X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘চলুন মানুষের কারখানায়’, উপন্যাসের শিল্পযাত্রার পূর্ণ মাত্রা

ফারুক আহমেদ
১৫ নভেম্বর ২০২০, ১০:৩৬আপডেট : ১৫ নভেম্বর ২০২০, ১০:৩৯

‘চলুন মানুষের কারখানায়’, উপন্যাসের শিল্পযাত্রার পূর্ণ মাত্রা কথাসাহিত্যিক মনি হায়দারের উপন্যাস, ‘চলুন মানুষের কারখানায়’ মানুষ বাজারের বেচাকেনার সর্বশেষ হিসাব-নিকেশের ফর্দ। কিন্তু প্রিয় পাঠক, নিশ্চয়তা দিচ্ছি হিসাব মিলবে না। হিসাব মিললে উপন্যাসের দেবী আশালতা নায়ক সেলিম চৌধুরী এক ছাতার নিচে থেকেই হিসাব মেলাতেন, কিন্তু...। হিসাবই যদি মিলবে জীবনের নাটক শেষ, শেষ সকল লেনদেন। লেনদেন শেষ হলে, যোগ-বিয়োগ-গুন-ভাগ থাকে না। জীবনে গণিত না থাকলে কারখানা গড়ে ওঠে না। কারখানা না গড়লে নারীপুরুষের সম্ভোগ থেমে যায়। সম্ভোগ ছাড়া মানবজীবন?

‘চলুন মানুষের কারখানায়’ উপন্যাসটি সম্পর্কে লিখতে গেলে প্রাসঙ্গিকভাবে যাত্রাশিল্পের অতীত-বর্তমান হালচাল উঠে আসে। তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে তরুণ প্রজন্মের অনেকে ‘যাত্রা’ শব্দটির সঙ্গে পরিচিত নয়। পাড়ার মুরব্বি-বয়স্ক লোকজনের মুখে ছেলেমেয়েরা যাত্রার গল্প শুনে হা তাকিয়ে থাকে। অথচ বাংলার লোকসংস্কৃতির শেকড় যাত্রাশিল্প। দেশ স্বাধীন হলে অনেক যাত্রাদল গড়ে উঠলেও বর্তমানে যাত্রাপালার অবস্থা শোচনীয়।

উপন্যাসে যা লেখা যায় প্রবন্ধে বেশিরভাগ তা যায় না। আবার প্রবন্ধে যা তুলে আনা সহজ, উপন্যাসে তুলে ধরা ততই কঠিন। নিরেট বস্তুনিষ্ঠ তথ্য উপন্যাসে উপস্থাপন করা সত্যিই দুর্বোধ্য । আশ্চর্যই বটে—লেখক সেই জটিল কাজটি করেছেন যত্নের সঙ্গে। বৈশাখী যাত্রাদলের প্রধান মোহন্ত চৌধুরী যিনি দীর্ঘ বাইশ বছর যাত্রাপালার আধিকারিক, সেই চরিত্রের চিন্তার মধ্য দিয়ে বিবদমান সমস্যা তুলে ধরেছেন—‘যাত্রার মধ্যে আজকাল অনেক অযাত্রা ঢুকে যাচ্ছে। খবিস ধরনের লোকদের হাতে যাত্রা লাঞ্চিত হচ্ছে। ফলে যাত্রার সোনালি গৌরব এখন পড়তির দিকে। এখন যারা যাত্রাদলকে নিয়ন্ত্রণ করে, সরকারের কাছ থেকে অনুমতি আদায় করে, ওরা সরকারি দলের চামচা। সরকারি প্রভাব খাটিয়ে যাত্রাদল এলাকায় নেয়, যাত্রা ভালোবেসে নয়। দুটি কারণকে সামনে রেখে যাত্রাদল এলাকায় নেয়, যদি নায়িকা বা নর্তকীদের সঙ্গে ইয়ে করা যায়। দ্বিতীয়ত, যাত্রাকে সামনে রেখে জুয়ার আসর বসিয়ে টু পাইস কামিয়ে নেয়া যায়। ঘৃণা ধরে গেছে তার এই যাত্রা পেশায়।’

হাজারো ঘটনার ভিড়ে যাত্রাশিল্পকে উপন্যাসের কাহিনি হিসেবে দাঁড় করানো লেখকের স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যের সাহস। সমুদ্রের অতল গহ্বর থেকে মুক্তা তুলে আনা যেমন সাহসী ডুবুরীর কাজ, তেমনি কোনো ব্যতিক্রমধর্মী বিষয়, সামাজিক সংকটকে পাঠকের সামনে শিল্পময়তার সঙ্গে হৃদয়গ্রাহী করে তোলাই যোগ্য ঔপন্যাসিকের প্রার্থনা। 

‘চলুন মানুষের কারখানায়’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আশালতা দেবী। উপন্যাসের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আশালতা দেবী প্রবল দাপটের সঙ্গে বিরাজ করে। বৈশাখী যাত্রাদলের প্রধান নায়িকা আশালতা সৌন্দর্যের দেবী। এক নজর দেখলেই পুরুষেরা কামনায় থেতলে যায়। কিন্তু আশালতা দেবী তো যাত্রাদলের নায়িকা হতে চায়নি। চেয়েছিল অন্য আট-দশটা বাঙালি মেয়ের মতো একটা সংসার।

‘কত কল্পনা, কত ইচ্ছা ছিল একটি নিটোল সংসারের। বিয়ের জন্য বাবা কত ছেলে এনেছিলেন, নানা উছিলায় সব বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে অমলের হাত ধরে পালিয়ে এসেছিলাম। আর অমল? একটা শ্যালো মেশিনের কাছে অমল সেই আশা ধূলিসাৎ করে দিয়েছে।’

নিয়তি আশালতা দেবীকে যাত্রাপালায় নিয়ে এসেছিল। আশালতাকে প্রেমিক অমল ত্রিশ হাজার টাকায় বিক্রি করে শ্যালো মেশিনের বিনিময়ে বা দামে। কথা ছিল, অমল বিয়ে করবে। অমল আশালতাকে ভালোবাসেনি, ভালোবাসার অভিনয় করেছে। আশালতাকে বিক্রি করে দেয় মংলা বন্দরের অপরপারে বানিশান্তার এক পার্টির কাছে। বানিশান্তা সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের বড় বেশ্যাপাড়া। আশালতার কিছুটা হলেও সৌভাগ্য, পুলিশের হাত ধরে বৈশাখী যাত্রাদলের আধিকারিক গোবিন্দ দেবনাথের কাছে আশ্রয় পায় । 

বৈশাখী যাত্রাদল যাত্রাভিনয় করতে এক সময় যায় ভানডারিয়া। সেখানেই নতুন কাহিনি শুরু হতে থাকে। এমনিতেই যাত্রাদলের প্রধান নায়ক সেলিম চৌধুরীর সঙ্গে আশালতার গভীরের নিবিড় সম্পর্ক। অন্যদিকে যাত্রাদলের আধিকারিক গোবিন্দ দেবনাথও আশালতাকে পেতে চায় এবং কড়া নজরে রাখে। আশালতাকে ঘষে মেজে যাত্রার নায়িকা তৈরি করেছেন গোবিন্দ সুতরাং অধিকারটাও বেশী। আট বছর আগে আশালতা যখন দলে এসেছিল তখন ঠিকমতো কথাও বলতে পারতো না।

ভানডারিয়া উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান জালালউদ্দিন খোন্দকার বৈশাখী যাত্রাপালার প্রধান আকর্ষণ আশালতা দেবীকে দেখে প্রেমে মুগ্ধ। দেহ-মনে আগুন জ্বলে ওঠে। জালালউদ্দিন খোন্দকার বিয়ে করেছেন আঠারো বছর আগে। স্ত্রী হেলেনা খানম সুন্দরী, গুণবতী। সংসারে আছে এক মেয়ে, দুই ছেলে। মেয়ে সবার বড়। সিমলা কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে।

কন্যার বয়সী আশালতাকে পেতে জালালউদ্দিন খোন্দকার মরিয়া। যে করেই হোক আশালতাকে  চাই-ই চাই! গোবিন্দ দেবনাথকে ডেকে চালের আড়তের গদিতে ইচ্ছার কথা মোলায়েম কিন্তু দৃঢ় গলায় বলেন জালালউদ্দিন খোন্দকার—‘আমি আপনার যাত্রার নায়িকা আশালতাকে বিয়ে করতে চাই।’

গোবিন্দ দেবনাথ দুশ্চিন্তায়। কারণ ইতোমধ্যে জালালউদ্দিন খোন্দকারের অর্থ- ক্ষমতা সম্পর্কে  টের পেয়ে গেছে। খুনের আসামি হয়েও ক্ষমতার দাপটে জেল থেকে বের হয়ে এসেছেন  খোন্দকার। জালালউদ্দিন খোন্দকার যাত্রার নায়ক সেলিম চৌধুরীকেও দজুনের সর্ম্পকের রসায়নটা বুঝতে চেয়েছেন। সেলিম চৌধুরী বুঝতে পেরেছিল জালালউদ্দিন খোন্দকার ভয়ানক কুমির। শরীর ভয়ে কিছুটা কাঁপছিল।

কাউকে বাগে আনার সব কৌশলই জানা আছে জালালউদ্দিন খোন্দকারের! আশালতা দেবীকে পাওয়ার বিনিময়ে সেলিম চৌধুরীকে এক লক্ষ টাকা দেয়ার প্রস্তাব দেন তিনি। আশি হাজার টাকার বান্ডেল সেলিম চৌধুরীর পকেটে ঢুকিয়েও দেন এবং বাকি বিশ হাজার টাকা আশালতা দেবীকে পাওয়ার পরে দেবেন।

ঠিকই সেলিম চৌধুরী টাকা গ্রহণ না করে পারেনি। পেয়াদা বংশের ছেলে। বাবা জসিমউদ্দিন পেয়াদা, পুত্র খবিরউদ্দিন পেয়াদা। যাত্রায় অভিনয় করতে এসেই না খবিরউদ্দিন পেয়াদা বনে যান সেলিম চৌধুরী! মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে উজানগাঁও গ্রামের জসিমউদ্দিন পেয়াদার বড় ছেলে খবিরউদ্দিন পেয়াদা ‘দ্য নিউ গোপাল যাত্রাদল’-এর আধিকারিক মোহন্ত চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে যান বাগেরহাটের বাড়ইখালী গ্রামে। মোহন্ত চৌধুরীর হাত ধরে খবিরউদ্দিনের যাত্রাপালায় নায়ক হিসেবে পদযাত্রা। সাতটা যাত্রাদলের পর সেলিম চৌধুরী এখন আধিকারিক গোবিন্দ দেবনাথের যাত্রাপালায় কাজ করছে। মূলত খবিরউদ্দিন পেয়াদা ওরফে সেলিম চৌধুরী দরিদ্র কৃষকের সন্তান। বাপের জমিজমা নেই বললেই চলে। একজোড়া গরু কিনে যে জমিতে হালচাষ করবে, ফসল ফলাবে সেই টাকা কোনোদিনই বেচারা কৃষক জসিমউদ্দিন পেয়াদা জোটাতে পারল না। ‘টাকাটা হাতে নিলে নিশ্চয়ই চোখ ঠিকরে বের হয়ে আসতে চাইবে বাবা জসিমউদ্দিনের’—সেলিম চৌধুরী ভাবে। হাসি পায় তার, এক নারীর বিনিময়ে এক জোড়া গরু।  

আশালতাকে নিয়ে জালালউদ্দিন খোন্দকার এবং গোবিন্দ দেবনাথের মধ্যে খেলা শুরু জমে ওঠে। গোবিন্দ দেবনাথ কৌশলে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সিকান্দার বখতকে  লাগায় খোন্দকারের বিরুদ্ধে। যাদের আমন্ত্রণে ভানডারিয়ায় এসেছে বৈশাখী যাত্রাদল, তাদেরই একজন সিকান্দার বখত। বখতের হাতে থানা-পুলিশ। এইখানে গোপন সংবাদ জানান লেখক, ‘সিকান্দার বখত এবং থানার ওসি কামরুদ্দিন দু’জনেরই আশালতার দেহের প্রতি লোভাতুর।’ আশালতা থেকে দৃষ্টি ফেরাতে গোবিন্দ দেবনাথ ওসি কামরুদ্দিনের বাসায় প্রতি রাতে একজন করে নর্তকী পাঠায়। আর সিকান্দার বখতকে ঠান্ডা করার জন্য দেশি মদের বোতল এবং নাচের মেয়ে রোখসানাকে সামনে এগিয়ে দিয়েছে। রোখসানা বিশাল নিতম্ব আর স্তন দোলাতে দোলাতে সিকান্দার বখতের কাছে জড়িয়ে ধরে। সিকান্দার বখতও জড়িয়ে ধরে রোখসানার শরীর। ‘আমি জ্বইলা যাইতেছি রে রসের বাইদানি, আমারে একটু ঠান্ডা কর।’

কোন পুরুষ চায়নি আশালতাকে ভোগ করতে? ইউসুফ আলী নামে একজন ছবির পরিচালক তাকে সিনেমার নায়িকা বানানোর প্রস্তাবে ঢাকায় নেয়ার ফাঁদ পেতেছিল। সেলিম চৌধুরী সর্তক করে দেয়ার কারণে আশালতা সেদিকে আর পা বাড়ায়নি।

দুজনের যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত গোবিন্দ দেবনাথ বশীভূত হয়, জয়ী হন ভানডারিয়া উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান—সিমলা রাইস মিলের মালিক জালালউদ্দিন খোন্দকার। আশালতাকে তুলে এনে জালালউদ্দিন খোন্দকার আটকে রাখলেন এক ভাড়া বাড়িতে। বন্দিজীবনে আশালতা ভাবে—‘একমাত্র নারীর শরীরের নরম মাংস আর একটি গোপন সুরঙ্গের জন্য পুরুষের এত যুদ্ধ, এত নির্মমতা?’

পরনারীর প্রতি স্বামীর আসক্ত হওয়াকে কোনো স্ত্রীই মেনে নেবে না, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ঔপন্যাসিক পাঠকদের নিয়ে খেলবেন না, সেটা হতে পারে না। তিনি উপন্যাসের মধ্যে নিয়ে এলেন, ভিন্ন ডাইমেনশন। জালালউদ্দিনের স্ত্রী হেলেনা খানম বেশ শান্ত-অনুদ্ধত, স্থির বুদ্ধিসম্পন্ন। দয়ালুও বটে। ভানডারিয়া ছোট উপজেলা শহর। এখানে যা ঘটে, অনেকের কাছে ছড়িয়ে যায়। স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের ঘটনাও জানলেন হেলেনা খানম। তিনি সমাজের মানুষের কুৎসা-রটনাকে দূরে ঠেলে স্বামীর অজ্ঞাতে মেয়ে সিমলাকে নিয়ে আশালতাকে বাড়িতে নিয়ে এলেন।

নিজের হাতে গড়া সংসারের ভাগ কোনো নারী দিতে পারে? অবাক আশালতা। হেলেনা খানমকে শুধু শ্রদ্ধা করতেই ইচ্ছে করছিল।

‘আমি কিন্তু তোমাকে ছোট মা ডাকব।’ আশালতার কানের কাছ মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলে সিমলা।

আশালতাকে যখন ঘরে উঠানো হচ্ছিল লেখক মনের অবস্থা বর্ণনা করেছেন এভাবে—‘হেলেনকে দেখে আশালতার মনে হয় হাজার বছরের মহাভারত থেকে নেমে আসা মানবিক দেবী। যে দেবী শান্তির অমিয়ধারায় জীর্ণ ধরাকে স্নাত করার জন্য আসমান থেকে এসে সামনে দাঁড়িয়েছে। ধান ও দূর্বাদলে কোনোদিন কেউ সংসারে বরণ করে নেবে, এমন নিয়তি নিয়ে এসেছিল, ভাবেনি গত কয়েক বছরে।’

জালালউদ্দিন খোন্দকারের প্রতি আশালতার ধারণা পাল্টেছে। মানবিক আচরণ ও ভালোবাসার প্রমাণ পেয়েছে খোন্দকারের, ধৈর্য্যে আশালতা এখন মুগ্ধ—‘না, মানুষটা বাঘের ক্ষুধা নিয়ে এখনও ক্ষতবিক্ষত করছে না, এখনও অপেক্ষা করছে বিনম্র প্রশ্রয়ের, ভালোবাসার...।’

মানুষ এক বিস্ময়কর প্রাণী। শরীরের কাঠামোয় দেখতে এক রকম কিন্তু ভালোবাসায় হতে পারে, স্নিগ্ধ, গভীর। জালালউদ্দিন চরিত্র সৃষ্টির মধ্যে মনি হায়দার মানুষের চরিত্রের দ্বৈততার অসাধারণ প্রকাশ ঘটিয়েছেন। দেখিয়েছেন—মানুষ অদম্য এক প্রাণী। অসাধ্য কিছু নেই, যদি থাকে টাকা আর ক্ষমতা। 

স্বামীকে আশালতার সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে হেলেনা খানম ‘আজ থেকে, এই মুহূর্ত থেকে আমি সিমলার সঙ্গে থাকব। তুমি তোমার মতো থাকো, আমি সব সময়ে তোমার কল্যাণ চাই...।’ বেডরুমের দরজায় দাড়িয়ে শান্ত মন্থিত কণ্ঠে বলে হেলেনা খানম। 

জীবনে এই প্রথম নিজেকে বড় শূন্যের মধ্যে দেখতে পান ক্ষমতাবান জালালউদ্দিন খোন্দকার। আশালতা দেবীকে তুলে এনেছেন অনেকটা ঝোঁকের মাথায়! ঝোঁক বা ক্ষণকালিন কামনার স্রোত মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়, মনি হায়দার ‘চলুন মানুষের কারখানায়’ উপন্যাসের এই চরিত্র তৈরী করে প্রমাণ রাখলেন।

আশালতা দেবীর সংসার সুখেই কাটছিলো। একসময় হেলেনা খানম অসুস্থ হয়ে যায়। ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ে। খোন্দকার হেলেনা খানমকে ঢাকায় চিকিৎসা করাতে নিয়ে গেলেও লাভ হলো না। কষ্ট পেয়ে এক সকালে হেলেনা খানম মারা যায়। সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হওয়া, স্ত্রীর মৃত্যুসহ নানাবিধ কারণে জালালউদ্দিন খোন্দকার দমে যান। এক বিকেলে সড়কে আনমনে চলতে চলতে বাসের ধাক্কায় ছিটকে পড়ে মেরুদণ্ডের প্রধান কর্ড ছিঁড়ে  যায়। সেই থেকে বিছানায় খোন্দকার।

মনি হায়দারের ‘চলুন মানুষের কারখানায়’ উপন্যাসে  শেষ পরিচ্ছেদে  পাঠকের জন্য  বিস্মিয় অপেক্ষা করে। এক সময়ের পরাক্রমশালী জালালউদ্দিন খোন্দকারের মেয়ে সিমলার বিয়ের ঘটনা বজ্রপাতের মতো আটকে দেয় শ্বাস। ঔপন্যাসিকের শাণিত যুক্তি এবং আখ্যান বয়ানের ধরন এত চমৎকার যে নিমিষেই আবার পাঠককে স্বাভাবিকতায় ফিরিয়ে আনে। সিমলার বিয়ে হয় খবিরউদ্দিন পেয়াদা ওরফে সেলিম চৌধুরীর সঙ্গে। এক লাখ টাকা পেয়ে কয়েক বছর হলো অভিনয় ছেড়ে বাপের সঙ্গে জমিতে চাষাবাদ শুরু করেছিল সেলিম চৌধুরী। ভাবনা ছিলো—‘আশালতা যেখানে নেই সেখানে অভিনয় করবো কীভাবে? মনের সঙ্গে মিল না হলে আর যাই হোক শিল্প হয় না...।’

মেয়ের পাশে বর হিসেবে খবিরউদ্দিন পেয়াদাকে দেখে  খোন্দকার ক্রোধে ফেটে পড়েন। কিন্ত কী করার আছে? চলচ্ছক্তিহীন হয়ে গেছেন, পঙ্গু তিনি। আশালতার হাতে সবকিছুর ভার। স্থির সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। মাঝে মাঝে দিশেহারা হয়ে পড়ে। এদিকে মেয়ে সিমলার বয়স হয়েছে। বিএ পাস করেছে দু বছর আগে। সিমলার নিজেরও বিয়ে করার প্রবল ইচ্ছে! অনেক বিয়ের প্রস্তাব আসে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিয়ে হয় না। মূল কারণ আশালতা। ঘরে সৎ মা এবং হিন্দু, আবার যাত্রার নায়িকা...। আশালতার চিন্তা হলো—‘মেয়েটার যদি বিয়ে না হয় চিরকাল আমাকে দায়ী করবে।’

ছেলের ছবি আর বায়োডাটা দেখে আশালতা প্রথমে চমকে গেলেও নিজেকে সামলে নেয়।

মানব জীবন বড় জটিল, বড় নাটকীয় আর ক্ষণস্থায়ী, ‘চলুন মানুষের কারখানায়’ উপন্যাসে প্রমাণ রাখলেন অনন্য কথাকার মনি হায়দার। ক্ষণস্থায়ী ক্ষমতার মায়ায় শক্তিমান খোন্দকারও অসহায় এখন। বর সেলিম চৌধুরীর হাতে সিমলাকে তুলে বিদায় দিয়ে ঘরে ঢুকে আশালতা দেখে খোন্দকার জালালউদ্দিন বিছানায় উপুড় হয়ে কাঁদছেন। হাতে একটা চকচকে ছুরি। আশালতা ভয় পেয়ে যায়, তাকে আবার খুন করে কিনা! না—ছুরিটা বাড়িয়ে দেয় খোন্দকার এবং বুকের উপর থেকে নিজের জামা সরিয়ে নেন—‘আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করছে না। আমাকে তুমি খুন করো। আমাকে খুন করার অধিকার তোমার আছে আশালতা। আমি সবাইকে বলে যাব, আমার খুনের বা মৃত্যুর জন্য তুমি দায়ী নও। আমি তোমাকে খুন করতে বলেছি...। করো, আমাকে খুন করো...। বিশ্বাস করো আমি আর বাঁচতে চাই না। খুন করো... আমাকে দয়া করো আশা, আমাকে খুন করো...।’ 

শৈশব-কৈশোরে দু-চারটা যাত্রাপালা দেখেছি। পরিণত বয়সে এসে যাত্রাপালা আয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার সুযোগ হয়েছে। যাত্রার অভিনয়শিল্পীদের খুব কাছ থেকে লক্ষ করি। দর্শকদের সারিতে থেকে শিল্পীদের মঞ্চে দেখা আর বাইরে দেখার মধ্যে অনেক তফাত। অন্যদিকে আয়োজকদের দৃষ্টি আরো উপরে । আকাশ থেকে জমিনের মানুষগুলোকে দেখে। তখন কোনো বহিরাবরণ থাকে না, সব খোলসই ঝরে পড়ে। ‘চলুন মানুষের কারখানায়’ উপন্যাসটি পড়ে আমি অভিভূত হয়েছি। ভাষাশৈলী, শব্দচয়ন, চরিত্রনির্মাণ, সংলাপ, কাহিনিকে এগিয়ে নেওয়া—সবকিছু মিলিয়ে ক্ষুরধার। লেখক নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন যাত্রার রূপ। বাস্তবের মতই উপন্যাসে যাত্রাভিনয়ের সাথে যুক্ত চরিত্রগুলো যে নিরীহ, আমরা লক্ষ করি। অমল এবং সেলিম চৌধুরীর কাছে প্রেমিকা আশালতার চেয়ে টাকাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। যদিও দুজনের  প্রেক্ষাপট ভিন্ন কিন্তু উদ্দেশ্য অভিন্ন—টাকা পেয়ে চাষাবাদে মনোযোগ দেয়া। গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের মূল পেশা—কৃষিকাজ। কত সামান্য চাওয়া!

উপন্যাস : চলুন মানুষের কারখানায়। প্রকাশনী : দ্যু। প্রচ্ছদ : শতাব্দী জাহিদ। দাম : দু’শ টাকা।  

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সংরক্ষিত আসনের ১৬ শতাংশ এমপির পেশা রাজনীতি
সংরক্ষিত আসনের ১৬ শতাংশ এমপির পেশা রাজনীতি
ঢাবির সব ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ
ঢাবির সব ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ
বাংলাদেশের আম-কাঁঠাল-আলু নিতে চায় চীন
বাংলাদেশের আম-কাঁঠাল-আলু নিতে চায় চীন
শিশু অপহরণ করে নিঃসন্তান দম্পতির কাছে বিক্রি করতো চক্রটি
শিশু অপহরণ করে নিঃসন্তান দম্পতির কাছে বিক্রি করতো চক্রটি
সর্বাধিক পঠিত
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
রাজধানীর ৫ জায়গায় তরমুজ বিক্রি হবে কৃষকের দামে
রাজধানীর ৫ জায়গায় তরমুজ বিক্রি হবে কৃষকের দামে