X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘আলুপনা’

আহসান কবির
০৫ নভেম্বর ২০২০, ১৬:০১আপডেট : ০৫ নভেম্বর ২০২০, ১৬:০২

আহসান কবির এক লোক বাজারে গেছেন আলু কিনতে। তার সঙ্গে আলু বিক্রেতার কথোপকথন—
লোক—আলুর কেজি কত?
আলু বিক্রেতা—এখন ৮০ টাকা।
লোক—আগে না ২৫-৩০ টাকা ছিল?
আলু বিক্রেতা—এই টাকায় আগে দিতাম। এখন আর দেই না।
লোক—তাহলে তিন কেজি আলু দেন।

আলু বিক্রেতা আলু মেপে দেওয়ার পর লোকটা হাঁটা শুরু করলেন। আলু বিক্রেতা জিজ্ঞাসা করলো—আলুর দাম দিলেন না? লোকটা হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিয়ে বললো—আগে দিতাম এখন আর দেই না!

আলু কিনতে গিয়ে এমন ঘটনা কেউ না ঘটাক। অবশ্য কোনও কারণে দাম বাড়ার পর মানুষ আলু আর আগের মতো খায় কিনা এটা জানার জন্য সঠিক কোনও পরিসংখ্যান নেই। তবে আলু এখন আর নিছক খাদ্যদ্রব্য না! চরিত্র, বিজ্ঞান, কৌতুক এমনকি রাজনীতিরও অংশ। চরিত্রের অংশ এ কারণে যে, সবার সঙ্গে যিনি মিশতে পারেন তাকে অনেক সময় ভালো চোখে দেখা হয় না! তাই বলা হয় উনি একটু ‘আলুটাইপ’ আর কী! যার সঙ্গে মিশিয়ে ঘুঁটা দেবেন তাকেই জড়িয়ে ধরে থাকবে! আর একাধিক মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা যার, হিংসে করে হোক আর কেলেংকারির কারণে হোক, মানুষ বলে তার ‘আলুর দোষ’ আছে। আলুর দোষ থাকলে অনেক বেশি ‘আলুর গুণ’ও আছে।

বাজারে আলুর দাম বাড়লে আলু নিয়ে বেশ কিছু কৌতুক ছড়িয়ে পড়ে। যেমন আপনি ফ্রিজ কিনবেন। তো বিজ্ঞাপনে বলা হবে ‘অমুক’ কোম্পানির ফ্রিজ কিনলে ফ্রিজ ভর্তি আলু ফ্রি! নতুন গাড়ি কিনতে যাওয়ার আগে হয়তো চোখে পড়বে বিজ্ঞাপন—আমাদের কোম্পানির গাড়ি কিনলে ব্যাকডালা ভর্তি আলু ফ্রি! আলুর দাম বাড়লে মানুষের অভ্যাসও কেন যেন বদলে যায়। যেমন—

এক. মেয়েরা সাধারণত রূপচর্চায় শসা ব্যবহার করে। শসা নাকি ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়। মুখমণ্ডলের যত্ন ও উজ্জ্বলতা বাড়াতে মুখে ক্রিম মেখে তার মধ্যে শসা গোল গোল করে কেটে বসিয়ে দেওয়া হয়। আলুর দাম বাড়ার কারণে শসার জায়গায় আলুর ব্যবহার বাড়তে পারে। কারণ শসার মতো আলুরও নাকি এই গুণটি আছে!

দুই. জুতো পালিশ করার জন্যও আলুর ব্যবহার বাড়তে পারে! বিশ্বাস হচ্ছে না? আলু পাতলা ও গোল করে কেটে কালো জুতোয় ভালোভাবে ঘষুন। মিনিট পাঁচেক পরে জুতো টিস্যু বা পাতলা কাপড় দিয়ে মুছে ব্রাশ করে নিতে পারেন। চকচকে হলে নিজের চেহারাও দেখা যেতে পারে জুতোয়!

তিন. অনুষ্ঠানে ঝামেলা তৈরির জন্য আগে উপাদেয় ছিল পচা ডিম। কারও কবিতা আবৃত্তি ভালো লাগছে না। দুষ্ট দর্শকরা ছুড়ে মারতো পচা ডিম। গান ভালো লাগছে না, তো ছুড়ে মারা হোক ডিম। এখন এই ডিমের জায়গা দখল করে নিতে পারে আলু। হাতি মরলেও যেমন লাখ টাকা, পচা আলুও তেমনি ফেলনা নয়!

আলু কখনও ফেলনা ছিল না। মূল্যবান বিধায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৩তম অঙ্গরাজ্য আইডাহোকে বলা হচ্ছে ‘আলুরাজ্য’! সেখানে আলুর জাদুঘরও আছে। আলু নিয়ে বিতর্কও আছে। কেউ বলে এর প্রথম খাদক ইনকা সভ্যতায় বেড়ে ওঠা লোকজন। দক্ষিণ পেরুর এই ইনকা সভ্যতার সময়ে চাষের জমিকে ‘আলু’ বলা হতো। বাংলা আলু শব্দটা নাকি সেখান থেকে এসেছে। কেউ বলে আন্দেজ পর্বতমালার মানুষেরা প্রথম আলু দেখা ও খাওয়ার প্রচলন করেন। ইউরোপীয়দের নাকি আলু চিনিয়েছিল স্প্যানিশরা। স্প্যানিশরা যখন ১৬০০ শতাব্দীতে আন্দেজ পর্বতমালায় পৌঁছায়, তখনই নাকি তারা আলুর সন্ধান পেয়েছিল এবং তাদের কারণেই নাকি আলু আজ পৃথিবী বিখ্যাত। এই উপমহাদেশেও প্রায় সাড়ে চারশ বছর ধরে আলু জনপ্রিয়। বর্তমান সময়ে চীন আর ভারতে সবচেয়ে বেশি আলু উৎপাদিত হয়, কিন্তু বাঙালদের মতো এত বেশি ‘আলুময়’ নাকি আর কেউ হয় না। এত ‘আলুময়’ হয়েও বাঙালি কিছু কিছু ‘আলুপনায়’ পিছিয়ে আছে। যেমন—

এক. বিচারপতি সাত্তার যখন রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন তখন আলুর প্রতি একটু বেশি বেশি গুরুত্ব হয়েছিল। ছড়া কেটে বলা হতো–বেশি করে আলু খান ভাতের ওপর চাপ কমান! এই প্রচারণা যুক্তরাষ্ট্রের আইডাহো রাজ্যের মতো দীর্ঘস্থায়ী নয়!

দুই. মইনুদ্দীন ফখরুদ্দীনের সময়েও (২০০৭-২০০৮) আলুকে নিয়ে অনেক প্রচারণা হয়েছিল, কতভাবে আলু খাওয়া যায়, কত বেশি ‘আলুময়’ হওয়া যায় সেই প্রতিযোগিতা যেন চলছিল! এমন প্রতিযোগিতা আরও বাড়ানো দরকার!

তিন. বাংলাদেশের মানুষ যতই ‘আলুময়’ হোক আলু নিয়ে তাদের কোনও বিখ্যাত গান বা চিত্রকর্ম নেই। অল্প পরিচিত ব্যঙ্গাত্মক বা প্যারোডি গান আছে একটা। মূল গান ছিল তপন চৌধুরীর গাওয়া—‘আলো ভেবে যারে আমি জীবনে জড়াতে চাই সে তো আলো নয় যেন আলেয়া’। পাড়ার ছেলে পেলে পোংটামি করে গাইতো—‘আলু ভেবে যারে আমি তরকারি বানাতে চাই সে তো আলু নয় যেন হালুয়া’!

তিন. নেত্রকোনা কিংবা ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষজনের অনেকে  ‘আলো’কে আলু উচ্চারণ করেন। যেমন চোরকে ‘চুর’ এবং দোস্তকে ‘দুস্ত’ বলে থাকেন! সেই তুলনায় আলুময় খাবার বা গানে বিদেশিরা এগিয়ে আছেন। যেমন শেরিল হুইলারের জনপ্রিয় গান—দে আর রেড/দে আর হোয়াইট/দে গেট দ্যাট ওয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড/পটেটো, পটেটো, পটেটো, পটেটো...।

চার. আলু দিয়ে বানানো সসেজ বা ফ্রেন্স ফ্রাই খাওয়াতে বাঙালির চেয়ে বিদেশিরা অনেক এগিয়ে। পটেটো চিপসের মতো খাবারও বাঙালি খেতে শিখেছে বিদেশিদের কাছে থেকে। বাঙালির আছে ‘পা পিছলে আলুর দম’ বা আলু ভাজি। আলু ভর্তা বোধ করি সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার! এখন ইলিশ মাছ থেকে মাংস, সবজি থেকে ডাল সবকিছুতেই আলু দেওয়া চলে!

পাঁচ. এদেশে ভাতের বিকল্প আলু হয়নি বরং সব ধরনের মাংস বা তরকারির সঙ্গে আলু মেশানোর প্রবণতা বেড়েছে। শিঙারা যেমন জনপ্রিয় তেমনি ডালপুরির জায়গা দখল করে নিয়েছে আলুপুরি! আলু নিয়ে ভ্যানগগের একটি বিখ্যাত চিত্রকর্ম আছে যার নাম—দ্য পটেটো ইটার্স! একালের কোনও চিত্রশিল্পীও এমন কোনও ‘আলুজয়ী’ (কালজয়ীর সমান্তরাল শব্দ) চিত্রকর্ম আঁকতে পারেন!

ছয়. অনেক রাশিয়ান যে ভদকা খেয়ে বুঁদ হয়ে থাকে, এমনকি বাঙালিদের মধ্যেও যে ভদকা জনপ্রিয়, তার অন্তর্হিত কারণও আলু! ভদকা তৈরিতে আলু ব্যবহৃত হয়!

সাত. সরকারি কর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণের বাতিক আছে। কেউ আলুর ওপর শিল্পকর্ম দেখতে, কেউ আলুর গান শুনতে বা কেউ চাষাবাদ দেখতেও বিদেশ যেতে পারেন। তখন পত্রিকায় খবর বের হবে—সরকারি কর্মকর্তাদের ‘আলু’ সফর!

আলু নিয়ে কৌতুকও কম নেই। লেখাটা শুরু হয়েছিল কৌতুক দিয়ে, শেষ হোক কৌতুক দিয়েই।

এক. প্রশ্ন—গত কয়েক বছর আলুর ন্যায্য দাম না পেয়ে কয়েক এলাকার কৃষক রাস্তায় আলু বিছিয়ে প্রতিবাদ করেছিল। আর ২০২০ সালের অক্টোবরে এসে আলুর দাম বেড়ে কেজি হয়ে গেলো আশি টাকা! আলুর দাম কেন বেড়েছে?

উত্তর—যে বাড়ছে তাকে বাড়তে দিন। দুই হাত তুলে প্রার্থনা করুন যে বাড়ছে সে বাড়তে বাড়তে যেন ঝড়ে ভেঙে পড়ে। এছাড়া সবাই জানে যে আলুর দাম যতই বাড়ুক দাম পাবে না কৃষক! কৃষকরা দাম পেলে তো না খেয়ে মরবে ‘সিন্ডিকেট’! আমরা সিন্ডিকেটের মৃত্যু কামনা করতে পারি না!

দুই. প্রশ্ন: সবজিকুলের ভেতরে ঢেঁড়শ আজও একা। কেন?

উত্তর: বয়সকালে আলু ঢেঁড়শকে বলেছিল—আই লাভ ইউ। ঢেঁড়শ উত্তরে বলেছিল—আমি স্লিম ও সেক্সি। আলু তুমি গবেট ও সস্তা। তোমার আমার প্রেম হতে পারে না। আলু দুঃখ পেয়ে অনেকের কাছে গেলো। কেউ আলুকে ফেলতে পারলো না। জুটি হলো অনেকের সঙ্গে। যেমন—

লাউ ও আলু।

কুমড়া ও আলু।

টমেটো ও আলু।

করোল্লা ও আলু।

ক্যাপসিক্যাম ও আলু।

পুইশাঁক ও আলু।

মটরশুঁটি ও আলু।

গাজর ও আলু।

মুলা ও আলু।

এভাবে বাড়তেই থাকলো আলুর প্রেম ও জনপ্রিয়তা। দামও বাড়লো একসময়। সবই দূর থেকে দেখতে হলো ঢেঁড়শকে। কেউ আর ঢেঁড়শের কাছে গিয়ে প্রেম প্রস্তাব দিলো না। ঢেঁড়শ একাই ছিল, একাই থেকে গেলো!

প্রেম অনেক হয়েছে। আলুকে এখন একটু একা থাকতে দিন। প্রার্থনা করুন—সিন্ডিকেট যেন আর আলুর নাগাল না পায়!

লেখক: রম্যলেখক

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ