X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ধর্ষণের ক্ষেত্রে পুলিশ কি জানে তার ‘নিজ দায়িত্ব’ কী?

ডা. জাহেদ উর রহমান
২৪ অক্টোবর ২০২০, ১৪:২৯আপডেট : ২৪ অক্টোবর ২০২০, ১৪:৩১

ডা. জাহেদ উর রহমান এই সমাজে কি ধর্ষণ নিয়ে মানুষের সচেতনতার অভাব আছে? এই দেশের মানুষ কি ধর্ষণকে মেনে নিয়েছে? এই দেশের মানুষ কি ধর্ষণকারীর প্রতি ক্ষোভ-ক্রোধ পোষণ করে না? ধর্ষণের ঘটনা ঘটার পর সবাই কি ধর্ষকের বিচার চায় না? প্রশ্নগুলোর উত্তর আমরা এতটা নিশ্চিতভাবেই জানি যে সেগুলো এখানে লেখা অপ্রয়োজনীয়। প্রশ্ন আসতে পারে, যে প্রশ্নের উত্তর আমরা সবাই জানি, সেই প্রশ্নগুলো আবার করতে হলো কেন।
বোকা বোকা প্রশ্নগুলো আবার মাথায় এলো বাংলাদেশ পুলিশের ‘নজিরবিহীন’ একটা সাম্প্রতিক কর্মসূচি দেখে। গত ১৭ অক্টোবর দেশজুড়ে ধর্ষণ ও নিপীড়নবিরোধী ৬,৯১২টি সমাবেশ হয়েছে পুলিশের উদ্যোগে। এসব সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের হাতে দেখা গেছে নির্যাতন, ধর্ষণ কিংবা নিপীড়নবিরোধী নানা ধরনের ব্যানার, ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড।
এসব সমাবেশের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে ‌ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার শাহ মোহাম্মদ আবিদ হোসাইন বলছেন, ‘এই কর্মসূচির মূল লক্ষ্য ছিল সমাজে প্রতিটি ক্ষেত্রের মানুষকে নারী নির্যাতন বা নিপীড়নে নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করানো।’ পুলিশের এই কর্মকর্তার বক্তব্যটি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে জেগেছে পাল্টা প্রশ্ন–পুলিশ অন্যদের ‘নিজ দায়িত্ব’ সম্পর্কে সচেতন করছে, কিন্তু পুলিশ কি তার ‘নিজ দায়িত্ব’ সম্পর্কে আদৌ সচেতন আছে?    

ধর্ষণ এই দেশে বেশ নিয়মিত ঘটে যাওয়া ঘটনা। কিন্তু গত কয়েক বছরে এর প্রকোপ অনেক বেড়েছে। এসব ঘটনা এখন অনেকটাই আমাদের ‘গা সওয়া’। তবে মাঝে মাঝে খুব উল্লেখযোগ্য ধর্ষণ বা গণধর্ষণের ঘটনা ঘটলে আমরা সেটা নিয়ে কিছুটা নড়েচড়ে বসি। সিলেটের এমসি কলেজের ঘটনাটি ঘটার পর আমরা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছি। তবে আমরা সম্ভবত ক্ষোভে ফেটে পড়েছি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করা এবং সেটার ভিডিও ধারণ করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়া নিয়ে। এক অদ্ভুত সময়ে বসবাস আমাদের। এখন আমরা কল্পনায় নির্যাতন দেখতে পাই না; দেখতে হয় জৈবিক চোখে। 

বেগমগঞ্জের ঘটনাটি ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে পড়ার পর পুলিশ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। আমরা এর মধ্যেই জেনে গেছি সেই নিপীড়নের মূল হোতা হচ্ছে দেলোয়ার নামে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা। যার  নেতৃত্বে ‘দেলোয়ার বাহিনী’ নামে একটা ‘বাহিনী’ই আছে ওই এলাকায়, যারা নানা অপকর্ম করে বেড়ায়। এই দেলোয়ার কীভাবে ওই এলাকায় ‘দেলোয়ার’ হিসেবে তৈরি হয়ে উঠেছে, সেটা একটু দেখে নেওয়া যাক। এই একটি ঘটনাই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে এরকম অপরাধী সৃষ্টি কীভাবে হয়। আমরা সহজেই বুঝবো কীভাবে এতদূর যায় তাদের স্পর্ধা।

২০১৮ সালের শেষ দিকে চৌমুহনী দক্ষিণ বাজারের নুরুল হক মিয়ার রাইস মিল এলাকায় দেলোয়ার একটি শটগান, দুটি গুলিসহ জনতার হাতে ধরা পড়েছিল। মারধরের পর তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পুলিশ তাকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই ঘটনায় দেলোয়ারের বিরুদ্ধে থানায় কোনও মামলা হয়নি। উদ্ধার করা অস্ত্রেরও হদিস নেই।

গোপন সূত্রে খবর পেয়ে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ২০১৯ সালের ২৭ মার্চ তার বাড়িতে অভিযান চালায়। সেখান থেকে একটি দেশি বন্দুক (এলজি) ও তিনটি কার্তুজ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় ডিবির উপপরিদর্শক (এসআই) মো. রেজাউল করিম বাদী হয়ে বেগমগঞ্জ থানায় যে মামলা করেন, তাতে দেলোয়ারকে আসামি করা হয়নি। 

২০১৮ সালের ১০ মার্চ একলাশপুর গ্রামে জোড়া খুনের ঘটনা ঘটে। বাদী উক্ত পত্রিকাকে জানান, তিনি যে অভিযোগ দিয়েছিলেন, তাতে আসামিদের মধ্যে দেলোয়ারের নামও ছিল। কিন্তু পুলিশ দেলোয়ারের নাম বাদ দিয়ে মামলাটি নিয়েছে।

ফিরে আসা যাক পুলিশের জনসভার প্রসঙ্গে। আমি জানি কমিউনিটি পুলিশিং বলে পুলিশের এখন একটা আলাদা শাখা আছে। পুলিশের ভাষায় কমিউনিটি পুলিশিং সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এভাবে–‘কোনও নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় অপরাধ দমন ও অপরাধ উদঘাটন, অপরাধীদের গ্রেফতার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে পুলিশ ও ওই এলাকার জনগণের পারস্পরিক সহযোগিতা ও যৌথ অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে সমস্যা ও সমস্যার কারণ চিহ্নিত করে প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের উপায় উদঘাটন ও বাস্তবায়নের পদ্ধতিই কমিউনিটি পুলিশিং।’

এই বিবেচনায় কেউ বলতেই পারেন পুলিশ যে সমাবেশগুলো করেছে সেটা তাদের কমিউনিটি পুলিশিংয়ের সঙ্গে দূরবর্তী হলেও যোগসূত্র আছে। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, দেশে বীভৎস ধর্ষণ এবং নির্যাতনের ঘটনায় পর পুলিশের এমন সমাবেশ নাগরিকদের মনে কি শুরুতে লেখা প্রশ্নগুলো নতুন করে উদ্রেক করে না? মানুষের কি মনে হতে পারে না, পুলিশ তার ‘ফরজ’ কাজ বাদ দিয়ে ‘নফল-মুস্তাহাব’ নিয়ে পড়ে আছে?

দেলোয়ার অস্ত্র-গুলিসহ আটকের পরও তার বিরুদ্ধে মামলা হয়নি কেন সেই ব্যাখ্যায় দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিক জানায় – ‘দুই বছর আগে দেলোয়ারের অস্ত্র-গুলিসহ আটকের বিষয়টি তখন পুলিশ ধামাচাপা দিয়েছিল সাংসদ মামুনুর রশীদের লোকজনের তদবিরে। স্থানীয় লোকজন জানান, গণপিটুনিতে আহত দেলোয়ারকে তখন সাংসদের লোকজন চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন। পরে সুস্থ হয়ে এলাকায় ফিরে দেলোয়ার আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।’ 

আমি জানি দেশে প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বহু সময় ক্ষমতাবান মানুষের চাপের মুখে পড়ে অনেক বেআইনি কাজ করতে হয়। কিন্তু  প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনে রাখা জরুরি, এমন কোনও চাপ দেওয়ার আইনি ক্ষমতা সেসব মানুষের নেই। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে এসব সংস্থা একেকটা প্রতিষ্ঠান, তারা তাদের নিজস্ব আইন‌ এবং বিধিতেই চলা উচিত। পুলিশকে মনে রাখতে হবে কারও প্রভাবের অধীনে থেকে তারা যদি সমাজে অন্যায় অত্যাচারকে প্রশ্রয় দেন,  তাহলেও তার দায় পুলিশ বাহিনীর ওপর এসে বর্তায়। পুলিশকে মনে রাখা উচিত তারা একটি রাষ্ট্রীয় বাহিনী।

দেশের বাজেটের ব্যয় বরাদ্দ মোটা দাগে দুই ভাগে বিভক্ত–রাজস্ব বাজেট আর উন্নয়ন বাজেট। আমাদের বাজেটের মোটামুটি প্রবণতা হচ্ছে রাজস্ব খাতে বরাদ্দ হয় মোটামুটি দুই-তৃতীয়াংশ আর বাকি এক-তৃতীয়াংশ হয় উন্নয়ন বাজেটে। ওদিকে বছর শেষে অদক্ষতার কারণে অনেক উন্নয়ন প্রকল্প বাতিল হওয়ার কারণে উন্নয়ন বাজেটে কাটছাঁট হয়। তাতে সংশোধিত বাজেটে রাজস্ব বাজেটের অনুপাত ৭০ শতাংশের বেশি হয়ে যায়। অর্থাৎ এই দেশের জনগণের করের টাকা এবং সঙ্গে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ঋণের বাজেটের প্রধান খরচ হয় এই রাষ্ট্রকে চালানোর পেছনে। এত বিপুল অঙ্কের টাকা দিয়েও মানুষ এই দেশে কাঙ্ক্ষিত সেবা পায় না, বহু মানুষকে সরকারি সেবা পাবার জন্য ঘুষ দিতে হয়। ঘুষের সেই অঙ্কটাও অনেক বড়। 

সুতরাং এই রাষ্ট্রের নাগরিক যখন অনুভব করবে সে তার কাঙ্ক্ষিত কোনও সেবা পাচ্ছে না তখনই সে সরকারের বিভিন্ন অঙ্গের সমালোচনায় মুখর হবে, এটাই স্বাভাবিক। সে কারণেই যখন দেশে আইনশৃঙ্খলা জনিত কোনোরকম বড় কোনও ঘটনা ঘটে, স্বাভাবিকভাবেই পুলিশের সমালোচনায় জনগণ মুখর হয়।‌ 

প্রশাসনের অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ পুলিশ যখন তার মূল কাজ, অপরাধীকে গ্রেফতার করা, তাদেরকে আইনের আওতায় আনা এবং অপরাধের তদন্ত করা এসবের চরম গাফিলতি দেখিয়ে, এমনকি বহু ক্ষেত্রে অপরাধ এবং অপরাধীকে প্রশ্রয় দিয়ে মানুষকে সচেতন করা এবং মানুষকে তাদের ‘নিজ দায়িত্ব’ শেখাতে মাঠে নামে, তখন সেটা এক পরিহাসের বিষয় হয়ে ওঠাই স্বাভাবিক। পুলিশ নিজের ‘নিজ দায়িত্ব’টা পালন করে দেখাক আগে।

লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ