X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

রোহিঙ্গারা যাবে ভাসানচর

মো. জাকির হোসেন
০৩ ডিসেম্বর ২০২০, ১৮:১২আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০২০, ১৮:৪৮

মো. জাকির হোসেন রোহিঙ্গারা যাবে ভাসানচর না লিখে যদি লিখতে পারতাম ‘রোহিঙ্গারা যাবে বাড়ি’ তাহলে শুধু আমি না পৃথিবীর মানবতাবাদী সকল মানুষ খুশি হতেন– রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে, স্ব-গৃহে প্রত্যাবর্তন দেখে। একবিংশ শতাব্দীর সভ্যতার কলঙ্ক দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র মিয়ানমার সরকারের কবে বোধোদয় হবে সে অপেক্ষায় শান্তিকামী, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে  মানবাধিকারে বিশ্বাসী বিশ্ববাসী। যতদিন নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন বা তৃতীয় কোনও দেশে বসতি স্থাপনের সুযোগ না পাচ্ছে ততদিন রোহিঙ্গাদের আরেকটু সুন্দরভাবে বেঁচে থাকা মানবিকতার দাবি। অতিরিক্ত রোহিঙ্গাদের ভারে হাঁপিয়ে ওঠা পর্যটন নগরী কক্সবাজারের প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেওয়া দরকার।

জনবসতির চাপে বিপন্ন কক্সবাজারের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র‌্যকে বাঁচাতে হবে বাংলাদেশের স্বার্থে। আইনশৃঙ্খলা ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে রোহিঙ্গা শিবিরের অসহনীয় ও অগ্রহণযোগ্য ঘনবসতির জনসংখ্যা হ্রাস করা অতি আবশ্যিক। এসব বিষয় মাথায় রেখে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক ইচ্ছা ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার চরঈশ্বর ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ভাসানচরে নির্মিত হয়েছে শহরের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত পরিকল্পিত আবাসন। দৃষ্টিনন্দন ও পরিকল্পিত এ আবাসন নির্মাণে সরকার উদার হস্তে অর্থ ব্যয় করেছেন। প্রথমে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা। পরে সড়ক সম্প্রসারণ, বেড়িবাঁধ উঁচুকরণ ও আনুষঙ্গিক কাজ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রকল্প ব্যয় ৭৮২ কোটি টাকা বেড়ে উন্নীত হয় ৩ হাজার ৯৪ কোটি টাকায়। রোহিঙ্গাদের সাময়িক বসতির জন্য পরিকল্পিত এ আবাসনে উন্নতমানের রাস্তাঘাট, নিরবচ্ছিন্ন নিজস্ব বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা, ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসাসেবা, ফোরজি নেটওয়ার্ক, নিরাপত্তার জন্য সিসিটিভি স্থাপনের ফলে পাল্টে গেছে চরটির সামগ্রিক চিত্র। পর্যাপ্ত সুপেয় পানি, পরিবেশসম্মত স্যানিটেশন সুবিধা, খাদ্য সংরক্ষণ ও সরবরাহ ব্যবস্থা ও জীবিকা নির্বাহের সুযোগ-সব মিলিয়ে ভাসানচর এখন যেন আধুনিক এক শহর। এই চরের পার্শ্ববর্তী উপজেলা হাতিয়া ও সন্দ্বীপ শত বছরেও যে আধুনিকতার ছোঁয়া পায়নি, ভাসানচর তারচেয়েও বেশি পেয়েছে মাত্র দুই বছরে।

দ্বীপের ১৩ হাজার একর ভূমির মধ্যে ৬ হাজার ৪২৭ একর জায়গা কখনও জোয়ারের পানিতে ডোবে না। এ স্থানটুকু নির্বাচন করা হয়েছে মূলত আশ্রয়ণ প্রকল্প-৩ এর ভূমি হিসাবে। নৌবাহিনীর সরাসরি তদারকিতে ১০ থেকে ১৫ হাজার কর্মীর ২ বছর ধরে দিনরাত পরিশ্রমে নির্মিত হয়েছে এ আবাসন। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা এমডিএম আর্কিটেক্টস দ্বারা এর অভ্যন্তরীণ স্থাপনাসমূহ নির্মাণের পরামর্শ নেওয়া হয়েছে। অনুসরণ করা হয়েছে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) স্ট্যান্ডার্ড। পুরো আবাসন সাইটটির নিরাপত্তায় রয়েছে ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ বন্যা সুরক্ষা বাঁধ। ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু সাইক্লোনের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন করার লক্ষ্যে রামগতি ও নোয়াখালীতে ‘গুচ্ছগ্রাম’ এর ধারণা প্রথম প্রবর্তন করেছিলেন। পরে একই ধারণাকে আনুষ্ঠানিক রূপ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই গুচ্ছগ্রামের ধারণা থেকেই রোহিঙ্গাদের জন্য আশ্রয়ণ-৩ নামের এ আবাসন। রোহিঙ্গারা ফিরে গেলে বাংলাদেশের ভূমিহীন দুস্থ মানুষের থাকার জন্য দ্বীপটি ব্যবহার করা হবে। ভাসানচর মোট ১৩ হাজার একরের হলেও মাত্র এক হাজার ৭০০ একর জমির চারদিকে বাঁধ দিয়ে ৪৩২ একরের ওপর গুচ্ছগ্রাম (ক্লাস্টার হাউস) ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। ৩৫২ একর জমি নৌবাহিনীর ফরওয়ার্ড বেইজের জন্য নির্ধারিত রয়েছে। ৯৩২ একর ভবিষ্যৎ সম্প্রসারণের জন্য ফাঁকা রাখা হয়েছে। ফলে এখন এক লাখ রোহিঙ্গাকে এখানে স্থানান্তরের পর চাইলে পুরো ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে ধীরে ধীরে স্থানান্তর করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন ভাসানচর আবাসন প্রকল্পের পরিচালক নৌবাহিনীর কমডোর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী। ভাসানচরে ১২০টি গুচ্ছগ্রামে ১ হাজার ৪৪০টি বসতঘর রয়েছে। প্রতিটি গুচ্ছগ্রামে রয়েছে ১২টি গৃহ এবং প্রতিটি গৃহে আছে ১৬টি কক্ষ। প্রতিটি কক্ষে পরিবারের ৪ জন করে থাকতে পারবেন। বসবাসকারীদের জন্য আছে রান্নাঘর, পানীয় জলের সুবিধা ও নারী-পুরুষের জন্য পৃথক পৃথক শৌচাগার। রয়েছে ৩টি মসজিদ, ২টি ২০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল এবং চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক। এছাড়া সুযোগ রয়েছে পার্শ্ববর্তী হাতিয়া উপজেলায় গিয়ে চিকিৎসা সুবিধা গ্রহণ করার। বাসিন্দাদের কারও মৃত্যু হলে সৎকার ও কবর দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা রাখা হয়েছে। এখানে ২৪ ঘণ্টাই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে। ১ মেগাওয়াট হাইব্রিড সোলার প্যানেল, প্রয়োজনীয় পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন লাইন, একটি ১ মেগাওয়াট জেনারেটর, দুটি ৫০০ কিলোওয়াটসহ মোট ৩টি ডিজেল জেনারেটর স্থাপন করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ভাসানচরে প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহের জন্য ৫০০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন ২টি ফুয়েল ট্যাংক।  অগ্নিপ্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে দুটি ফায়ার জিপসহ একটি ফায়ার স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া ক্লাস্টার হাউসসমূহে অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম সংযোজন করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের সন্তানদের পড়াশোনার জন্য রয়েছে স্কুল। শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্যও এতে রয়েছে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। তাদের খেলাধুলার জন্য রয়েছে দুটি প্রশস্ত খেলার মাঠ। এর বাইরেও প্রতিটি গুচ্ছগ্রামে স্বল্প পরিসরে খেলাধুলার ব্যবস্থা রয়েছে। বাজার ও বিপণনের ব্যবস্থাও তৈরি করা হয়েছে ভাসানচরে। তিনটি খাদ্যগুদাম নির্মাণ করা হয়েছে। ভাসানচরকে থানা ঘোষণা করে একটি পরিপূর্ণ থানা কমপ্লেক্সও নির্মিত হয়েছে এখানে। নৌবাহিনী, পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার উপস্থিতি থাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থাও সুদৃঢ় এখানে। নিরাপত্তা আরও জোরদার করতে ১২০টি সিসি টিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। রোহিঙ্গারা ভাসানচরে যাওয়ার পর প্রথম দুই মাস তাদের রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হবে। এরপর নিজ নিজ বাসস্থানেই তারা রান্না করতে পারবেন। কেন্দ্রীয়ভাবে করা হয়েছে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট। সরকার ও এনজিওগুলোর পক্ষ থেকে ভাসানচরে ৬৬ টন খাদ্যসামগ্রী মজুত করা হয়েছে। ত্রাণসামগ্রী (খাদ্য ও অন্যান্য আইটেম) সংরক্ষণের জন্য এক লাখ রোহিঙ্গাদের আনুমানিক ৩ মাসের খাবার সংরক্ষণের নিমিত্তে চারটি ওয়্যারহাউজ নির্মাণ করা হয়েছে। বৃক্ষরোপণের জন্য একটি নার্সারিও গড়ে তোলা হয়েছে। ভাসানচরে স্থানান্তরিত রোহিঙ্গারা চাইলে অর্থনৈতিক নানা কাজে অংশ নিতে পারবেন। রোহিঙ্গারা চাইলে ভাসানচরে ফসল-মাছ চাষ-পশুপালন করতে পারবেন। বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি আবাদ করা হচ্ছে এখানে। পরীক্ষামূলকভাবে ধান চাষও করা হচ্ছে এখানে। অসহায় রোহিঙ্গারা যাতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে হতাশা কাটিয়ে উঠতে পারেন এবং তারা যাতে দক্ষ কর্মী হয়ে মিয়ানমার ফিরে যেতে পারেন সে জন্যও উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। বসবাসকারীদের জন্য গবাদি পশুপালন, দুগ্ধজাত দ্রব্য উৎপাদন এবং ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের ব্যবস্থা রয়েছে। মাছ চাষের জন্য বিশাল লেক ও অনেকগুলো পুকুর রয়েছে ভাসান চরে। পরিকল্পিত এ আবাসনে কিছুই বাদ যায়নি। এমনকি রোহিঙ্গাদের জন্য নির্মিত প্রতিটি আবাসিক ভবনের সামনে লেবু ও তুলসী গাছ লাগানো হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের জন্য আধুনিক বাসস্থান ছাড়াও বেসামরিক প্রশাসনের প্রশাসনিক ও আবাসিক ভবন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভবন, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের আবাসিক ভবন, নৌ-বাহিনীর কর্মকর্তাদের জন্য বাংলো, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কর্মকর্তাদের জন্য অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত বাংলো নির্মাণ করা হয়েছে ভাসান চরে। প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত জাতিসংঘ প্রতিনিধি, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) প্রতিনিধি, রেডক্রস ও আন্তর্জাতিক এনজিওর প্রতিনিধি, এতিমখানা, ডে কেয়ার সেন্টার ও সুপারশফের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

দ্বীপটিতে আজ অবধি কোনও সাইক্লোন হয়নি। ১৯৯৭ সালে দ্বীপের সবচেয়ে কাছাকাছি সাইক্লোন এসেছিল। এটি দ্বীপ থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে ছিল। তবে জলোচ্ছ্বাসে পানি উঠেছিল। ১৭৬ বছরে বাংলাদেশের উপকূলে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় পর্যালোচনা করে আবাসনকে ঘিরে বিজ্ঞানসম্মতভাবে তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয় দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বেড়িবাঁধ। ভবিষ্যতে যাতে পানি না ওঠে এজন্য বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এই বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে ৯ ফুট উঁচু করে। প্রশস্ত ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল তৈরি করা হয়েছে, যা ঘূর্ণিঝড়কালীন সমুদ্রের ঢেউয়ের প্রকোপ থেকে দ্বীপের ভূমি রক্ষা করবে। বাড়িগুলো মাটির চার ফুট ওপরে কংক্রিটের ব্লক দিয়ে তৈরি। ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাস হলে আশ্রয় নেওয়ার জন্য ১২০টি সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলো এমনভাবে স্টিল, কংক্রিট এবং কম্পোজিট স্ট্রাকচারে তৈরি যা ২৬০ কিলোমিটার গতির ঘূর্ণিঝড় সহ্য করতে সক্ষম। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় প্রতিটি শেল্টার স্টেশনে ১ হাজার করে ১২০টি সেন্টারে ১ লাখ ২০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। এছাড়া প্রতিটি সাইক্লোন শেল্টারের নিচতলায় আশ্রয় নিতে পারবে ২শ’ করে গবাদি পশু।

এতকিছুর পরও জাতিসংঘ সহ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মকর্তারা ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তরে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে সরকারের ওপর একধরনের অনৈতিক চাপ সৃষ্টি করেছে। তারা বারবার বলছেন রোহিঙ্গাদের ইচ্ছা অনুযায়ী ভাসানচরে স্থানান্তর হতে হবে। বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে যে রোহিঙ্গাদের ইচ্ছা অনুযায়ী সবকিছু হতে হবে। এদেশের মানুষের ভালো-মন্দ যেন রোহিঙ্গাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কাছে ইজারা দেওয়া হয়েছে। কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা দাবি করেছে ভাসানচরের ভেতরে-বাইরে রোহিঙ্গাদের চলাচলের স্বাধীনতা থাকতে হবে। পৃথিবীর কোন দেশ শরণার্থীদের অবাধ চলাচলের স্বাধীনতা দেয়? আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ভুলে গিয়েছে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শরণার্থী চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি এবং রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ শরণার্থীর মর্যাদাও দেয়নি। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আইনগত অবস্থান বাস্তুচ্যুত এর বেশি নয়। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর এ ধরনের বক্তব্য কোনও রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপের শামিল যা আন্তর্জাতিক আইনে নিষিদ্ধ। ভাসানচরে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ সহ কিছু দেশ রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ভাসানচর নিয়ে আপত্তি উত্থাপনকারীদের কাছে প্রশ্ন কক্সবাজারের শিবিরগুলোতে কী নিরাপত্তার হুমকি নেই? পাহাড় কেটে রোহিঙ্গাদের জন্য আশ্রয় শিবির নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে ভূমিধসের শঙ্কার পাশাপাশি শক্তিশালী সাইক্লোন বা বড় জলোচ্ছ্বাস হলে কী নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে না এসব শিবিরের বাসিন্দারা? রোহিঙ্গা শিবিরগুলো হত্যা, ধর্ষণ, মানবপাচার, অস্ত্রপাচার ও ইয়াবাপাচারের ভয়ংকর আখড়ায় পরিণত হয়েছে। রোহিঙ্গা দুর্বৃত্তরা এদেশের মানুষদেরও হত্যা করছে। আনসার ক্যাম্পে আক্রমণ করে ক্যাম্প প্রধানকে হত্যা করেছে। ১১টি অস্ত্র লুট করে নিয়েছে। পাসপোর্ট, এনআইডি জালিয়াতি করে এমনকি বিদেশে গিয়ে বাংলাদেশের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গাদের কারণে কর্মসংস্থান ও জীবিকা হারিয়ে ক্রমশই ফুঁসে ওঠছেন স্থানীয় অধিবাসীরা। এটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে যে কোনও সময়। রোহিঙ্গা শিবিরকে ঘিরে উগ্রবাদের শঙ্কার বিষয়ে এবং তাদেরকে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অপব্যবহারের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারিত হচ্ছে বারবার।

পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর সেনাবাহিনীর টহল দলের ওপর হামলার কথা শোনা যায়নি। কিন্তু গত বছরের আগস্টে রাঙামাটিতে সেনাবাহিনীর নিয়মিত টহল দলের ওপর একই দিনে দুটো হামলার ঘটনা ঘটে। হামলাকারীদের হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্র ছিল যেগুলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীদের হাতে দেখা যায়, তাদের পরনে ইউনিফর্ম ছিল। এ ঘটনায় সন্দেহের তীর আরাকান আর্মি নামে মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর দিকে। বছর দুই আগে রাঙামাটির রাজস্থলী উপজেলা থেকেই আরাকান আর্মির অন্যতম শীর্ষ নেতা রেনিন সোয়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন। আরকান আর্মি তাদের হয়ে লড়াই করার জন্য বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকা থেকে ‘রিক্রুট’ করার চেষ্টা করছে বলে জনশ্রুতি আছে। এসব কি বাংলাদেশের জন্য ভয়ংকর নিরাপত্তা ঝুঁকি নয়? ভাসানচর বাদ দিলাম আমাদের উপকূলীয় জনগণ কী ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়ে জীবনহানি ও সম্পদহানির শিকার হচ্ছে না? তারা কী উপকূলীয় এলাকা ছেড়ে চলে গিয়েছে? তাহলে রোহিঙ্গাদের জন্য কেন এমন মায়াকান্না? ভাসানচরে কি শুধু রোহিঙ্গারা থাকবে, না বাংলাদেশের বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ, নৌবাহিনী সহ শত শত বাঙালিও সেখানে বাস করবেন? বাঙালিরা থাকতে পারলে রোহিঙ্গাদের জন্য কেন দরদ উথলে ওঠে? রোহিঙ্গাদের প্রতি আপনাদের দরদ বাঙালিদের চেয়ে বেশি হলে কে মানা করেছে আপনাদের নিজ দেশে নিয়ে যেতে? রোহিঙ্গা শিবির মৌচাকে পরিণত হয়েছে। একে কেন্দ্র করে দেশি-বিদেশি ‘মধু সংগ্রহকারীরা’ সুবিধা আদায় করতে চান। আবার অনেকেই কক্সবাজারের ৫ তারা হোটেলের আরাম-আয়েশ ছেড়ে ভাসানচরের কম আরাম-আয়েশে যেতে চান না বলে রোহিঙ্গা স্থান্তান্তরই ঠেকিয়ে রাখতে চান।

গবেষণা সাক্ষ্য দেয়, অতিরিক্ত ঘনত্বের জনবসতিকে কেন্দ্র করে নানা অপরাধ জন্ম নেয়। ক্রসফায়ারসহ নানা কৌশল অবলম্বন করেও সরকার ইয়াবা বন্যা ঠেকাতে পারছেন না। রোহিঙ্গা শিবিরকে কেন্দ্র করে ১৪টি প্রতিদ্বন্দ্বী দুর্বৃত্ত গ্রুপ জন্ম নিয়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিবেদনে প্রকাশ। এদের মাধ্যমে অবৈধ অস্ত্র আসছে বাংলাদেশে। এছাড়া পরিবেশ, জীববৈচিত্র‌্য, পর্যটন সহ নানা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি করছে রোহিঙ্গা শিবির। ১ লাখ রোহিঙ্গা গেলেই কক্সবাজারের রোহিঙ্গা পরিস্থিতির উন্নতি হবে এমন বলা যাবে না। তবে ভাসানচরে আরও কয়েক লাখ স্থানান্তরের সুযোগ রয়েছে। ধীরে ধীরে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা বসতি কমিয়ে আনতে হবে, নইলে রাষ্ট্রকে চড়া মূল্য দিতে হতে পারে।

লেখক:  অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: [email protected]

 

/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ধাক্কা মেরে ফেলে চাপা দিলো কাভার্ডভ্যান, মোটরসাইকেলচালক নিহত
ধাক্কা মেরে ফেলে চাপা দিলো কাভার্ডভ্যান, মোটরসাইকেলচালক নিহত
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ