X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

হাসিনা-মোদি বৈঠক: বাংলাদেশ কতটুকু জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে পেরেছে?

শেখ শাহরিয়ার জামান
১৮ ডিসেম্বর ২০২০, ১১:৫৭আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২০, ১২:০০







শেখ শাহরিয়ার জামান বাংলাদেশ ও ভারত শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠক সবসময় জনমানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। ১৭ ডিসেম্বরের বৈঠকও এর ব্যতিক্রম নয়। বৈঠকের পর সরকারের পক্ষ থেকে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়, যেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বৈঠক সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু এ ধরনের বৈঠকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট হচ্ছে যৌথ বিবৃতি, যেখানে লিখিতভাবে দুই সরকার বিভিন্ন বিষয়ে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করে।



আজকের বৈঠকের পরে ৩৯ ধারা যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে, যেখানে মুক্তিযুদ্ধ, ঐতিহাসিক সম্পর্ক, মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি, বাণিজ্য, কোভিড-১৯ পরিস্থিতি, পানি ও অন্যান্য বিষয়ে সহযোগিতা, কানেক্টিভিটি, রোহিঙ্গাসহ আরও বিষয়ে দুই সরকারের ঐকমত্য ও ভবিষ্যৎ আলোচনার আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছে, যা যেকোনও প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কে বিদ্যমান। এছাড়াও বাংলাদেশের জন্য জরুরি, যেমন- পানি ও সীমান্ত হত্যাসহ প্রতিটি বিষয় হয় মীমাংসায় পৌঁছেছে অথবা আলোচনার পথ খোলা রেখেছে।

পানি বিষয়ে সাংবাদিকদের বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বলেছি তিস্তা ইস্যু তুলে আপনাদের লজ্জিত করতে চাই না। তবে এটি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। একইসঙ্গে আমরা বাকি ছয়টি নদীর কথা জিজ্ঞাসা করেছি। তারা একলাইনে উত্তর দিয়েছেন।’

এই যৌথ বিবৃতি পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের পরিপক্বতা বোঝা যায়।  ভারত বৃহৎ দেশ হলেও বাংলাদেশ তার জাতীয় স্বার্থ অক্ষুণ্ন রাখার জন্য যতটুকু করা সম্ভব তার সবটুকু করেছে এবং ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়গুলো সমাধানের এবং সমাধান না হলে অন্তত ভবিষ্যতে আলোচনার পথ খোলা রাখার ব্যবস্থা করেছে সরকার।

নতুন ইস্যু হিসাবে যে কয়েকটি বিষয় যুক্ত হয়েছে তা বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ করবে এবং অন্তত ভারতের কোনও ক্ষতি হবে না।

নতুন ইস্যু

এবারের নতুন বিষয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিবিআইএন মোটর ভেহিক্যাল চুক্তি সহযোগিতা, তিন দেশের রোড নেটওয়ার্কে যোগদানের জন্য বাংলাদেশের আগ্রহ, ছয় নদীর পানি বিষয়ক কাঠামো চুক্তি করার তাগিদ, নদীর সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত বিষয় এবং কুশিয়ারা নদীর পানি উত্তোলন। এই অঞ্চলে আরও ভালো কানেকটিভিটির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল মোটর ভেহিক্যাল চুক্তি করেছে, কিন্তু এরমধ্যে ভুটান এই চুক্তিতে এখন যোগ দিতে চাইছে না। এ বিষয়ে বাকি তিন দেশের মধ্যে চুক্তি বাস্তবায়নের তাগিদ দেওয়া হয়েছে, যা উভয়পক্ষ সম্মত হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে, যার লাভ বাংলাদেশও পাবে।

ভারত, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড হাইওয়ে প্রকল্পতে যোগ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের আগ্রহের কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। কারণ, এটি বাংলাদেশের জন্য কৌশলগত দিক থেকে জরুরি এবং ভারত এর বিপরীতে পশ্চিমবঙ্গ থেকে মেঘালয়ে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহারের অনুরোধ করেছে। এটি লক্ষণীয় বাংলাদেশের একটি প্রস্তাবের বিপরীতে ভারত আরেকটি প্রস্তাব দিয়েছে অর্থাৎ ‘তুমি আমারটা মানলে আমি তোমারটা মানবো’।

মনু, মুহুরি, খোয়াই, গোমতী, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানিবণ্টন নিয়ে অনেক দিন ধরে আলোচনা চলছে। এবারে শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে যৌথ বিবৃতিতে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে এসেছে এবং উভয় নেতাই এ বিষয়ে দ্রুত সমাধানের ওপর জোর দিয়েছেন। কুশিয়ারা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে কোনও চুক্তি নেই কিন্তু সেচ সুবিধার জন্য বাংলাদেশ এই নদী থেকে পানি উত্তোলন করতে চায় এবং এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি করার জন্য অনেক দিন ধরে আলোচনা করছে। এবারের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে আলোচনায় এই চুক্তির জন্য ভারতকে অনুমতি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়, কিন্তু এ মুহূর্তে ভারত এ বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত না দিয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখতে চায়, যা যৌথ বিবৃতিতে ফুটে উঠেছে। এছাড়া, ইছামতি, কালিন্দি, রাইমঙ্গল ও হারিয়াভাঙা নদীর সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত কোনও স্ট্রিপম্যাপ নেই এবং এটি তৈরি করার জন্য উভয়পক্ষ সম্মত হয়েছে, যৌথ সীমান্ত কনফারেন্সের বৈঠক করার বিষয়ে যা নতুন বিষয় হিসেবে যৌথ বিবৃতিতে এসেছে। নদীর পানিবণ্টন নিয়ে দুই দেশের আলোচনা দীর্ঘদিন ধরে চলছে এবং ভারতও এ বিষয়ে আশ্বাস দিয়ে আসছে সমাধানের, কিন্তু এটি শেষ হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশ বিষয়টি প্রতিটি বৈঠকের এজেন্ডাতে রেখেছে এবং এ বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত ছিল।

ঐকমত্য এবং ভবিষ্যৎ আলোচনা

যৌথ বিবৃতিতে কোনও বিষয় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অর্থ হচ্ছে হয় ওই বিষয়ে তারা একমত হয়েছে অথবা এখন তারা একমত হয়নি, কিন্তু ভবিষ্যতে তারা আলোচনা করে সমাধান করতে চায়।


মুক্তিযুদ্ধ, ঐতিহাসিক সম্পর্ক, মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি নিয়ে দুই সরকারের মধ্যে কোনও মতবিরোধ নেই। একদিকে বাংলাদেশের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে সবাই মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের জন্য অকুণ্ঠচিত্তে প্রশংসা করেন, অন্যদিকে দুই দেশ একসঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন, ডাকটিকিট অবমুক্তকরণ, সম্মাননা প্রদান, রাস্তার নামকরণসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে থাকে। ভারতীয় পরিচালক শ্যাম বেনেগালের পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুর ওপর নির্মিত ছবির কাজ আগামী জানুয়ারিতে শুরু হবে এবং সামনের বছর স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে যৌথভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠানের বিষয়ে দুই পক্ষ একমত হয়েছে। অন্যদিকে কুষ্টিয়ার মুজিবনগর থেকে নদীয়া পর্যন্ত রাস্তার নামকরণ ‘স্বাধীনতা সড়ক’ রাখার প্রস্তাব দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। এ বিষয়ে ভারতের কোনও মন্তব্য নেই এবং এর অর্থ হচ্ছে এটি নিয়ে ভবিষ্যতে তারা আলোচনা করতে চায়।

স্বাস্থ্য খাতে কোভিড-১৯ বিষয়ে সহযোগিতার জন্য উভয়পক্ষ সন্তুষ্টি প্রকাশ করে ভারত জানিয়েছে, ওই দেশে ভ্যাকসিন উৎপাদন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশও তা পাবে। এখানেই তারা থেমে যায়নি, ভ্যাকসিন উৎপাদনে বাংলাদেশকে সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছে তারা, যা আমাদের জন্য লাভজনক। স্বাস্থ্য বিভাগে বেসরকারি খাতের সহযোগিতার বিষয়টিও উভয়পক্ষ বিবেচনায় নিয়েছে।

সীমান্ত ব্যবস্থাপনা

সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার বিষয়ে উভয় নেতা একমত হয়েছেন এবং ত্রিপুরার যে অংশে এখনও কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়নি সেখানে দ্রুততার সঙ্গে কাজ শুরু করার জন্য বলা হয়েছে। সীমান্ত হত্যাকাণ্ড নিয়ে উভয়পক্ষ উদ্বেগ প্রকাশ করে নির্দেশ দিয়েছে এটিকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে। সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার পূর্ণ বাস্তবায়নের ওপর উভয়পক্ষ জোর দিয়ে যৌথ বিবৃতিতে দুই দেশের সীমান্ত বাহিনীর প্রশংসা করা হয়েছে চোরাচালান ও মানবপাচার রোধে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে উভয় দেশের অবস্থান এক এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক সই করার জন্য উভয় দেশের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বেশিরভাগ বাংলাদেশি সড়ক বা রেলপথে ভারত ভ্রমণ করে এবং স্থলসীমান্ত খুলে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ অনুরোধ জানিয়েছে; কিন্তু এ বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্ত জানায়নি।

বাণিজ্য ক্ষেত্রেও সাফটার পূর্ণ সুবিধা বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ যে অশুল্ক বাধার সম্মুখীন হয় সেটির বিষয়ে সরকার আলোচনা করেছে এবং উভয় নেতৃত্ব এটি দূর করার জন্য জোর দিয়েছে। এছাড়া সামগ্রিক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি করার জন্য একটি স্টাডি করার বিষয়ে একমত হয়েছে দুইপক্ষ। বাংলাদেশের পাটের ওপর ভারতীয় শুল্কের বোঝা দূর করার জন্য যে আলোচনা চলছে সেটিতে উভয়পক্ষ সন্তুষ্ট বলে জানিয়েছে।

তিস্তা নদীর পানি চুক্তির বিষয়টি মনে করে দিয়েছে বাংলাদেশ এবং ভারত যৌথ বিবৃতিতে স্বীকার করেছে যে ২০১১ সালে তারা সম্মত হয়েছিল কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা এটি সই করতে পারেনি। তবে তারা সবার সঙ্গে এটি আলোচনা করছে।

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন জরুরি- এ বিষয়ে উভয়পক্ষ একমত হয়েছে এবং বাংলাদেশের পক্ষে আশা করা হয় যে নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হিসেবে ভারত এ বিষয়ে বাংলাদেশকে সহায়তা করবে।

লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, বাংলা ট্রিবিউন

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বুকে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি তেভেজ
বুকে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি তেভেজ
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
চিকিৎসা-খাদ্য-কৃষি সরঞ্জামের আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী শুরু হচ্ছে ঢাকায়
চিকিৎসা-খাদ্য-কৃষি সরঞ্জামের আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী শুরু হচ্ছে ঢাকায়
তিন মামলায় জামিন পেলেন মামুনুল হক 
তিন মামলায় জামিন পেলেন মামুনুল হক 
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ