X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

আমরা বাঁচতে চাই

কাকলী প্রধান
১১ অক্টোবর ২০২০, ১৭:০৫আপডেট : ১১ অক্টোবর ২০২০, ২১:৪৪

কাকলী প্রধান আমরা কেউই কিন্তু রেহাই পাচ্ছি না। চলন্ত বাসে ধর্ষণের শিকার হচ্ছি। প্রেমিকের সঙ্গে পার্কে গেলে ধর্ষণের শিকার হচ্ছি। স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে গিয়েও নিপীড়নের শিকার হচ্ছি। কাজে যাওয়ার সময় কিংবা ফেরার সময়? সেখানেও রেহাই নেই। আমাদের চারপাশে যারা ঘুরছে তারা আসলে বেশিরভাগই হয় ধর্ষক না হয় হত্যাকারী। কী বীভৎস! কী নৃশংস! এবং সৃষ্টির সবচেয়ে লজ্জার ও নির্মম বিষয় বাবার কাছেও আমরা আর নিরাপদ নই।
সাংবাদিক বলেও রেহাই নেই। সকালে ঘুম ভাঙলো অনুজ সাংবাদিকের বোনের মৃত্যু সংবাদ শুনে। সেখানেও আসামি শ্বশুরবাড়ির। আমি সেই সাধারণ বোকাসোকা মানুষ। সারাদিন ছবি তুলি। সুন্দর প্রকৃতি সুন্দর মুখ! না শুধু সুন্দর না, বন্যা, হাসপাতাল, মর্গ, হরতাল, লাঠালাঠি, পেটাপেটি, দখল, উচ্ছেদসহ অগণিত ধর্ষণের শিকার কিংবা নারীর ঝলসে যাওয়া মুখের ছবিও। যখন সুন্দরের ছবি তুলি, তখন দীর্ঘদিন আমি শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকি। আর ঝলসে যাওয়া নির্যাতিতা শরীরের ছবি তুললে অল্প দিনেই ক্লান্তি এবং অবসাদে আমি বিবর্ণ হতে থাকি। কারণ শুধুতো ছবি তোলা নয়। অসহায়ভাবে হেরে যাওয়া করুণ মুখ অথবা হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করা মানুষগুলোর একটা করুণ আকুতি আমাকে শুনতে হয়। আমরা কি কোনোদিনই বিচার পাবো না! মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শ হাতে নিয়ে আমাকে ফিরতে হয় প্রতিবার। আমি জানি যাদের ফেলে আসি তাদের জন্য পৃথিবীতে আর অল্প একটু সময় বরাদ্দ থাকে। হয়তো আমি নারী বলেই ওরা একজন আপন মানুষকে তাদের শেষ কোনও ইচ্ছার কথা অস্ফুট আর্তনাদে বলে যেতে চায়। সেখানে আমি শুধু একজন ফটোসাংবাদিক নই। ওই ধর্ষণের শিকার এবং ঝলসানো শরীরের একজন প্রতিনিধিও বটে। খুব মনে হয় একটা পাঁচ বছরের ছোট্ট শিশুর কথা। ও বলেছিল, আমার সঙ্গে যেই কাজটা হলো যেটার নামই কি ধর্ষণ? কী উত্তর দেবো আমি? ওরা তো জানে না যে ওদের নির্বাচিত কত নির্বোধ কত বোকা একজন প্রতিনিধি আমি!

গত বছর একটি যৌনপল্লিতে কাজ করেছিলাম। সেখানে কলেজ শিক্ষক থেকে ডাক্তার উকিল শ্রমিক পরিবহন শ্রমিক দোকান শ্রমিক মালিক সহ সবার বাধাহীন যাতায়াত। একটি বিষয় খেয়াল করার মতো। সেখানে অনেক কিশোরেরও অবাধ যাতায়াত; যাদের বয়স চৌদ্দ পনের ষোল সতের। যেখানে কিশোর শ্রমিক যেমন আছে তেমনি কিশোর স্কুল কলেজ পড়ুয়ার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। আমার সঙ্গে বসে গল্প করছিল এক বালিকা। তলব আসতেই উঠে চলে গেলো। অবাক হয়ে দেখলাম ওর ঘরের সামনে লাইন দিয়ে আছে ৮/১০ জন কিশোর। মেয়েটি কিছুক্ষণ পর আবার গোসল সেরে আমার সঙ্গে এসে হাসিমুখে গল্পে বসে গেলো। হাসিতে সামান্য বিষণ্ণতা ছড়ানো। আমি জিজ্ঞেস করলাম কষ্ট হচ্ছে? ওর ভয়ঙ্কর তেজি উত্তর ‘না’ একজনকে ভালোবেসেছিলাম। ধোঁকা দিলো। বিয়ে করবে বলে রাতে ঢাকায় এনে বন্ধুসহ ধর্ষণ করলো, তারপর এইখানে এনে ছেড়ে দিলো। আর কীসের কষ্ট? আমার চেয়ে আপনার কষ্টটা অনেক বেশি। এ্যাতো ভারি ক্যামেরা। ও বললো, আপা, স্কুলের ছাত্ররাও আসে, এখানে এরা কীভাবে আসে?

বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো যেন।

আজকাল প্রতিদিন ধর্ষণের খবর এটা যেন আমার দেশে খুব স্বাভাবিক একটা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যৌনপল্লির ওই মেয়েটির কথাই ঠিক মনে হয়। আমার ক্যামেরাটা আজকাল বড্ড বেশি ভারি মনে হচ্ছে। সমস্ত যন্ত্রণা, প্রায় প্রাণহীন মানুষগুলোর আকুতি বোধহয় ওটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। মানুষ তো নয়। যে চালাক হবার ভান করে দায়গুলো ঝেড়ে ফেলতে পারবে। আমরা বোকা মানুষগুলো আসলে প্রতিনিয়ত দায় ঝেড়ে ফেলে চালাক হওয়ার চেষ্টা করছি। প্রতিবারই ভাবছি যাক বাবা আমি তো নই! বিশেষ করে সামাজিকভাবে অপেক্ষাকৃত এগিয়ে থাকা নারীরা। অথচ আমাদের দায়িত্ব ছিল অনেক বেশি। আসল কথায় ফিরে আসি। প্রসঙ্গ ধর্ষণ এবং হত্যা।

রাষ্ট্রীয় কাঠামো রাষ্ট্রীয় যন্ত্র রাষ্ট্রীয় শিক্ষা ব্যবস্থা নিজ নিজ স্বার্থে ব্যবহৃত। সরকার বিরোধী দল (বলে কিছু নেই যদিও) বড় দল, উপদল মন্ত্রী, সচিব, পুলিশ, অধ্যক্ষ সবাই যার যার চেয়ার সামলাতে ব্যস্ত। পুরো দেশ ধর্ষণ হত্যার বিরুদ্ধে আন্দোলনরত। আন্দোলনের ছবি তুলতে দাঁড়ালাম সরকারি বিজ্ঞান কলেজের সামনে। ছাত্ররা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করার লক্ষ্যে কলেজ প্রাচীর ঘেঁষে দাঁড়াতেই পুলিশ হাজির। তারা নাকি কলেজ অধ্যক্ষকে ফোন করেছেন এবং কলেজ অধ্যক্ষ নাকি বলেছেন, কলেজ বন্ধ তাই তার কলেজ প্রাচীরের সামনে দাঁড়িয়ে আন্দোলনে শরিক হবার অনুমতি দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। অতএব ছাত্রদেরকে সরিয়ে দেওয়া হলো।

সবচাইতে হাস্যকর বিষয় হলো ছাত্রদেরকে দুজন দুজন করে শাহবাগ যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো। তারা একসঙ্গে দলগতভাবে যেতে পারবে না। প্রশ্ন জাগে অধ্যক্ষরা কী তাহলে তাদের দায়িত্ব পুলিশের ওপর দিয়ে দিচ্ছেন! ছাত্রদের অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্বের বিষয়টিও কী তাহলে তারা অবলীলায় ছেড়ে দিচ্ছেন রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনীর ওপর? ছাত্ররা জানালো তারা অধ্যক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে।

খুব ভাবনার বিষয় নয় কী? অধ্যক্ষকে পুলিশ ফোনে পায় অথচ তার সন্তানতুল্য ছাত্ররা পায় না। ছাত্রদের মধ্যে চেতনা এবং মূল্যবোধ কী আকাশ থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসবে?

আমি বোকাসোকা সাধারণ ফটো সাংবাদিক। আমার কী জ্ঞানেশ্বরদের নিয়ে কথা বলা সাজে! তবু বলি সবাই একটা বিশাল নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে এবং একটা বিশাল নামমাত্র ছাত্র সমাজকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। যেখানে কিলবিল করছে স্বার্থ। দাউ দাউ করে জ্বলছে প্রতিহিংসার দাবানল। সেই সঙ্গে বাড়ছে নারীর প্রতি অসদাচরণ। তিল তিল করে হত্যার প্রক্রিয়া চলছে সমাজের মেধা শক্তিকে। বিকৃত রাজনীতি, বিকৃত শিক্ষা ব্যবস্থা, বিকৃত ধর্ম ব্যবস্থাপনার শিকার আমরা নারীরা। তবে শুধু নারীই নয়, এর শিকার পুরো সমাজ। একটা সুচিন্তাহীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিদিন বয়ঃপ্রাপ্ত হচ্ছে। মননশীল মানুষরা হঠাৎ চুপ মেরে গেছেন। সমালোচনা এখানে অমার্জনীয় অপরাধ। শিল্প কোণঠাসা। মাঝে মাঝে শিল্প এবং শিল্পীকে কান ধরে ওঠবস করায় এই সমাজ। আমরা ভেসে যাচ্ছি নারী ক্ষমতায়নের জোয়ারে।

আমরা উদ্ভাসিত, উদ্বেলিত, শিহরিত, রোমাঞ্চিত। কারণ এইসব ধর্ষণের খবরে রাস্তা কাঁপানো দুই/চারদিন ভেসে যাবে আবার অতিসত্বর আরও অন্যায়ের জোয়ারে।

প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার হাতে অনেক ক্ষমতা। স্কুল কলেজগুলোতে এবার বোধহয় নতুন দুটি বিষয় পাঠ্য সংযোজন অতি জরুরি হয়ে গেছে। এক. পাঠ্যক্রমে যৌন শিক্ষা সংযোজন এবং দুই. নারী শিক্ষার্থীদের শিখতে হবে আত্মরক্ষার কৌশল। দুদলকেই ৯৫% শতাংশ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার সনদ পেতে হবে।

আমার শরীর এবং জীবনের নিরাপত্তা যখন রাষ্ট্র দিতে ব্যর্থ তখন আর উপায় কী! প্রিয় প্রধানমন্ত্রী আমরা তো আমাদের শরীর এবং জীবন নিয়ে সুন্দর পৃথিবীতে বাঁচতেই চেয়েছিলাম।

লেখক: আলোকচিত্রী

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ