X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনীতিতে বিরোধী দল: বিএনপিতে এসব কী হচ্ছে!

আনিস আলমগীর
২২ ডিসেম্বর ২০২০, ১৪:২০আপডেট : ২৭ ডিসেম্বর ২০২০, ২০:৫৬

আনিস আলমগীর

ক’সপ্তাহ আগে আমাদের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের একজন আল্ট্রা-লেফট, বর্তমানে বিএনপির সঙ্গে যুক্ত রাজনীতিক ফেসবুকে একটা পোস্ট দিয়ে বলেন, ‘এখনকার বাংলাদেশে ভাস্কর্য বা মূর্তি কি সমস্যা, নাকি ভোটের মতো একটি ব্যবস্থা যে উধাও করে দেওয়া হলো সেটাই সমস্যা?’

আমি তার পোস্টে বললাম, ‘বড় সমস্যা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ধারণ করে এমন একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের। যাদের নিজেদের দলে গণতন্ত্র আছে নেতা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায়, নেতারা দুর্নীতিমুক্ত। যারা নিজেদের আখেরের চেয়ে জনগণের কল্যাণকে ভাবে। সরকারকে দুর্নীতিমুক্ত, গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনে চলতে বাধ্য করতে পারে।’ তিনি জবাব দিলেন, মুক্তিযুদ্ধকে এত বাজে কাজে ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত করা হয়, সেটা ভয়ংকর। সবাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। জামায়াত ছাড়া। ‘

এরপর প্রশ্ন আসলো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ প্রমাণের উপায় কী। আমি তাকে সিম্পল একটি তরিকা বললাম—‘যারা বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করে তারাই স্বাধীনতাবিরোধী।’ তিনি আমাকে ক’টি সস্তা উদাহরণ দিয়ে জানালেন, বঙ্গবন্ধুকে বিএনপি অস্বীকার করে না।

আমি এই বিশ্বাসে এখনও অটল যে বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা তথাকথিত গণতন্ত্রহীনতা নয় বরং স্বাধীনতার পক্ষের একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের শূন্যতাই প্রধান সমস্যা, যারা আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে জনগণের সামনে আসতে পারে। বিএনপি কি সত্যি স্বাধীনতার পক্ষের দল এবং তারা বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে যথাযথ সম্মান দেয়? বিএনপি নেতারা যথারীতি বলবেন, হ্যাঁ। কিন্তু ইতিহাস আর তাদের কার্যকলাপ তা বলে না।

স্বাধীনতার বিরোধী শক্তির প্রতীক ছিলেন জামায়াতের আমীর গোলাম আযম। শুধু ১৯৭১ সাল নয়, স্বাধীনতার পরও বিদেশে বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত ছিলেন গোলাম আযম। জিয়াউর রহমান তাকে দেশে আসতে দিয়েছেন, খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে তাকে নাগরিকত্ব দিয়েছেন। আর শেখ হাসিনা যখন প্রধানমন্ত্রী, ১৯৯৮ সালে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য একপাশে গোলাম আযম, অন্যপাশে জেনারেল এরশাদকে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠনের ঘোষণা দিয়ে প্রথমবারের মতো স্বৈরাচার ও রাজাকারকে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক স্বীকৃতি দিয়েছেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া। তাদেরকে অসংখ্যবার মঞ্চে তুলেছেন তিনি।

বিএনপির রাজনীতির সেই ধারা একটুও বদল হয়নি। গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে বিএনপি অনলাইনে আলোচনাসভার আয়োজন করে। সেখানে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, খোন্দকার মোশাররফ হোসেন, মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, নজরুল ইসলাম খানসহ সিনিয়র নেতারা অংশ নেন। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তারেক জিয়া বক্তৃতার শুরুতে জিয়াউর রহমানকে স্মরণ করেন, জাতীয় নেতাদের স্মরণ করতে গিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, তাজউদ্দীন আহমদের নাম উচ্চারণ করেন। বঙ্গবন্ধুর নামও উচ্চারণ করেননি। বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রের জন্মদাতার নাম উচ্চারণ না করা- বঙ্গবন্ধুকে বিএনপি কেমন স্বীকার করে তার নমুনা মাত্র।

মুক্তিযুদ্ধকে হৃদয়ে ধারণ করেন এমন কিছু লোকও স্বাধীনতাবিরোধী এবং যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নেওয়া রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে যুক্ত আছেন বলে সেটা ঢাকার চেষ্টায় তারা যতই বিএনপিকে স্বাধীনতার পক্ষের দল প্রমাণের চেষ্টা করে যাচ্ছেন—তারেক জিয়া, খালেদা জিয়া—ততই প্রমাণ রেখে দিচ্ছেন যে বিএনপি স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক দল নয়। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের দলে অপমাণিত। স্বাধীনতার প্রশ্নে গোঁজামিল দিয়ে এই দেশের মাটিতে রাজনীতি করা এখন কঠিনতর বিষয়। ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে ইতিহাস এবং রাজনীতি থেকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে—তার চেয়ে শত গুণে বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। একে অস্বীকার করে কোনও দল আগামীতে ক্ষমতায় যেতে পারবে না আর।

বিএনপিতে যেসব মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন তারা বিগত সংসদ নির্বাচনে ১০ শতাংশ নমিনেশন চেয়েছিলেন কিন্তু তাদের দাবি উপেক্ষিত হয়েছে। দলে তারা কতটা উপেক্ষিত সম্প্রতি তার একটি বয়ান উঠে এসেছে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রমের প্রেস কনফারেন্সে। ১৯ ডিসেম্বর নিজের বাসভবনে তিনি অভিযোগ করেন, ‘অতীতে স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত স্মরণীয় সভাগুলোতে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হতো। গত দেড় বছরে এ ধরনের অনুষ্ঠানে দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা আমাকে ডাকার প্রয়োজনবোধ করেননি। বোঝাই যাচ্ছে, বিএনপিতে মুক্তিযোদ্ধাদের কোণঠাসা করে রাখার জন্য একটি মহল সক্রিয় রয়েছে।’

হাফিজের প্রেস কনফারেন্স করার পেছনের কারণ ছিল তার বিরুদ্ধে দলের আনা অভিযোগ খণ্ডনের উদ্দেশ্যে। দলীয় সিদ্ধান্ত ছাড়া ১৪ ডিসেম্বর হঠাৎ রাজধানীতে বিএনপির কিছু নেতাকর্মীর অবস্থান ও বিক্ষোভ প্রদর্শনে তাদের মূল দল বিএনপি নাকি বিভ্রান্ত বোধ করেছে এবং পেছনে উস্কানিদাতা হিসেবে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন এবং সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদ ছিলেন বলে অভিযোগ আনা হয়েছে। সে কারণে তাদেরকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট, প্রাক্তন মন্ত্রী এবং সিনিয়র নেতা। বিএনপিতে থাকা খেতাবপ্রাপ্ত একজন প্রমিনেন্ট মুক্তিযোদ্ধা। শওকত মাহমুদ সাংবাদিক নেতা হিসেবে খ্যাত এবং জাতীয় প্রেসক্লাবের সর্বাধিকবার নির্বাচিত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। বর্তমানে তিনি বিএনপির ভাইস প্রেসিডেন্ট।

দুইজন সম্মানিত দলীয় নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ কার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে প্রদান করা হয়েছে তার কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্য সূত্র নেই। তারা উভয়ে ভাইস-প্রেসিডেন্ট অথচ উভয় নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশে দস্তখত করেছেন একজন যুগ্ম মহাসচিব। এটি শৃঙ্খলা ভঙ্গ হয়েছে বলে মনে করে উভয় ভাইস প্রেসিডেন্ট মনোক্ষুণ্ন হয়েছেন কারণ বিএনপির আবাসিক নেতা হিসেবে পরিচিত রুহুল কবির রিজভী প্রটোকল অনুসারে ভাইস প্রেসিডেন্টকে শোকজ নোটিশ প্রদান করতে পারেন না। ধারণা করা হচ্ছে সরকারের যেসব শর্ত মেনে খালেদা জিয়া বাসায় থাকার অনুমতি পেয়েছেন সেইসব শর্তের বরখেলাপ হয়েছে, যে কারণে নিয়ম-কানুন না মেনে তাড়াতাড়ি কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করা হয়েছে। আবার দলের কিছু লোক বলছেন, তারেক জিয়া সরকারবিরোধী কোনও আন্দোলন চান না এই মুহূর্তে। এক-এগারোপরবর্তী দলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি তাকে ভীত এবং সন্দিহান করে তুলেছে নেতাদের সম্পর্কে।

হাস্যকর বিষয় হচ্ছে—সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শনকে অপরাধ বিবেচনা করা রাজনীতিতে একটি নতুন পাঠ হিসেবে নজির রাখলো বিএনপি। বিএনপির অস্তিত্ব যেখানে বিপন্ন সেখানে আন্দোলন-সংগ্রাম দলের জন্য কর্তব্য। সে কর্তব্য পালনের জন্য দলীয় নেতাকর্মীকে শোকজ নোটিশ প্রদান অত্যন্ত হাস্যকর। অথচ দলের বাহিরের বিএনপির শুভাকাঙ্ক্ষীরা মেজর (অব.) হাফিজ এবং শওকত মাহমুদকে অচলায়তন ভাঙার জন্য আন্তরিক সাধুবাদ জানাচ্ছেন। আজ ১২ বছর হলো বিএনপি কর্মীরা শত কষ্ট নির্যাতন ভোগ করার পরও যে বিক্ষোভ প্রদর্শনের মনোবল হারায়নি সেজন্যও সাধারণ মানুষ তাদের প্রশংসা করছেন। কেউ না কেউ যদি অচলায়তন ভাঙার চেষ্টা না করে তবে তাদের ভাষায় একতরফা শাসনের অবসান হবে কীভাবে? বিরোধী দলের রাজনীতি কি খুনের দায়ে ফেরারি নেতার দেশের বাইরে আয়েশী জীবনযাপন, নির্বাচন আসলে নমিনেশন বাণিজ্য আর অনলাইনে চেহারা দেখিয়ে বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা সম্পর্ক অশোভন কথাবার্তার হাট বসানো?

দেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নেই তা নয়। সীমিত আকারে কালেভদ্রে কিছু বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হয়। নির্বাচন হচ্ছে কিন্তু নির্বাচনের দিন দেখা যায় কেন্দ্রের সামনে সরকারি দলের কর্মীদের ভয়ে বিরোধী দলের প্রার্থীরা ভোটকেন্দ্রে ঢোকার চেষ্টা করে না। বিরোধী দলের কোনও নেতাকর্মী ভোটকেন্দ্রের আশেপাশেও থাকে না। কোনও চিহ্নিত বিরোধীদলীয় কর্মী দেখা হলে অপমান-অপদস্থ হওয়ার আশঙ্কাও থাকে। বিএনপি এখন একমাত্র বিরোধী দল, তারা যদি হাত গুটিয়ে বসে থাকে তবে পরিবর্তনের কোনও আশা করাতো বৃথা।

দেশের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে শক্তিশালী সরকার যেমন দরকার, শক্তিশালী এবং গঠনমূলক রাজনীতি করে এমন বিরোধী দলও দরকার। সরকারি দলের রাজনীতি মানে সকাল বেলা উঠে কিছু মন্ত্রীর বিএনপিকে তথা বিরোধী দলকে গালমন্দ করা, মূল্যহীন কথাবার্তা বলা নয়। বিরোধী দল হলে অকারণে সরকারের সমালোচনা আর জনগণের কথা না বলে দলীয় প্রধান ও তার পুত্রের মামলা-হামলা-দুর্নীতি সাফাইয়ের জন্য দলকে ব্যবহার করা নয়। রাজনীতিতে এখন তাই হচ্ছে বলে ধীরে ধীরে রাজনীতি থেকে সুন্দর কথা তিরোহিত হয়ে যাচ্ছে, গুণগতমান হারিয়ে রাজনীতি এখন বাজে কথার দোকানদারিতে পরিণত হয়েছে। রাজনীতির এই অন্তঃসারশূন্যতা মানুষের কাছে ধরা পড়ছে। সে কারণে জনগণ আর রাজনীতির জন্য রাজপথে রক্ত দিতে আগ্রহী না।

বিরোধী দল অপ্রাসঙ্গিক কিছু নয়। গণতন্ত্র চর্চার জন্য খুবই বেশি প্রয়োজন। ভারত বিভক্তির পর মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, আবুল কালাম আজাদ, বল্লভ ভাই প্যাটেল কংগ্রেসকে দ্বিধাবিভক্ত করে বিরোধী দল সৃষ্টি প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন, কিন্তু শেষপর্যন্ত কেন যে করলেন না তা এখনও অজ্ঞাত। তবে তা করাই ছিল যথোপযুক্ত কাজ। স্থপতিরা পূর্ণতার দিকে পা বাড়ায়, কিন্তু গান্ধী ছাড়া পাকিস্তান আর ভারতের স্থপতিদের সবাইকে ক্ষমতালিপ্সায় পেয়ে বসেছিল, যে কারণে তাদের মেধা ও ক্ষমতা থাকার পরও তারা অনেক কিছু করতে সক্ষম হননি।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

[email protected]

/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
মন্ত্রণালয়ে সভা করে ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে: কৃষিমন্ত্রী
মন্ত্রণালয়ে সভা করে ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে: কৃষিমন্ত্রী
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ