প্রতিনিয়ত আমাদের নানারকম ভয় ও শঙ্কার ভেতরে থাকতে হয়। চাকরির অনিশ্চয়তা, মাস শেষে ঘর ভাড়ার চিন্তা, রাস্তায় বেরোলে দুর্ঘটনা কিংবা ছিনতাইয়ের ভয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নাজেহাল হওয়া, বাড়ি থেকে বাবা-মা কিংবা এরকম নিকাটত্মীয়দের কোনও দুঃসংবাদ, ফেসবুকে লাইক-কমেন্ট নিয়েও দুশ্চিন্তা। নিজেকে নিয়েই মানুষের যখন এতসব চিন্তা, তখন কে কোন নারীর মুখে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়লো কিংবা কার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে তার স্ত্রীকে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করলো—তা নিয়ে ভাবার সময় কোথায়? মানুষ নিজেকে নিয়েই তো ব্যস্ত। 

এখন প্রশ্ন হলো, এই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত মানুষেরাও তো একটু ভালো থাকার জন্য, হাজারো অনিশ্চয়তা আর সমস্যার ভেতরে পরিবার-পরিজন নিয়ে একটু অবসর কাটানোর জন্য এখানে-ওখানে গিয়েও নিরাপদ নন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেই যদি নারীর সম্ভ্রম ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়, তাহলে কেমন সমাজ ও রাষ্ট্র আমরা গড়ে তুললাম? প্রকাশ্য রাস্তায় যদি একজন নারীর মুখে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে দেওয়া যায় এবং যদি রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখে এসব ধরা না পড়ে—তাহলে মানুষ কোথায় নিরাপদ! একজন নারী তার স্বামী বা বন্ধুর সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে যদি ধর্ষণের শিকার হন, তাহলে কি এখন থেকে দলবল বা একসঙ্গে অনেক লোক ছাড়া দুজন মানুষ বা একা একজন নারী কোথাও ব্ড়োতে যেতে পারবেন না?

প্রসঙ্গত, গত শুক্রবার সন্ধ্যায় সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে দলবেঁধে ধর্ষণ করে কয়েকজন যুবক। এ ঘটনায় যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে তারা সবাই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ বিষয়ে কলেজের অধ্যক্ষ সালেহ আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, কলেজের যে হোস্টেলে ঘটনাটি ঘটেছে, সেটি অরক্ষিত। কোনও সীমানা প্রাচীর নেই। কয়েকবার সেখান থেকে বখাটেদের বের করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি রুমের তালাও পরিবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও এই ঘটনা ঘটে গেলো। সালেহ আহমেদ বলেন, ‘এই ঘটনায় আমি লজ্জিত, আমার মাথা নিচু হয়ে গেছে।’ 

শুধু একজন শিক্ষকের নয়, এই ঘটনায় আমাদের সবার মাথু নিচু হয়েছে। সবচেয়ে বেশি নিচু হয়েছে যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, তাদের। কারণ তারা শুধু আমাদের প্রবৃদ্ধি আর উন্নয়নের গল্প বলেন। বড় বড় অবকাঠামো দিয়ে আমাদের সান্ত্বনা দেন। রাষ্ট্র ও নাগরিকের নিরাপত্তার কথা বলে সামরিক খাতে ব্যয় বাড়ানো হয়। সরকারি কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়। জনগণের পয়সায় তাদের বেতন হয়। কিন্তু আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরতে বের হলে সে যে ধর্ষণের শিকার হবে না—এই নিশ্চয়তা কি তারা দিতে পারছেন?

অনেকেই হয়তো প্রশ্ন করবেন, রাষ্ট্রের সর্বত্র সবার নিরাপত্তা দেওয়া কি রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব? হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু রাষ্ট্রকে এমন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হয় যাতে একজন নারী তার স্বামী বা বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে গেলে বখাটেদের দ্বারা নাজেহাল বা ধর্ষণের শিকার হবেন না। সেই ব্যবস্থা কি গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে? 

বলা হয়, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলেই অপরাধ কমবে। কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি বলতে কী বোঝায়? প্রতিটি রাষ্ট্রের নিজস্ব আইন-কানুন এবং বিচারব্যবস্থা রয়েছে। সেই ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে কোনও ধরনের শাস্তি দেওয়া বেআইনি। সিলেটের ঘটনার পরে কেউ কেউ ফেসবুকে লিখেছেন, অপরাধীদের এমসি কলেজ গেটে দাঁড় করিয়ে প্রকাশ্যে গুলি করে মেরে ফেলা হোক। বছর দুয়েক আগে দেশে হঠাৎ করে শিশু ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে গেলে অনেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছিলেন, ধর্ষকদের পুরুষাঙ্গ কেটে দেওয়া হোক। এসব শাস্তি দেশের প্রচলিত আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষের এসব প্রতিক্রিয়ায় এটা পরিষ্কার, প্রচলিত বিচারব্যবস্থায় যেহেতু অপরাধ নির্মূল হচ্ছে না, তাই তারা বিকল্প ব্যবস্থা চায়। 

কী সেই বিকল্প, ক্রসফায়ার? বড় কোনও অপরাধী ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হলে বিভিন্ন সময়ে মিষ্টি বিতরণের খবরও গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। তার মানে কি মানুষ ক্রসফায়ারের পক্ষে? বস্তুত, মানুষ যখন দেখে যে, প্রচলিত ব্যবস্থায় অপরাধীদের বিচার হচ্ছে না বা পার পেয়ে যাচ্ছে, তখন অন্য কোনোভাবে তারা নিহত হলে বা শাস্তি পেলে মানুষ খুশি হয়। ধর্ষণের ক্ষেত্রেও মানুষের মধ্যে সেই একইরকম প্রতিক্রিয়া। 

কিন্তু ভিন্ন উপায়ে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার কুফল হলো, অনেক অপরাধীর মধ্যে নিরীহ মানুষও খুন হয়ে যায় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু দুর্নীতিপরায়ণ সদস্য বিচারবহির্ভূত হত্যাকে নিজেদের অবৈধ অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার বানায়। নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনা যার বড় প্রমাণ। সুতরাং, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নামে ক্রসফায়ার কিংবা ধর্ষকের পুরুষাঙ্গ কেটে দেওয়াই সমাধান নয়। বরং প্রচলিত বিচারব্যবস্থার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা যে দুর্বল তদন্ত রিপোর্ট—সেটি ঠিক করতে হবে। আদালত তথ্যপ্রমাণের ওপরে রায় দেন। একজন নারীকে কয়েকজন যুবক মিলে ধর্ষণ করলো, এটা যতক্ষণ না প্রমাণ করা যাচ্ছে—ততক্ষণ আদালত তাদের শাস্তি দিতে পারবেন না। আবার নিম্ন আদালতে শাস্তি পেলেও উচ্চ আদালতে গিয়ে যদি তারা মাফ পেয়ে যায়, মোটা অঙ্কের ঘুষ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার বলে যদি তারা পার পেয়ে যায়, তাহলে দেশে আইনের শাসন বলে কোনও কিছুই প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। আর যতক্ষণ না সত্যিকারের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, ততক্ষণ মানুষ ধর্ষককে প্রকাশ্যে গুলি করে মারা কিংবা তার পুরুষাঙ্গ কেটে দেওয়ার দাবি জানাতেই থাকবে। 

বলা হয়, পুরুষ মাত্রই ধর্ষকামী। যখন সে বোঝে অপরাধ করেও পার পাওয়া যাবে অথবা তার ভেতরে যদি অপরাধবোধ বলে কিছু না থাকে, তখন সুযোগ পেলেই সে ধর্ষক হয়ে ওঠে, নারীর শাড়ি ধরে টান দেয় কিংবা তার মুখের সামনে গিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে দেয়। কিন্তু আমরা একটি ধর্ষকমুক্ত সমাজ চাই। আমার স্ত্রীকে নিয়ে আমি নির্ভয়ে কোনও ক্যাম্পাস, নদীর তীর, কাশবন এমনকি সন্ধ্যার পরে নির্জন রাস্তায়ও রিকশায় ঘুরতে চাই। এরকম একটি ভয়মুক্ত পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব রাষ্ট্রের। 

লেখক: সাংবাদিক।

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
নাগরিক জীবনের সব ক্ষেত্রে পুলিশের অবস্থান রয়েছে: ডিএমপি কমিশনার
নাগরিক জীবনের সব ক্ষেত্রে পুলিশের অবস্থান রয়েছে: ডিএমপি কমিশনার
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
মহাকাশে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধে জাতিসংঘের ভোটে রাশিয়ার ভেটো
মহাকাশে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধে জাতিসংঘের ভোটে রাশিয়ার ভেটো
তামাক কর বাস্তবায়নে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ তরুণের অকালমৃত্যু প্রতিরোধ সম্ভব
তামাক কর বাস্তবায়নে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ তরুণের অকালমৃত্যু প্রতিরোধ সম্ভব
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ