X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

পুলিশ

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
১১ নভেম্বর ২০২০, ১৫:৩৭আপডেট : ১১ নভেম্বর ২০২০, ১৫:৩৮

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সিলেটে রায়হান হত্যা ঘটনার প্রধান হোতা এসআই আকবরের গ্রেফতার নাটক আমাদের সামনে পুলিশের এমন একটা ছবি উপস্থিত করেছে, যেটি আমরা আসলে দেখতে চাই না। তাকে জনতা ধরে পুলিশে দিয়েছে, কিন্তু জনতার সেই কৃতিত্ব পুলিশ স্বীকার করেনি। জনগণের পুলিশ যে জনগণ থেকেই সবচেয়ে বড় সহযোগিতা পাবে, সেই পথটি যদি পুলিশই অস্বীকার করে, তবে কোন পথে চলি আমরা?
একজন অতি সাধারণ নাগরিককে দশ হাজার টাকার জন্য জঘন্য নির্মম পন্থায় পিটিয়ে হত্যা করা, তারপর সেই হত্যাকে ধামাচাপা দিতে গণপিটুনির গল্প বানানো, পুলিশ হেফাজত থেকেই পুলিশ সদস্যের পালিয়ে যাওয়া, স্থানীয় জনতার হাতে ধরা পড়ার পর সেই এসআই যখন বলে, তারই সিনিয়র দুজন কর্মকর্তা তাকে পালিয়ে যেতে পরামর্শ দিয়েছেন এবং সহযোগিতা করেছেন, তখন অনেক প্রশ্ন জমা হয় আমাদের সামনে।

একটা জনগণের টাকায় চলা বাহিনীর কর্মকর্তা টাকার জন্য মানুষ হত্যা করে, মিথ্যা গল্প বানায় এবং নিজেকে আইনের মুখোমুখি না করে তারই সহকর্মীদের হেফাজত থেকে পালিয়ে যায় এবং তাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে তারই বড় কর্তারা। এই পুরো চিত্রটি আমাদের জন্য অত্যন্ত বেদনার। প্রশ্ন জাগে, তাহলে নীতি নৈতিকতার জায়গা থেকে এমনই এক অবস্থান এই বাহিনীর সদস্যদের?

পুলিশ সদস্যদের কত কত কৃতিত্ব আছে, কত কী মানবিক দৃষ্টান্ত আছে। সেটা করাই স্বাভাবিক, কারণ মানুষের জন্যই তো তারা। কিন্তু অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে বলতে হয় আকবর পর্বটিও অতি স্বাভাবিক এই দেশে। আমরা আসলে কী চরিত্রে দেখতে চাই পুলিশকে, সেটা এক বড় প্রশ্ন। সুপারহিরো–যার দাপটে দুষ্কৃতকারীরা প্রকম্পিত নাকি তাদের মানবিক ব্যবহার ও সহৃদয়তা, যা দিয়ে মানুষের ভালোবাসা আকর্ষণ করবে তারা? আসলে দুটোই প্রত্যাশিত।

আকবর মার্কা পুলিশ সদস্যের আচরণকে বিচ্ছিন্ন ভাববার অবকাশ নেই। পুলিশ কাজ করে আইনের সীমায় এবং তার কাজকর্ম  নিয়েই। তাই তার সতর্ক থাকবার তাগিদও বেশি। পুলিশের অসীম ক্ষমতা। থানা বা ফাঁড়ি হাজতে যে কাউকে ধরে এনে নিষ্ঠুরভাবে প্রহার করতে পারে, যেমনটা করেছেন আকবর ও তার সতীর্থরা। পুলিশ চাইলে যে কারও বাড়ি ঢুকে তল্লাশি করতে পারে, কেবল সন্দেহের বশে যে কাউকে বন্দি করতে পারে, স্বীকারোক্তি আদায় করতে পারে, তার পকেটে মাদক বা আগ্নেয়াস্ত্র প্রবেশ করিয়ে মৃত্যুর ভয় দেখাতে পারে। কিন্তু এসআই আকবর যেটি করেছে সেটিও পারে–তাৎক্ষণিকভাবে একজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলতেও পারে।

গণমাধ্যমের সামনে আশেপাশের লোক সাহস করে বলেছেন তারা রায়হানের বাঁচার আকুতি শুনেছেন, আর্তনাদ শুনেছেন। রায়হান চিৎকার করে বলছিলেন, ‘আমি তো কোনও অপরাধ করিনি, আমাকে মারছেন কেন?’ এমন করেই আটক করার সময় স্থানীয় কিশোর যুবকরা আকবরকে বলছিল, ‘মানুষকে মারার অধিকার কে দিয়েছিল তোমাকে?’ সত্যি বলতে কী, থানার হাজতে অথবা জেলে বন্দিমৃত্যুর এমন অসংখ্য সংবাদে শিউরে ওঠা যায়, কিন্তু প্রতিকার করা যায় না।

যে পুলিশ মানবাধিকার কিংবা আইনকে পদপিষ্ট করতে দ্বিধা করে না, টাকার জন্য পিটিয়ে মানুষ হত্যা করে, সেই পুলিশ নির্মাণ করে কে বা কোন সিস্টেম? এখানে রাজনীতি কতটুকু আছে, প্রশাসনের দায় কতটুকু আছে, সেটা ভাববার প্রয়োজন। অত্যন্ত গভীরে গিয়ে ভাববার প্রয়োজন।

করোনাকালে, আরও নানা সময়ে পুলিশ সদস্যদের মানবিক আচরণ যেমন এই বাহিনীর প্রতি ভালোবাসার জন্ম দেয়, তেমনি নানা স্থানে পুলিশের সঙ্গে জনতার সংঘর্ষ, সিলেটের বন্দরবাজার এলাকার রায়হানের মতো অসংখ্য হত্যাকাণ্ডের ঘটনা পুলিশের প্রতি মানুষের ভেতের থাকা সংশয়কে গভীর করে তোলে।

অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর ক্রসফায়ার কমেছে। কিন্তু কেন্দ্র ও প্রান্ত–উভয় এলাকাতেই আইন হাতে তুলে নিতে এবং নাগরিক অধিকার নস্যাৎ করতেই যে পুলিশ অভ্যস্ত, সে চিত্র বদলায়নি।

প্রতি বছরই পুলিশের কর্তারা পদোন্নতি ও নানা প্রকার সম্মান লাভ করেন। কিন্তু নির্যাতন ও হত্যার দায়ে অভিযুক্তরা কতটা শাস্তি পান, তার কোনও চিত্র মানুষের কাছে স্পষ্ট নয়। জনগণের সরকার জনগণের মানবিক মর্যাদা ও অধিকার রক্ষা করবে, এটা তার সাংবিধানিক দায়িত্ব। পুলিশের দায়িত্বও তাই। কিন্তু এসব করার জন্য পুলিশের প্রেরণা কি আছে কোথাও? নির্বাচিত সরকার আইন প্রণয়নের অধিকার পায়। কিন্তু আইনের মর্যাদা রক্ষা করাও তো তার দায়িত্ব।

সরকারের সবচেয়ে দৃশ্যমান বাহু হিসেবে পুলিশের প্রধান কাজ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা। মনে রাখা দরকার, সেটা পুলিশকে করতে হয় আইন মেনে। আইনের বাইরে গিয়ে নয়। রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাজ হলো, প্রশাসনের কাজ হলো পুলিশকে তার এই মৌলিক দায়িত্ব নির্বিঘ্নে পালন করার ব্যবস্থা করা। পুলিশের কাজের পরিধি অনেকটাই সামাজিক দায়িত্বের মতো। সেখানে তার সততা ও নিষ্ঠায় ঘাটতি থাকলে অপরাধের তদন্ত ও প্রমাণ প্রতিহত হয়। তখন সুশাসনের অবসান হয়।

পুলিশ মানেই অমানবিক বা অত্যাচারী নয়। অসংখ্য পুলিশ কর্মী আছেন, যারা এর উল্টো পথের পথিক, সমাজ তাদের স্যালুট জানায়। বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ে একটা ভাবনা দ্রুত আসুক–পুলিশ তার কুশলতা কাজে প্রমাণ করুক এবং জনতার সামনে তার প্রচলিত ছবিটি বদলে ফেলুক। 

লেখক: সাংবাদিক

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
ঈদে আরিয়ানের একমাত্র নির্মাণ ‘তখন যখন’
ঈদে আরিয়ানের একমাত্র নির্মাণ ‘তখন যখন’
করোনার পর মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
করোনার পর মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ