X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

বুদ্ধিজীবীদের নৃশংসভাবে হত্যা ও উত্তরাধিকারের সংকট

মো. জাকির হোসেন
১৪ ডিসেম্বর ২০২০, ১৩:৩৮আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২০, ১৪:২২

মো. জাকির হোসেন কী ভয়ংকর নৃশংসতা! মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির চূড়ান্ত বিজয়ের প্রাক্কালে, পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসরদের পরাজয় স্বীকারের মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে, বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের ঠান্ডা মাথায় নজিরবিহীন নৃশংসতার সঙ্গে হত্যা করা হয়। হত্যার পর ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত শবদেহগুলো বুড়িগঙ্গা নদীতীরের পরিত্যক্ত ইটের ভাটায় গাদাগাদি করে ফেলে রাখা হয়। ’৭১-এর ২৫ মার্চের রাত থেকেই শুরু হয় বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ। তবে ১৪ ডিসেম্বর সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে বেছে বেছে ঘর থেকে তুলে নিয়ে একত্রে হত্যা করা হয়। তিন দিন খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকা ক্ষত-বিক্ষত অনেক লাশ শনাক্ত করা যায়নি। অনেকের লাশের কোনও সন্ধানই মেলেনি। হয়তো বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শবদেহ ফেলা হয়েছে অজানা কোনও গর্তে, যা অনাবিষ্কৃতই রয়ে গেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মীর আবদুল কাইয়ুমকে পদ্মা নদীর তীরে গর্ত খুঁড়ে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়। ঢাকার মিরপুরে কবি মেহেরুন্নেসার মাথা কেটে তারই লম্বা চুল দিয়ে ফ্যানের সিলিংয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়। ঠাকুরগাঁওয়ে বহু বুদ্ধিজীবীকে জীবন্ত অবস্থায় বাঘের খাঁচায় ফেলে দেওয়া হয়েছিল। মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বরের অদূরে জল্লাদখানা নামক বধ্যভূমিতে বাঙালিদের জবাই করে একটা কুয়োয় ফেলে দেওয়া হতো, ওখানেই ইত্তেফাকের সাংবাদিক আবু তালেবকে জবাই করে হত্যা করা হয়। মাগুরায় লুৎফুননাহার হেলেন নামে এক স্কুল শিক্ষয়িত্রীকে জিপের পেছনে বেঁধে সারা শহর ঘুরিয়ে বোঝানো হয়েছিল স্বাধীনতা চাওয়ার ফল কী? সৈয়দপুরে ডা. শামশাদ আলী নামে একজন চিকিৎসককে ট্রেনের জ্বলন্ত কয়লার ইঞ্জিনের মধ্যে ছুড়ে ফেলে হত্যা করা হলো। সে সময় সৈয়দপুর ছাড়াও পার্বতীপুর, পাকশী, ঈশ্বরদী, পাহাড়তলী ইত্যাদি বড় রেলওয়ে জংশনে ইঞ্জিন জ্বালিয়েই রাখা হতো, কেবল ভেতরে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার অপেক্ষায়। মহান ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রাণপুরুষ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে ২৯ মার্চ কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গিয়ে এমন অত্যাচার করা হয় যে তাকে হামাগুড়ি দিয়ে টয়লেটে যেতে হতো; সারা শরীরে ছিল বীভৎস অত্যাচারের ক্ষতচিহ্ন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সঠিক মৃত্যুতারিখ জানা যায়নি, তার মরদেহও পাওয়া যায়নি। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ সম্ভব হয়নি। ১৯৭২ সালে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’-এ ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরের শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা উল্লেখ করা হয় এক হাজার ৭০ জন। আর বাংলা পিডিয়ায় এ সংখ্যা দেখানো হয়েছে এক হাজার একশত এগারো জন। এদের মধ্যে ছিলেন ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী, ৯ জন সাহিত্যিক ও শিল্পী, ৫ জন প্রকৌশলী এবং অন্যান্য ২ জন। অতি সম্প্রতি সরকার প্রাথমিকভাবে এক হাজার ২২২ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা অনুমোদন করেছে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নে গঠিত কমিটির প্রথম সভায় এ তালিকা অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু দেশব্যাপী এ সংখ্যা যে আরও বেশি তা বলাই বাহুল্য। স্বাধীনতার পর যে ‘বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশন’ গঠিত হয়েছিল ওই কমিশনের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পাকিস্তানি মেজর রাও ফরমান আলী শুধু ডিসেম্বরেই ২০ হাজার বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন।

কারা বুদ্ধিজীবীদের হত্যার সঙ্গে জড়িত?

বুদ্ধিজীবীদের যখন বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় তখন এই ঘাতকদের দেখেছেন শহীদ পরিবারের সদস্যরা। মুখ কাপড় দিয়ে আবৃত থাকলেও কারও কারও মুখের কাপড় সরে গিয়েছিল, পরে ছবি দেখে তাদের শনাক্ত করা হয়। এ নৃশংস হত্যার সঙ্গে জড়িত দু’জনের পরিচয় অচিরেই জানা গেলো। এরা হলেন আলবদর বাহিনীর চৌধুরী মঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খান। বিজয়লাভের পর গভর্নর হাউজ থেকে উদ্ধারকৃত মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর ডেস্ক ডায়েরিতে অনেক বুদ্ধিজীবীর নাম পাওয়া যায়। কারও নামের পাশে আছে ক্রসচিহ্ন, কোথাও বা লেখা বাড়ির নম্বর, অথবা কোনও মন্তব্য। নোটশিটের এক জায়গায় লেখা ছিল, ক্যাপ্টেন তাহির ব্যবস্থা করবে আলবদরদের গাড়ির। তার ডায়রিতে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের যে তালিকা পাওয়া যায় তাদের অধিকাংশই ১৪ ডিসেম্বর নিহত হন। রাও ফরমান আলীর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পাকিস্তানি বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন‌্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজির নির্দেশনায় এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে ব্রিগেডিয়ার বশির, লেফটেন‌্যান্ট কর্নেল হেজাজি, মেজর জহুর, মেজর আসলাম, ক্যাপটেন নাসির ও ক্যাপটেন কাইউম। আর তাদের সার্বিক সহযোগিতা করে এদেশীয় দোসর আল বদর, আল শামস ও ছাত্রসংঘের কর্মীরা। পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্যতম বর্বর ও নারকীয় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে তারা। বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী মানুষ এ হত্যাকাণ্ডের সংবাদে পুনরায় স্তম্ভিত হয়ে যায়।

বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করার তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছিল, তালিকা অনুযায়ী কাজ সম্পন্ন করার জন্য গাড়িও ছিল প্রস্তুত। তালিকা নিয়ে গাড়ির সওয়ারি হয়ে বাড়ি বাড়ি যারা যাবে, সেই বাঙালি ঘাতকেরাও ছিল তৈরি। রাও ফরমান আলী তার How Pakistan Got Divided গ্রন্থে লিখেছেন, ‘১০ ডিসেম্বর সূর্যাস্তের সময় ঢাকার কমান্ডার মেজর জেনারেল জামশেদ আমাকে পিলখানায় তার দফতরে আসতে বলেন। তার কম্যান্ড পোস্টের কাছাকাছি এসে আমি অনেক গাড়ি দেখতে পাই। বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে এসে তিনি আমাকে গাড়িতে উঠতে বলেন, কয়েক মিনিট পর আমি জানতে চাই, এই গাড়িগুলো কেন আনা হয়েছে? তিনি বললেন, “নিয়াজির সঙ্গে সেটা নিয়েই কথা বলতে চাই।” ক্যান্টনমেন্টের হেডকোয়ার্টারের দিকে যেতে যেতে তিনি জানালেন, বিপুলসংখ্যক বুদ্ধিজীবী ও অগ্রণী ব্যক্তিদের গ্রেফতার করার আদেশ তিনি পেয়েছেন। আমি তাকে বলি, কেন, কী কারণে? গ্রেফতার করার সময় তো এটা নয়।’ ফরমান আলীর এ বয়ান নিশ্চিত করে বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করার তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছিল, তালিকা অনুযায়ী কাজ সম্পন্ন করার জন্য গাড়িও ছিল প্রস্তুত। তথ্য-প্রমাণ বলছে বুদ্ধিজীবী হত্যায় বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি তাদের এ দেশীয় দোসর জামায়াতে ইসলামী, ফরমান আলীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে গঠিত বিশেষ কিলিং স্কোয়াড আলবদর বাহিনী, আলশামস ও রাজাকার বাহিনী জড়িত ছিল। স্বভাবতই কেউ প্রশ্ন করতে পারেন এসব সংগঠনের নাম জড়িত করা কি আমার অনুমান নির্ভর বা পক্ষপাতমূলক? উত্তর, অবশ্যই না। অসংখ্য সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে এসব ঘাতক সংগঠনের বিরুদ্ধে। ’৭১-এর গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকে ধর্মের নামে বৈধতা দেওয়ার জন্য জামায়াতের শীর্ষ নেতারা বলেছেন, এরা ‘দুষ্কৃতকারী’, ‘ভারতের দালাল’, ‘পাকিস্তানবিরোধী’, ‘ইসলামের দুশমন’ ইত্যাদি। ঢাকার মার্কিন কনসাল হার্বার্ট ডি স্পিভাক ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে পাঠানো একটি তারবার্তায় উল্লেখ করেছেন, বুদ্ধিজীবী হত্যায় ‘জামায়াত থাগস’রা (জামায়াতি দুর্বৃত্তরা) জড়িত। ওই তারবার্তায় স্পিভাক লিখেছেন, ‘নিহত বুদ্ধিজীবীরা সংখ্যায় কত তা নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে, কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি, এটা ‘জামায়াত থাগস’রা ঘটিয়েছে।’ হার্বার্ট স্পিভাক ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর এক তারবার্তায় ওয়াশিংটনকে অবহিত করেন, ঢাকার পশ্চিম পাশে ইটখোলাসংলগ্ন পতিত একটি মাঠের গর্তে ৩০টি গলিত মরদেহের সন্ধান মিলেছে। বিশ্বাস করা হয় যে পশ্চিম পাকিস্তানি আর্মির স্থায়ীভাবে নিয়োগ করা সমর্থক ও রাজাকারদের আত্মসমর্পণের শর্তাবলি যাতে তাদের অনুকূল হয়, সেজন্য প্রায় ৩০০ বুদ্ধিজীবীকে গ্রেফতার করেছিল ‘হোস্টেজ’ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। ওই লাশগুলো গ্রেফতারকৃত বুদ্ধিজীবীদেরই হবে। নারী প্রফেসর এবং কতিপয় মেডিক‌্যাল স্পেশালিস্টকে আত্মসমর্পণের মাত্র দুই দিন আগে হত্যা করা হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, ইটভাটার কাছে অনেককেই হত্যা করে গর্তে নিক্ষেপ করা হয়।’ Professor Christian Gerlach কেমব্রিজ থেকে প্রকাশিত তার বই Extremely Violent Societies: Mass Violence in the Twentieth-Century World-এ উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যায় আলবদর জড়িত। তিনি যদিও মনে করেন পাকিস্তানি আর্মি বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের সিস্টেমেটিক এক্সটারমিনেশন বা পদ্ধতিগত বিনাশ ঘটায়নি। কিন্তু তিনিও তার বইয়ের ১৩৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘একাত্তরের ডিসেম্বরে ঢাকা, খুলনা, সিলেট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২৮০ জন পর্যন্ত জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী এবং সিভিল সার্ভেন্টদের অপহরণ ও হত্যাকাণ্ড পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় যারা ঘটিয়েছে, তারা হলো প্যারা মিলিটারি আলবদর।’   Encyclopedia of Terrorism (Facts on File Library of World History) গ্রন্থের রচয়িতা Cindy C. Combs ও  Martin W. Slann বুদ্ধজীবী হত্যায় আলবদর বহিনীর সংশ্লেষের কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘১০ হাজার বাঙালি বুদ্ধিজীবীকে হত্যার সঙ্গে আলবদরের সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে।’ বাংলাপিডিয়াতে উল্লেখ আছে, ‘…আলবদর ছিল আক্ষরিক অর্থেই ডেথ স্কোয়াড। তারা সরাসরি মাঠে ময়দানে গিয়ে লড়েনি, বরং পরিকল্পনা অনুযায়ী টার্গেট কিলিংই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে তারাই ছিল সবচেয়ে বেশি তৎপর এবং এদের সাহায্যেই পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি করেছে, তারাই এসে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছে এবং পরিশেষে হত্যা করেছে।’ বুদ্ধিজীবী হত্যায় আলবদরের সম্পৃক্ততার আরও প্রমাণ মেলে বুদ্ধিজীবীদের কাছে তাদেরই পাঠানো হুমকিসম্বলিত চিঠিতে। আলবদর বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যার কিছুদিন আগ থেকেই ঢাকার বুদ্ধিজীবীদের কাছে হুঁশিয়ারিমূলক বিভিন্ন চিঠি পাঠাতে শুরু করে। চিঠির বক্তব্য ছিল এরকম—

‘শয়তান নির্মূল অভিযান

ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুদের যে সব পা চাটা কুকুর আর ভারতীয় ইন্দিরাবাদের দালাল নানা ছুতানাতায় মুসলমানদের বৃহত্তর আবাসভূমি পাকিস্তানকে ধ্বংস করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে তুমি তাদের অন্যতম। তোমার মনোভাব, চালচলন ও কাজকর্ম কোনোটাই আমাদের অজানা নেই। অবিলম্বে হুঁশিয়ার হও, এবং ভারতের পদলেহন থেকে বিরত হও, না হয় তোমার নিস্তার নেই। এই চিঠি পাওয়ার সাথে সাথে নির্মূল হওয়ার জন্য প্রস্তুত হও।—যমদূত’

বুদ্ধিজীবী হত্যায় পকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের পাশাপাশি দুজন মার্কিন নাগরিকের নামও উচ্চারিত হয়। এ দুজন হলেন—হেইট ও ডুসপিক। হেইট মার্কিন সেনাবাহিনীতে চাকরি করতো এবং পরবর্তীতে সামরিক গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করে। অন্যদিকে ডুসপিক ছিল সিআইএ’-র এজেন্ট। এই দুজন রাও ফরমান আলীর সঙ্গে মিলে প্রায় তিন হাজার বুদ্ধিজীবীর একটা তালিকা তৈরি করে বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া বুদ্ধিজীবীদের হত্যার কাজে বিদেশি মুখোশ, ছদ্ম পোশাক ও ছোরা ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। মার্কিন নাগরিকদের সম্পৃক্ততার বিষয়ে অভিযোগ হলো যেসব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছিল তাদের অধিকাংশই সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। আমেরিকার কামনা ছিল, যেহেতু বাংলাদেশের জন্ম আটকানো সম্ভব হচ্ছে না, সেহেতু নতুন এই রাষ্ট্র যেন সমাজতন্ত্রের দিকে হাঁটতে না পারে সেটা নিশ্চিত করা। পাকিস্তান ও আমেরিকা উভয়ের ক্রোধ ছিল বুদ্ধিজীবীদের ওপর। ফলস্বরূপ দুই দলই চেয়েছে এই হত্যাকাণ্ড এবং এতে সহকারী এবং কার্যসম্পাদনকারী হিসেবে পেয়েছিল স্থানীয় দালালদেরকে। 

বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যায় বাংলাদেশবিরোধী পাকিস্তানপন্থী বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকাও প্রণিধানযোগ্য। রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হত্যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. আব্দুল বারী প্রত্যক্ষ প্ররোচনা ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আহমদ হোসেন গ্রন্থাগারের সামনে জনসম্মুখেই বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী যদি বাঙালি নারীদের শ্লীলতাহানি করে তবে তাদের কোনও পাপ হবে না, কারণ তারা ইসলাম রক্ষার জন্য জিহাদে নিয়োজিত। তাদের জন্য এই কাজ ‘মুতা’ বিবাহের পর্যায়ে পড়ে।’ পাকিস্তানপন্থী বুদ্ধিজীবীদের কারও কারও সঙ্গে রাও ফরমান আলির সরাসরি যোগাযোগ ছিল এবং রাওয়ের নির্দেশে অনেকেই কাজ করতেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বুদ্ধিজীবীদের নামের তালিকা প্রণয়নেও সাহায্য করতেন তারা।

কেন বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হলো?

বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পেছনে ব্যক্তিগত শত্রুতা কিংবা কোনও সামরিক কার্যকারণ ছিল না। তারপরও তাদের প্রতি কী ভয়ংকর আক্রোশ ছিল। তার প্রমাণ মেলে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের পৈশাচিক পন্থায় নির্যাতন করে হত্যা করেছিল। অজস্র লাশের দেহের বিভিন্ন স্থানে নরপিশাচদের নির্মম আঘাতের ক্ষতবিক্ষত চিহ্ন দেখে আত্মীয়-স্বজনেরা বিমর্ষ হয়ে পড়েছিল। চোখ-মুখ বাধা অজস্র লাশের কোনও কোনোটি শনাক্ত করা সম্ভব হলেও অসংখ্য লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। কোনও কোনও লাশ ছিল জবাই করা! লাশের এসব বীভৎস ছবি দেখে অনুমান করতে কষ্ট হয়নি যে, পাকিস্তানি হানাদার আর তাদের এদেশীয় দোসরদের কী ভয়ংকর ক্রোধ ছিল বাংলার এসব সূর্য সন্তানদের প্রতি। অনেকেই মনে করেন পাকিস্তানি হানাদার আর তাদের দোসররা হেরে যাওয়ার ক্ষোভ, দুঃখ, হতাশা থেকে এমন নৃশংস প্রতিশোধ নিয়েছে। এটি পুরোপুরি সঠিক নয়। বুদ্ধিজীবীরা কি শুধু ডিসেম্বরেই নিহত হয়েছেন? তা নয়। ২৫ মার্চ থেকে ৭২-এ জহির রায়হানের অন্তর্ধান/মৃত্যু পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে। ৭ জুন ১৯৭১, নিউইয়র্ক টাইমস-এ Anthony Lewis লিখেছেন, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী হত্যাযজ্ঞের নির্দিষ্ট টার্গেট হলো বুদ্ধিজীবী এবং সমাজের জনমত গঠনকারী অংশ– চিকিত্সক, অধ্যাপক, ছাত্র ও লেখক’।

প্রখ্যাত প্রাচ্যবিদ Edward W. Said তার Representations of the Intellectual (THE 1993 REITH LECTURES) গ্রন্থে বলেছেন, “There has been no major revolution in modern history without intellectuals; conversely there has been no major counterrevolutionary movement without intellectuals. Intellectuals have been the fathers and mothers of movements, and of course sons and daughters, even nephews and nieces.” সারকথা হলো বুদ্ধিজীবীরা হলেন বিপ্লবের প্রাণভোমরা। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নের সারথি ছিলেন আমাদের বুদ্ধিজীবীরা। রাজনৈতিক ফ্রন্টের আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বাঙালিবোধকে তীব্র ও সংহত করে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এই বুদ্ধিজীবীরা। একেকটা গান কবিতা বারুদের মতো বাঙালিকে উদ্বুদ্ধ করেছে, প্রেরণা দিয়েছে, সাহস জুগিয়েছে স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নে। পাকিস্তানি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের শিকল থেকে বের হয়ে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন বুদ্ধিজীবীরা। উর্দু-ফারসি-আরবি শব্দ মিলিয়ে বাংলা ভাষাকে মুসলমানি চেহারা দেওয়ার চেষ্টার বিরুদ্ধে ও আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রচলনের চেষ্টার বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন সরব। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান—এই দুই অঞ্চলের সংহতি বৃদ্ধির অজুহাতে রোমান হরফে বাংলা লেখার ভাষা-সংস্কারের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তীব্র প্রতিবাদ জানান। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানিরা আক্রমণ শুরু করলে অনেক বুদ্ধিজীবী দেশ ছেড়ে কলকাতায় আশ্রয় নেন ও বিভিন্ন উপায়ে মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেন—কণ্ঠ সৈনিক, কলম সৈনিক হিসেবে দেশে-বিদেশে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠন করা, মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করা এবং মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সরকারের কার্যাবলি পরিচালনার কাজে অংশ নেন। কেউ কেউ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন। অনেকেই আবার কর্মস্থলে থেকে যান। এখন অনেকেই প্রশ্ন করেন এই বুদ্ধিজীবীরা কেন এমতাবস্থায় পড়ে রইলেন কর্মস্থলে? কেন তারা দেশে ছেড়ে চলে গেলেন না? দেশ ছেড়ে চলে গেলে তো আর মরতে হতো না। এসব নির্বোধদের বিতর্কের জবাব শহীদ বুদ্ধিজীবীরা একাত্তরেই দিয়ে গিয়েছেন। যেমন, জহির রায়হান যখন চলে যান দেশ ছেড়ে তখন শহীদুল্লাহ কায়সার বলেছিলেন, ‘ও সীমান্তে থাকবে। সেখানে ওর প্রকৃত কাজ আছে। আমার কাজ এখানে।’ তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সব মানুষ কি ওপারে যেতে পারবে? পারবে না। যারা যেতে পারবে না, তারা প্রতিদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকবে। আতঙ্কে রাত কাটাবে, বিনিদ্র রাত যাপন করবে। তাদের সে যন্ত্রণার কথা লিখব আমি।’ সিলেট মেডিক‌্যাল কলেজের প্রধান শল্য চিকিৎসক শহীদ অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দিন আহমদ বলেছিলেন, ‘আমরা ডাক্তার। রোগী ফেলে, আহত মানুষ ফেলে আমরা তো কোথাও যেতে পারি না’। ডা. আলীম চৌধুরী, ডা. ফজলে রাব্বীরা বিদেশের মাটিতে আশ্রয় না নিয়ে দেশে নিজেদের কর্মস্থলে থেকে যান। তারা গোপনে একটা হাসপাতাল করে সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করতেন। দেশে থেকে যাওয়া বুদ্ধিজীবীরা গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে অর্থ সংগ্রহ করেছেন, গেরিলাদের আশ্রয়দান করেছেন, সেবা শুশ্রূষা করেছেন, লুকিয়ে ওষুধপত্র বিতরণ করেছেন ও তথ্য সরবরাহ করেছেন। অধ্যাপক গিয়াসউদ্দীন আহমেদ প্রত্যক্ষভাবেই জড়িত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। প্রাণের মায়া ত্যাগ করে সর্বাত্মক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে। আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিতজনদের কাছ থেকে গোপনে অর্থ, বস্ত্র, খাদ্য জোগাড় করে পৌঁছে দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। তার কাজের উল্লেখ পাওয়া যায় কবি সুফিয়া কামালের মন্তব্যে, ‘ভুলবো কি করে গিয়াসউদ্দীনের কথা? মাথায় গামছা বেঁধে লুঙ্গি পরে গিয়াস প্রায়ই রাতে চুপিসারে পেছনের পথ দিয়ে দেয়াল টপকে আসতো রিকশাওয়ালা সেজে। চাল নিয়ে যেতো বস্তায় করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে। প্রতিবেশী অনেকেই ঢাকা ছেড়ে যাবার আগে আমার কাছে রেশন কার্ড রেখে গিয়েছিলেন। সেই কার্ডে আমি চাল চিনি উঠিয়ে রাখতাম। সেগুলো গিয়াস নিয়ে যেতো। গিয়াসের ওপর পাক সেনা রাজাকারদের চোখ ছিল অতন্দ্র। ১৪ ডিসেম্বর ওকেও রাজাকাররা হত্যা করেছে।’ বাঙালি জাতির মানসগঠনকে শহীদ বুদ্ধিজীবীরা পুষ্ট করেছেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক উদ্যোগের পরিপূরক হিসেবে বুদ্ধিজীবীরা শিক্ষা, সাহিত্য, সংগীত, নাটক, চিত্রকলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাঙালির মননে স্বাধীনতার পক্ষে ‘রেনেসাঁ ঘটিয়েছেন’।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের উত্তরাধিকারের সংকট

বুদ্ধিজীবীরা জাতির বিবেক হিসেবে বিবেচিত। একটি জাতিকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য, রাষ্ট্রের টেকসই উন্নয়ন, গণতন্ত্র ও প্রগতির জন‌্য শক্তিশালী ও স্বাধীন বুদ্ধিজীবী শ্রেণি থাকা আবশ্যক। ইতিহাসের ধারায় তাই বিক্রমাদিত্য ও আকবরের ‘নবরত্ন সভা’ সহ বিভিন্ন রাজা-সম্রাটের রাজসভায়ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণির উপস্থিতি লক্ষ করি। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে বুদ্ধিজীবীদের কথা আমরা জানি, তাদের যে আত্মত্যাগ, সাহস, সততা ও দেশপ্রেমের কথা জানি, সেই মানের ও চিন্তার বুদ্ধিজীবী ক্রমশই বিরল হয়ে পড়ছেন। ব্যক্তি আকাঙ্ক্ষা, পদ-পদবির লোভ দেশের চেয়ে বড় হয়ে উঠছে স্বাধীনতা-উত্তর বুদ্ধিজীবীদের কাছে। বিপদে পড়ার চিন্তা, সুযোগ সুবিধা হারানোর ভয় ভয়ংকরভাবে আপসকামী করে তুলেছে এ শ্রেণিকে। শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মীর আব্দুল কাইয়ুমের কন্যা  ড. মাহবুবা কানিজ কেয়া এ প্রসঙ্গে দৈনিক সমকালে প্রকাশিত তাঁর এক কলামে উল্লেখ করেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা প্রণয়নকারীদের স্বাধীনতার পর বরখাস্ত করা হয়। তাদের জেলে নেওয়া হয়। পরে তারা জেল থেকে বেরিয়ে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বিঘ্নে কাজ করেছে, এমনকি তাদের পুরস্কৃত হতেও দেখেছি। তাদের ক্ষমতায় যেতে দেখেছি। নিজের চোখের সামনে তাদের পুনর্বাসিত হতে দেখেছি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরেও আমরা যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি সামাজিক ঘৃণাটা দেখতে পাইনি। যারা নিজেদের প্রগতিশীল বলে দাবি করেন তাদেরও ক্ষমতার কাছে আপস করতে দেখেছি। যা শহীদ বাবার সন্তান হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জার, অনেক কষ্টের, অপমানের, ক্ষোভের।’

বর্তমান বুদ্ধিজীবীদের ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তা বড় হয়ে ওঠার সুযোগে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ঘাতক ও তাদের সংগঠন বেশ শক্তিশালীভাবেই পুনর্বাসিত হয়েছে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগ তাদের উত্তরাধিকারীদের কাছে কেবলই মনভুলানো ‘আমরা তোমাদের ভুলবো না’ শিরোনাম ও ১৪ ডিসেম্বর কেন্দ্রিক আনুষ্ঠানিকতায় সীমিত হয়ে পড়েছে। এ সুযোগে ঘাতক ও তাদের উত্তরাধিকারীরা হামেশাই নতুন নতুন ইস্যুতে সংকট সৃষ্টি করছে রাষ্ট্রে, সমাজে। প্রতিবাদের নামে, সুবিধাবাদী শ্রেণির বুদ্ধিজীবীরা লোক দেখানো মানববন্ধন কিংবা ছবি তোলার ধাক্কাধাক্কি প্রতিযোগিতায় মেতে থাকছেন নতুন কোনও সুযোগ-সুবিধার সন্ধানে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের যোগ্য উত্তরাধিকারিত্বের ধারাবাহিকতায় তাই মারাত্মক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বুদ্ধিজীবীদের এরূপ জনবিমুখ ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক সুযোগসন্ধানী হয়ে ওঠা দেশের জন্য হুমকি বৈ কি।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: [email protected]

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিচ্ছেদের পর প্রতারণার অভিযোগে সাবেক স্ত্রীকে শ্বাসরোধে হত্যা
বিচ্ছেদের পর প্রতারণার অভিযোগে সাবেক স্ত্রীকে শ্বাসরোধে হত্যা
রেমিট্যান্স প্রেরকদের জন্য আরও সুবিধা চায় সংসদীয় কমিটি
রেমিট্যান্স প্রেরকদের জন্য আরও সুবিধা চায় সংসদীয় কমিটি
প্রিমিয়ার ব্যাংকের নতুন এমডি মোহাম্মদ আবু জাফর
প্রিমিয়ার ব্যাংকের নতুন এমডি মোহাম্মদ আবু জাফর
দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার রুশ উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী
দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার রুশ উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ