X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি কি বেকারদের নিয়ে ভাববে?

কাবিল সাদি
০৭ ডিসেম্বর ২০২০, ১৮:২৫আপডেট : ০৭ ডিসেম্বর ২০২০, ১৮:২৭

কাবিল সাদি ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ থেকে বিশ্বের মানচিত্রে যে দেশটি অর্থনৈতিক ক্রমাগত উন্নয়নে রোল মডেলের পতাকা উড়াচ্ছে সেই দেশটি বাংলাদেশ। নানা প্রতিবন্ধকতার দেয়াল টপকে নানা খাতে ছাপ রেখেছে উন্নয়নের। করোনার মতো এই বৈশ্বিক মহামারিতে অন্যান্য উন্নত দেশ যেখানে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সেখানে নিজ দেশে সর্বোচ্চ রেকর্ড গড়েছে। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার মতো এই ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে অর্থনীতির চাকাকে সচল ও অর্থনীতিকে স্বাভাবিক রাখতে ভূমিকা রেখেছে নানা সেবা খাত। এসব সেবা খাতে অন্যতম ভূমিকা ছিল ব্যাংক খাত। শুধু এখানেই ব্যাংক খাত থেমে নেই বরং গত এক দশকে যে পরিমাণ বেকারের কর্মসংস্থান হয়েছে তার সিংহভাগ অবদান রেখেছে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো।
শিক্ষার হার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এদেশে বৃদ্ধি পেয়েছে বেকারত্বের হার। আগের তুলনায় চাকরির বাজারে বেড়েছে তীব্র প্রতিযোগিতা। বেকারত্বের এই হার কামানো ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থান তৈরি করে দিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে সরকারি  ও বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংকের নিয়মিত নিয়োগ প্রক্রিয়া। তবে একটা সময় স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও ব্যাংক ভেদে নিয়োগ প্রক্রিয়া আলাদা থাকায় বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকগুলো তাদের আলাদা আলাদা নিয়োগ প্রক্রিয়া গ্রহণ করায় একদিকে যেমন নিয়োগ প্রক্রিয়া দীর্ঘস্থায়ী হতো অন্যদিকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের প্রভাবশালী অসৎ কর্তাব্যক্তিদের হস্তক্ষেপসহ নানা অনিয়ম চোখে পড়া ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তাই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাট রোধে সৎ যোগ্য, মেধাবী কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে এ ধরনের একটি কমিটি গঠন করার দাবি জানিয়ে আসছিলেন ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহী ও সৎ কর্মকর্তারা।

সেই দাবির যৌক্তিকতা বিবেচনায় নিয়ে কর্মঠ, মেধাবী ও উপযুক্ত ব্যাংক কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে ২০১৫ সালে সরকার এক অভিনব নিয়োগ কমিটি গঠন করে যা ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি তথা বিএসসি নামে সুপরিচিত। ইতোমধ্যে এই কমিটির নিয়োগ প্রক্রিয়া ও স্বচ্ছতা সকলের প্রশংসা যেমন কুড়িয়েছে একই সঙ্গে বহু বেকারের মুখে সাফল্যের হাসি এনে দিয়েছে। সেই সঙ্গে ব্যাংকগুলো পেয়েছে দক্ষ, মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তা। তাই এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, ব্যাংকার সিলেকশন কমিটি তথা বিএসসির এই কার্যক্রম শুধু প্রশংসার দাবিদারই নয় বরং অন্যান্য চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতারও উদাহরণ ও পথপ্রদর্শকও বটে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর বেকার বান্ধব ড. আতিউর রহমান বেকারদের কথা চিন্তা করে বিনা ফি-তে আবেদন প্রক্রিয়া চালু করেন, এ সিদ্ধান্ত ছিল ‘মেঘ না চাইতেই জলে’র মতো বেকারদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। শুধু তাই-ই নয় বরং একবার সিভি তথা বায়োডাটা বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে উপস্থাপন করলে ওই প্রার্থীকে আর আলাদা সিভি বা বায়োডাটা দিয়ে নতুন সার্কুলারে আবেদন করতে হয় না বরং ক্ষেত্র বিশেষ আপডেট করে নেওয়ারও সুযোগ রয়েছে। শুধু সিভি আইডি ও নির্ধারিত পাসওয়ার্ড দিয়েই খুব সহজেই দু/তিন মিনিট ব্যয় করে স্মার্টফোনের মাধ্যমেই আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। এতে করে চাকরির প্রার্থীদের একদিকে সময় ও অর্থ সাশ্রয় হয়েছে অন্যদিকে কাগজপত্র প্রেরণের মতো সনাতন পদ্ধতির হয়রানি ও ভোগান্তি থেকে মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু এদেশে কোনও কিছুই ভালোভাবে নেওয়ার মতো মানসিকতা এখনও আমাদের মাঝে গড়ে উঠেনি। ফলে ব্যাংক আবেদন ফ্রি থাকায় পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও শুধু পদ্ধতিগত সুবিধে হওয়ায় বহু প্রার্থী এক মিনিট বা এক চাপে আবেদন করলেও পরীক্ষা দিতেন না। বিএসসি কর্তৃক আবেদনকৃত প্রার্থীদের জন্য বেশি কেন্দ্র ও ব্যবস্থাপনায় অর্থ ব্যয় করলেও অনপুস্থিতির হার কোনও কোনও ক্ষেত্রে অর্ধেকে নেমে আসে। তাই আর্থিক অপচয় ও সময় সংক্ষেপের নিমিত্তে প্রবেশপত্র উত্তোলনের সময় সীমিত করা হলো যেন প্রয়োজনীয় ও পরীক্ষা দিতে ইচ্ছুক প্রার্থীরাই প্রবেশপত্র উত্তোলন করে এবং বিএসসিও নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঠিক ব্যবস্থাপনা নিতে পারে কিন্তু তারপরেও অনপুস্থিতির হার কমাতে এই প্রক্রিয়া ততোটা সফল হয়নি। তাই আবেদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয় আগের প্রক্রিয়ার মতো ফি নির্ধারণ এবং প্রত্যেক বিজ্ঞপ্তির আওতায় দুইশত টাকা ফি প্রযোজ্য হয়। অন্যান্য চাকরির আবেদন প্রক্রিয়ার ফী হিসেবের তুলনায় এই টাকা সহনীয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না, তাছাড়া সমন্বিত পরীক্ষাতেও একই ফি প্রযোজ্য। এই প্রক্রিয়া অবলম্বনে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে শুধু পরীক্ষা দিতে ইচ্ছুক প্রার্থীই ফি দিয়ে আবেদন করছেন এ ক্ষেত্রে বিএসসি সফলতার পরিচয় দিলেও কিছু ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে নতুন বিড়ম্বনা। আবেদন প্রক্রিয়ায় নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে পেমেন্ট ভেরিফিকেশন ও নির্ধারিত ও সংক্ষিপ্ত সময়ে প্রবেশপত্র উত্তোলন, যে তথ্য শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত নোটিশ/বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানা সম্ভব। অন্যান্য চাকরির ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি ছাড়াও যেখানে মোবাইলে এসএসএসের মাধ্যমে প্রার্থীকে জানিয়ে দেওয়া হয় প্রার্থীর ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড সহ পরীক্ষার তারিখ এবং প্রবেশ পত্র উত্তোলনের নানা তথ্য এমন কি প্রবেশপত্র উত্তোলনের সময় পরীক্ষার দিন পর্যন্তও রাখা হয়, সেখানে ফি নেওয়া সত্ত্বেও এই তথ্য থেকে বঞ্চিত হন বিএসসিতে আবেদন করা প্রার্থীরা। ফলে অনেকেই টাকা তথা ফি দেওয়া সত্ত্বেও শুধু ওয়েবসাইট বা ফেসবুকের মাধ্যমে তথ্য জানতে না পারায় মহামূল্যবান জীবিকার এই চাকরির পরীক্ষা দেওয়া থেকে বঞ্চিত হন ভালো প্রস্তুতি ও ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও।

সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এবং বাস্তবতার নিরিখে যখন টাকা দিয়ে আবেদন হচ্ছে তখন দুয়েকজন ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশই পরীক্ষা দেওয়ার মানসিকতা নিয়েই টাকা দিয়ে আবেদন করছে। কিন্তু সেখানে আগের মতোই প্রবেশপত্র উত্তোলনের সময় সীমিত করে দেওয়া কতটা যৌক্তিক? তাছাড়া এই ফি পাওয়া সত্ত্বেও কেন অন্যান্য চাকরির মতো সামান্য অর্থ খরচ করে এসএমএস দিয়ে প্রার্থীকে প্রবেশপত্র উত্তোলনের সময় বা পরীক্ষার তারিখ জানানো হবে না। কেউ যদি ইন্টারনেট এক্সেসে না থাকে তাহলে কি সে পরীক্ষা দেওয়ার অধিকার রাখবে না?

বরং এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ওই প্রার্থী তথ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যদিও বিজ্ঞপ্তিতে ওয়েবসাইটে দেখার কথা উল্লেখ থাকে কিন্তু এটা অন্যান্য চাকরির ক্ষেত্রেও দেখা যায় তারপরেও তারা এসএমএসের মাধ্যমে জানিয়ে থাকে এমনকি বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন বিপিএসসিও এই পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে। সম্প্রতি ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি ঘোষিত ‘নয় ব্যাংকের ব্যাংক অফিসার’ এবং ‘সাত ব্যাংক সিনিয়র অফিসার’ পদের সমন্বিত নিয়োগের প্রক্রিয়ায় অনেকেই স্বল্পকালীন সময়ে প্রবেশপত্র উত্তোনে ব্যর্থ হলে এই বিষয়ে নানা অভিযোগ দেখা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের ‘চাকরির প্রস্তুতি ও পড়াশোনা’ বিষয়ক নানা অনলাইন গ্রুপে। তারা তুলে ধরছেন এই পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে বঞ্চিত হতে যাচ্ছে ফি দিয়ে আবেদন সম্পন্ন করা প্রার্থীদের একটি বড় অংশ। ফলে অনেক প্রার্থীকে ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির কাছে নানাভাবে অনুরোধ করে আসছেন যেন তাদের এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত না করা হয়, বিশেষ করে করোনা বিস্তার মোকাবিলায় ‘সাত ব্যাংক সিনিয়র অফিসার’ পরীক্ষার তারিখ নির্ধারিত ৫ ডিসেম্বর স্থগিত হওয়ায় এই দাবি আরও জোরালো হচ্ছে যেন নতুন তারিখ দেওয়ার আগেই আবার প্রবেশপত্র উত্তোলনের সুযোগ দেওয়া হয়, বিশেষ করে এই করোনাকালে অনেকেই গ্রামে থেকে সমহারে শহরের মতো নেটওয়ার্ক এক্সেসে না থাকায় বা কারও মাধ্যমে জানতে না পারার ফলে সাময়িক সময়ে ভেরিফিকেশন এবং প্রবেশপত্র উত্তোলনে ব্যর্থ হয়েছেন অথচ হতে পারে এটাই তার জীবনের শেষ চাকরির পরীক্ষার সুযোগ ও প্রস্তুতিও কিন্তু এই পদ্ধতিগত কারণে তাকেই হয়তো দেওয়া হচ্ছে সারাজীবনের মাশুল, এটা কাম্য নয়। তাই বঞ্চিতদের পুনরায় পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি চলমান ও ভবিষ্যতে অপেক্ষমাণ বিএসসি কর্তৃক চাকরির পরীক্ষাতেও যেন এই ধরনের বিড়ম্বনায় না পড়তে হয় সে জন্য বিএসসিসহ সংশ্লিষ্টদের এখনই ভাবতে হবে। আর এটা বাস্তবায়িত হলে বেকারবান্ধব এই সংস্থার প্রতি চাকরি প্রার্থীদের ভালোবাসা ও আস্থা যেমন বাড়বে অন্যদিকে বিএসসির মাধ্যমে সরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পাবে যোগ্য, দক্ষ ও স্বচ্ছ কর্মকর্তা।

লেখক: ব্যাংক কর্মকর্তা।

 

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ