X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১
করোনাজয়ীর ভাষ্যে নতুন বছর

লাইফ সাপোর্ট থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার টাইমলাইন

রুমে বাতাসে হাকিমের চুল উড়ছে। ও হাঁপাচ্ছে। ক্রমশ নিস্তেজ হচ্ছে। আমরা দৌড়ে বের হলাম। দরজা লাগিয়ে দিলেন ডক্টর। আমরা আইসিইউ এর দরজার বাইরে। আমি মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম। আমার ভয়ে শরীর কাঁপছিল।

জিনাত হাকিম, নাট্যকার ও নির্মাতা
০২ জানুয়ারি ২০২১, ১৩:০৯আপডেট : ০২ জানুয়ারি ২০২১, ১৮:২৪

চলছে করোনাকাল। ২০২০ পেরিয়ে আরও একটি বছর যুক্ত হলো মানুষের জীবনে। সেই সূত্রে করোনায় বিপর্যস্ত মানব সভ্যতা ফের স্বপ্ন দেখছে ঘুরে দাঁড়াবার। নতুন বছরের বিশেষ আয়োজনে বাংলা ট্রিবিউন বিনোদন বিভাগ চেষ্টা করেছে তাদের গল্প শোনাতে; যারা করোনাভাইরাসের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন। পেয়েছেন জয়। তেমনই একজন নাট্যকার-নির্মাতা জিনাত হাকিম। যিনি একা নন, করোনার সঙ্গে লড়াই করেছেন পরিবারসহ। এরমধ্যে নন্দিত অভিনেতা আজিজুল হাকিম গিয়েছিলেন লাইফ সাপোর্টেও। যুদ্ধ জয় করে ফিরেছেন স্বাভাবিক জীবনেও— বাবাকে এভাবেই স্বাগত জানান সন্তানরা

গত ১৭ মার্চ  আজিজুল হাকিমের পরিচালনায় মঞ্চ নাটকের (ইনডেমনিটি) কাজ শেষে মুন্সীগঞ্জ থেকে বাসায় ফিরি। নাটকের অভিনেতা ও কলাকুশলীদের নিরাপত্তার সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করেই নাটকটি মঞ্চস্থ হয়।

তখন করোনা সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেশের বাইরের খবরগুলো জানতে পারছিলাম। উন্নত বিশ্বের করোনা পরিস্থিতি সম্পর্কে জেনে চিন্তিত হয়ে পড়ছিলাম। নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিই পরিস্থিতি বুঝে বাসার বাইরে যাওয়ার। শুরু হলো লকডাউনের দিন। করোনা রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়ে যাবার সাথে সাথে আমাদের ভীতিও বেড়ে চলছিল। লকডাউনের দিনগুলো আস্তে আস্তে ভুতুড়ে দিনের মতো অন্ধকার, আর ক্রমেই ভীতিকর হতে শুরু করে।

আপনজনদের মৃত্যু সংবাদ, সংক্রমিত হবার সংবাদে আমরা বিমর্ষ হতে শুরু করি। সতর্কতা বাড়িয়ে খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া বাসা থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দেই। সম্পূর্ণভাবে গৃহবন্দি জীবন যাপনের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিই। করোনা থেকে মুক্ত থাকার জন্য লকডাউনের সকল নিয়ম-কানুন বিধি-নিষেধ মেনে চলতে থাকি। নিজ বাসার বারান্দাতেও যেতাম খুব অল্প। ছাদে যাওয়াও ছিল বন্ধ।

এমনি করে পার হলো রোজার ঈদ। মার্চ-এপ্রিল-মে মাসের এই সময়ের দিনগুলো কেটেছে সবার মতোই দুশ্চিন্তায়।

জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে কিছুটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে শুরু করি। লকডাউনের শিথিলতায় জীবনের প্রয়োজনেই ঘরের বাইরে যেতে শুরু করি। আতংকিত বা ভীত না হয়ে বরং সচেতন থাকার চেষ্টা করেছি। জীবন ও সময়ের প্রয়োজনে হসপিটাল, বাজার, আত্মীয়দের বাসায় আসা যাওয়া, শুটিং, সামাজিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হই। যদিও তা ছিল সীমিত আকারে স্বাস্থ্য সচেতনতা মেনে। রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবার কারণে কখনও কখনও মনে হতো হয়তো আক্রান্ত হতে পারি, তাই আমি ও আমার পরিবারের  সকলে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম যেন করোনায় কেউ আক্রান্ত হলে তাকে জয় করতে পারি। যে বিষয়টির প্রতি আমরা যত্নবান ছিলাম তা হলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ঠিক রাখা, যাকে বলে ইমিউনিটি।

নভেম্বর মাসের ৯ তারিখে আবিষ্কৃত হয় আমার করোনা আক্রান্তের বিষয়টি। যদিও তার আগেই অর্থাৎ অক্টোবরের ২০ তারিখে হাকিমের জ্বর ও লুজ মোশন হয়েছিল, যা দুদিনেই ভাল হয়ে যায়। চিকিৎসকের সাথে কথা বলে শুধুমাত্র নাপা এক্সট্রা খেতেই সে সুস্থ হয়ে ওঠে। আমারও নভেম্বর ১ তারিখে একই লক্ষণ দেখা দেয়। আমাদের বাসার ট্যাংকিতে পানি দূষণে এমন হচ্ছে ভেবে ডাক্তারের সাথে কথা বলি ও ঔষধ খাই এবং ভালো বোধ করি। নাটকের কিছু কাজের কারণে নভেম্বরের ৬ তারিখে প্রোডাকশন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। সারারাত জেগে কাজ করি। ঢাকার বাইরে যাবার পরিকল্পনা থাকায় কাজের চাপ বেড়ে যায়। পরিশ্রম ও অনিয়মের কারণে ক্লান্তবোধ করছি ভেবে বিশ্রাম নিই। কিন্তু ক্লান্তিভাব দূর না হয়ে বরং শরীরের দুর্বলতা ক্রমশই বাড়তে থাকে। ৮ নভেম্বর বিকেল থেকেই সেই দুর্বলতা আরও বাড়ে। হাকিম চিন্তিত হয়ে পড়ে। পাশের বাসায় থাকা জুঁই আপা ও হাকিম আমার শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে কোভিড টেস্টের উদ্যোগ নেয়। যদিও আমার খাবারের কোনও অরুচি বা স্বাদ গন্ধের কোনও সমস্যা ছিল না। তবুও শুধুমাত্র দুর্বলতার কারণেই ৯ নভেম্বর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হসপিটাল থেকে লোক এসে আমার স্যাম্পল নিয়ে যায়। রাত ৯টায় আমার রেজাল্ট হাতে পাই। পজেটিভ শোনামাত্র আমি যে কথাটি বলেছিলাম তা ছিল- আলহামদুলিল্লাহ। এই কথাটি বলার কিছু কারণ ছিল। করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাবার পর সবসময়ই একটা ভয় ছিল কখন সংক্রমিত হই। যা ছিল খুবই অশান্তির। আর ধারণা ছিল একবার করোনা হলে আর হবে না। বা করোনা হলে এন্টিবডি তৈরি হবে তখন আর ভয় থাকবে না। এই জাতীয় কথা শুনেছিলাম ও বিশ্বাস করেছিলাম। তাই মনে একটা প্রস্তুতি ছিল করোনা হয়ে গেলেও মন্দ না! তাই নিজের করোনা পজিটিভ শোনার পর ‌আলহামদুলিল্লাহ বলে সাহস ও শক্তি নিয়ে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হলাম।

যেহেতু আমার পজিটিভ তাই হাকিম ও হৃদের করোনা পরীক্ষার বিষয়টি এসে গেল। ছেলে মুহাইমিন হৃদের সোজা-সাপটা কথা- করোনা টেস্টের কিছু নাই। যেহেতু আমরা একসাথেই থেকেছি ‌‘সো উই আর অবভিয়াসলি পজিটিভ এন্ড উই সুড ফাইট উইথ করোনা’! আত্মবিশ্বাসের সাথে আমার ছেলে হৃদ এ কথা বলে তার কাজে চলে গেল। হাকিম পুরোপুরি সুস্থ। সেও ভাবছে কি করা যায়। আমার বোন ভাইদের পরামর্শে পরদিন সকালে আমার বাসা থেকে অর্থাৎ নভেম্বরের ১০ তারিখে হসপিটাল থেকে কালেক্টর এসে মুহাইমিন ও আজিজুল হাকিমের স্যাম্পল ও ব্লাড কালেকশন করে। রাতে বোনের ছেলে ডাঃ জামিল তার সিনিয়র ডঃ মহিউদ্দীন আহমেদের এপয়েনমেন্ট নেয়। রাতে আমি ও হাকিম জামিলকে সাথে নিয়ে তার সাথে দেখা করি। তিনি সব রিপোর্ট দেখেন। কিছু রিপোর্ট বাকি থাকায় পরদিন সেই রিপোর্টগুলো তিনি দেখাতে বলেন। আমার দুর্বলতার জন্য তিনি কিছু ঔষধ দেন ও হাকিমের শারীরিক কোনও অভিযোগ না থাকায় তাকে সেই অনুযায়ী পরামর্শ দেন।

নভেম্বর ১০ সকাল থেকেই মুহাইমিন, হাকিম ও আমার নিজের স্বাস্থ্য সেবায় কঠিনভাবে নেমে পড়ি। বড় দুই বোনের বাসা থেকে দুপুর ও রাতে খাবার দিতে শুরু করে। হেল্পিং হ্যান্ড  বাসার রান্না ও অন্যান্য কাজে সহযোগিতা করতো, তাদের আমার বাসায় আসতে নিষেধ করা হয়। তাদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার জন্য তাদের নীচেই নিজেদের বাসায় থাকতে বলা হয়। প্রসঙ্গত তারা আমাদের বাড়ির গেটের ও বাড়ীর তত্ত্বাবধানের জন্য নিয়োজিত ইদ্রিস ও মহব্বত এর স্ত্রী। করোনা নিয়ে আগে যে ভয় বা শঙ্কা ছিল তার সবটাই দূর হয়ে গিয়েছিল। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে ও খেতে যা প্রয়োজন সে সব কাজ নিজেই করতে শুরু করি। নিজের হাতেই সব খাবার ও পথ্য তৈরি করি। সকালে ফজরের নামাজ পড়ে ডিম সেদ্ধ করা, আদা, তেজপাতা দিয়ে চা বানানো, দুধ বানানোসহ নাস্তার জন্য প্রস্তুতি। কিছুক্ষণ পর পর মাল্টার জুস, ডাবের পানি, বোনদের পাঠানো মুরগির স্যুপ নিয়ম করে নিজেও খাচ্ছিলাম এবং হাকিম ও হৃদকেও দিচ্ছিলাম। খেজুর, আপেল, নাসপাতি, পেয়ারাসহ সব ধরনের ফল কেটে খাওয়াসহ খাবারের পর কিচেনের সমস্ত কাজ নিজের হাতেই করছিলাম। হৃদ ও হাকিম আমাকে সব বিষয়েই সহযোগিতা করছিল। হৃদকে চিকিৎসক তেমন কোনও ঔষধ দেননি বরং সিজনাল জ্বর বা সর্দি হলে যেন কোনও অসুবিধা না হয় সে বিষয়ে একজন শিশু বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন।

১১ নভেম্বর ব্লাডের যে সব রিপোর্ট বাকি ছিল ডঃ মহিউদ্দীন আমার রিপোর্ট দেখে নিশ্চিত হলেও হাকিমের সিআরপি নামের রিপোর্ট দেখে কিছুটা চিন্তাগ্রস্ত হয়ে ইমার্জেন্সি ডাক্তারের সাথে কথা বলতে বলেন ও সিটিস্ক্যানের নির্দেশনা দেন। সিটিস্ক্যানের রিপোর্ট ভালো আসায় কোনও সমস্যা নেই বলে কিছুটা জ্বর থাকায় ডঃ মহিউদ্দীন হাকিমকে বাসায় দু’দিন জ্বরের ঔষধ খেতে বলেন। যদি জ্বর না কমে তারপর হসপিটালে এডমিশন করে চিকিৎসা দেয়া হবে জানান। আমাদের কন্যা নাযাহ ওর শ্বশুরবাড়িতেই ছিল। আমাদের করোনা জেনে আসতে চাচ্ছিল। আমরা আসতে নিষেধ করেছিলাম। তবুও রাত প্রায় একটায় নাযাহ এলো। আমরাও তখন ফিরেছি বাসায়। গ্যারেজে ও নীচতলায় আমার অফিসরুমে শুভ ও নাযাহ- বসে কথা বললো।  রাতে খাবার-নামাজ শেষে ঘুমাতে গেলাম প্রায় রাত দুটোর সময়। এরই মাঝে আমার আত্মীয় স্বজনদের দোয়া করতে বলে মেসেজে আমাদের করোনার বিষয়টি অবহিত করি। আমরা ভালো আছি সে কথাও বলি।

১২ নভেম্বর ভোর ৫টায় নামাজ পড়তে উঠে দেখি হাকিমের কেঁপে কেঁপে জ্বর আসছে। ঘুমাতে পারছে না। এবার উদ্বেগ কাজ করতে শুরু করলো। এর আগেই সব রিপোর্ট দেখিয়েছিলাম অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী আত্মীয় ডঃ মিতা আপা ও ফ্লোরিডায় বাসরত ড. সেজান মাহমুদকে। আমাদের শারীরিক অবস্থা নিয়ে কথাও বলেছিলাম। সব ভালো দেখে তারাও আশ্বস্ত করেছিলেন। হঠাৎ সকালে জ্বরের সাথে শুরু হয় বমি। ড. মহিউদ্দীনের নির্দেশনা থাকায় সাপোজিটরি দিই, জ্বর কমে যায়। জামিলের উপদেশে বমির ঔষধ দিই। সকাল ৭টায় ঔষধ কিনে এনে দেয় ইদ্রিস। এজন্যই তার নাম বললাম যে এদের সহযোগিতা ভোলার না। প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের যখন যা প্রয়োজন হয়েছে ইদ্রিস ও মোহাব্বত সব সময় তা করে দিয়েছে। পাশাপাশি মর্জিনা ও ফুলমতি বাসায় না ঢুকলেও সার্বক্ষণিক জুঁই আপা ও রুবী আপার মাধ্যমে সব ধরনের সাহায্য করেছে। জ্বর ও বমির পর জলির পরামর্শে হাকিমকে স্যালাইন দিই।  ডাবের পানি দিই। তারপর একে একে ডিম, দুধ, লেবু চা, কলা, মালটার জুস, মুরগির স্যুপ ও ভাত-মুরগি দিই। এসব খাবারের উল্লেখ করলাম এ কারণেই যে, শরীর ‘ইমিউনড’ রাখতে আমরা যথেষ্ট সচেতন ছিলাম। খাদ্যাভ্যাসে নিয়মিত ছিলাম বলে করোনার সাথে যুদ্ধটা হয়তো সহজ হয়েছে।
হাকিম পরিবারের সদস্যরা
১২ তারিখে দুপুরের পর থেকে হাকিমকে বেশ ক্লান্ত লাগে। আমি তখনই সিদ্ধান্ত নিই আজ হসপিটালে চলে যাবো। সারারাত হাকিমের ঘুম হয়নি, তার ওপর জ্বর-বমি ছিল। লক্ষণ ভালো লাগছিল না, তাই জামিলকে ফোন করে জানাই ভর্তি করতে চাই। জামিল জানায় সিট খালি আছে কিনা খবর নিয়ে জানাবে। দুপুরে স্যাচুরেশন লেভেল ৯২/৯৩ হলে খুব টেনশনে পড়ে যাই। হাকিম সোফায় বসে থাকলে ভালো লাগে বলছিল। বিছানায় শুয়ে থাকলে তার অস্বস্তি হচ্ছিল। ক্লান্তির কারণে ঘুমানোর জন্য বিছানায় ৪/৫টা বালিশে হেলান দিয়ে চোখটা বন্ধ করে রাখতে বলি। ও প্রায় দু’ঘণ্টা ঘুমায়। আমি ততক্ষণ হসপিটালে যাবার ও রাতে থাকার সমস্ত প্রস্তুতি নিতে থাকি।

একদিকে হৃদ ছোট। অন্যদিকে করোনার কারণে নাযাহ-শুভকে ওরা আসতে চাইলেও না করছি। এই পরিস্থিতিতেও মাথা ঠাণ্ডা রেখে সব সামলে নেবার চেষ্টা করছিলাম। বিকেলের দিকে হাকিমের দুই বন্ধু বিটিভির মহা পরিচালক হারুন উপর রশীদ ভাই ও ডিরেক্টরস গিল্ডের সভাপতি সালাউদ্দীন লাভলু ফোন করেন আমাদের খবর নিতে। হাকিম দু’জনের সাথেই কথা বলেন। তখন সে বেশ ভালো বোধ করছিল। আমি হাকিমকে জানাই ইমার্জেন্সিতে যাবো। বাসায় থেকে কোনও রিস্ক নেব না। জামিল আবারও জানায় হসপিটালে কেবিন খালি নেই। স্যাচুরেশন অক্সিমিটারে খেয়াল করি তা ৯০ এর নীচে নামতে শুরু করে। আমি ক্রমাগত জামিলকে অনুরোধ করি প্রয়োজনে ইমার্জেন্সিতে ব্যবস্থা করতে। কিছুক্ষণ পর ডঃ জামিল একটা সিটের ব্যবস্থা করে ফোন দিলে আমি সাথে সাথে চলে যাই ও জামিলের ব্যবস্থাপনায় হাকিমকে ৫২৩ নম্বর কেবিনে এডমিট করে রাখা হয়। রাত ৯টা পর্যন্ত  হাকিমকে ৫ লিটার অক্সিজেন সাপ্লাই দেয়। ক্রমেই তার অক্সিজেনের সাপ্লাইয়ের চাহিদা বাড়তে থাকে। কাশির মাত্রা বাড়তে থাকে। কাশির কারণে রুমে আনা এক্সরে মেশিনে এক্সরে করাতেও সমস্যা হচ্ছিল।

ততক্ষণে নাযাহ ও শুভ  হসপিটালে পৌঁছে গেছে। আমাদের সবার তখন মনের অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। করোনাকে যত সহজ ভাবে নিয়ে নিজেদের সুস্থ করবার কথা ভেবে নিজেরা প্রফুল্লতায় ছিলাম, যে আত্মবিশ্বাস দৃঢ় রেখে ছিলাম তা যেন চূর্ণ হয়ে গেল। বরং হাকিমের অবস্থা নিয়ে আমি ক্রমশই বিমর্ষ হয়ে পড়ছিলাম এবং ক্রমেই শক্তিহারা হচ্ছিলাম। নাযাহ-শুভ হসপিটালের নীচে এসে ফোন দিলে আমি ওদের উপরে উঠতে নিষেধ করেছি। ওদের সান্ত্বনা দিতে জামিলের বউ রেশমা হসপিটালে আসে এবং নাযাহর সাথে নীচের ওয়েটিং রুমে বসে।

ড. মহিউদ্দীন আহমেদ কেবিনে আসেন, হাকিমের এক্সরে রিপোর্ট দেখলেন। নিজেই বেশ বিস্মিত। গতরাত ১২টার সব রিপোর্ট এত ভালো অথচ এখন রিপোর্টে যা দেখছেন তিনি চিন্তিত। মনে করিয়ে দিলেন প্রথম দিনের সাক্ষাতে তিনি বলেছিলেন করোনা খুব ‘আনপ্রেডিকটেবল’। তার কথার সত্যতা পেয়ে নিজেই যেন কিছুটা চিন্তিত। তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত জানতে চাইলেন। আমার সম্মতি পেয়ে তিনি বলেন সব ধরনের চিকিৎসা তিনি একসাথে করবেন। আমি আল্লাহর ওপর ভরসা করে তিনি যা ভালো মনে করেন সেই উদ্যোগ নিতে বলি। রাত ১২টার মধ্যেই চিকিৎসকের নির্দেশে দশম তলায় হাইফ্লোতে আইসোলেশনে স্থানান্তরিত করা হয় হাকিমকে। কয়েক ধরণের ইনজেকশনসহ অনেক ঔষধ এপ্লাই করেন।

আমি পাঁচ তলার কেবিনে, নীচতলায় নাযাহ ও শুভ, বাসায় হৃদ একা এবং ১০ তলায় হাইফ্লো আইসিইউতে আইসোলেশন রুমে আজিজুল হাকিম। সামনে রাতে কি ঘটতে যাচ্ছে তা অনিশ্চিত। নাযাহ বারবার বলছিল, মা আমি তোমার কাছে আসি। কোভিড ইউনিটে ওরা এলে সংক্রমিত হবে ভয়ে আমি বারবারই না করেছি। হৃদ বাসায় একা কি করছে ও রাতে একা থাকবে? এই চিন্তায় নাযাহকে বলি, তোমরা বাসায় যাও। পরক্ষণেই মনে হয়- হাকিমের অবস্থা ভালো না। আমি নিজেও অনেক দুর্বল অনুভব করছি। অন্তত নাযাহ-শুভ পাশে থাকলে সাহস পাবো। শক্তি পাবো। তাহলে বাসায় যদি হৃদের কিছু হয়ে যায়? কোনও সমস্যা? ওকে দেখার মতো কেউ তো নেই। জীবনে এমন পরিস্থিতিতে যেন আল্লাহ কাউকে না ফেলেন। মহান আল্লাহর কাছে মোনাজাতে করে হাকিমের জন্য আমার পুরো পরিবারের জন্য সুস্থতা চাইলাম।

রাত তখন ১টা। ১০তলা থেকে আমাকে দেখা করতে ডেকেছেন কেউ। নিজের অসুস্থতার কথা ভুলে শক্ত রাখতে চাইলাম নিজেকে। সাহস রেখে গেলাম আইসোলেশন রুমে। হাকিমের তখন আরও অক্সিজেন দরকার। সে বলছে এসি কি বন্ধ? গরম লাগছে। রীতিমতো ঠাণ্ডা অথচ তিনি বলছেন বাতাস চাই! ওর কথায় আমিও সেই শীতে এসির রুমে ঘামতে শুরু করলাম, কারণ ওর অবস্থা যে খারাপের দিকে যাচ্ছে, সেটা বুঝতে বাকি রইলো না। অক্সিজেন স্যাচুরেশনও দেখিয়ে দিচ্ছিল তার ক্রমাবনতির অবস্থা। দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে ওর হাতটা ধরে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আইসিইউ গেটের কাছে আসতেই দুজন অল্প বয়সের ছেলে ডাক্তার আমার সাথে কথা বলতে এলো। কথার সারমর্ম হাকিমের ফুসফুসের ইনফেকশন দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে। ৭০% ছড়িয়ে গেছে যা আশংকাজনক। প্রয়োজনে দিতে হবে লাইফ সাপোর্ট। তাই আমাকে কনসেন্ট বা অনুমতি দিতে হবে। কথাটি শোনার পর ভালো করে বুঝতে আমার কিছু প্রশ্ন তাদের করলাম। উত্তরে যা জানালাম, তাতে ঘুরেফিরে ঐ এক কথা, সব ধরনের চেষ্টা শেষে প্রয়োজনে সর্বশেষ চেষ্টা হিসেবে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা নিতে হতে পারে। মুখে মাস্ক, পিপিই পরা ডক্টরদের দুজনের চোখের দৃষ্টিটুকু ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। কথা শুনে আর তাদের দৃষ্টি দেখে আমি ভীত হতে থাকি। অজানা ভয় আমাকে অসাড় করে দিতে শুরু করে। আমি তারপরও শক্ত হতে চাই। আমাকে সবাই বলে আমি অনেক সাহসী আমি অনেক শক্ত মনের মানুষ। আমি তখন অনুভব করতে পারি, আমার শক্তি আর সাহস যিনি- তিনিই তো আমার পাশে নেই। অক্সিজেন মাস্ক মুখে হাকিমের ক্লান্ত-শ্রান্ত-বিধ্বস্ত মুখটা আমার চোখে ভাসতে থাকে।

জামিল, আমার ছোট ভাই বাবু, আমাদের দুই বড় বোনের সাথে কথা বলে আমি ডক্টরদের এগিয়ে দেয়া কাগজে বিসমিল্লাহ বলে কনসেন্ট (স্বাক্ষর) দেই। মনে মনে বলি, আল্লাহ্ আপনি মালিক, আপনি প্রভু, আপনি আজিজুল হাকিমকে সুস্থ করে ফিরিয়ে দিবেন ইনশাল্লাহ্। নাযাহকে জানাই ফোনে এবং বলি তোমরা নীচে থাকো আমি আসছি। কেন কনসেন্ট দিলাম এই নিয়ে নাযাহ অস্থির হয়ে ওঠে। জামিল ওকে বুঝিয়ে বলে, আমি নেমে যাই নীচে। বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরে শক্তি অর্জনের চেষ্টা করি। সাহসও পাই। তখনই মনে পড়ে আমার খালি বাসায় করোনায় আক্রান্ত আমার ছোট্ট সোনা হৃদ। ভাবতেই মন আবারও অস্থির হয়ে ওঠে। ‘একা বাসায় আমার হৃদ-এর সহায় আল্লাহ্ আছেন’ মনে এই ভরসা নিয়ে নাযাহ ও শুভর সাথে থাকলাম। কিছুক্ষণ পর আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ বোধ করায় ও নিজেকে সুস্থ রাখতে কেবিনে এলাম, একা রুমে আবারও চিন্তা পেয়ে বসলো। কিছুক্ষণ পরপর ফোন করি- ক্যামন আছে আজিজুল হাকিম। ওপারের উত্তর ভালোর দিকে নেই বরং বাড়ছে অক্সিজেন ডিমান্ড। আমারও বাড়তে থাকে চিন্তা, বাড়তে থাকে শঙ্কা। সিস্টার বলেন, আপনি নিজেও অসুস্থ। ভালো হোক মন্দ হোক আমরাই আপনাকে কল করবো, সুস্থ হতে সময় লাগে। তাই অস্থির হয়ে লাভ নেই। সিস্টারের কথায় বাস্তবতা বুঝতে পারলাম। নিজেকে বোঝালাম, ফজরের নামাজ পড়ে দোয়া পড়তে পড়তে কখন যে চোখ লেগে এসেছিল জানি না।

ঘুম ভেঙে গেল। উঠে আবারও দোয়া-নামাজ পড়তে শুরু করি। তখন ১৩ তারিখ সকাল সাতটা প্রায়। ফোন বেজে উঠলো। ১০তলায় আসুন। ডাক্তার ডেকেছেন। গেলাম। এবার সোজা কথা লাইফ সাপোর্ট ছাড়া আর কোনও পথ নেই। হতবিহবল হয়ে পড়ি। কনসেন্ট যখন দিয়েছিলাম মনে আশা ছিল, রাতের মধ্যে নিশ্চয়ই সব ঠিক হয়ে যাবে। সকালে ও সুস্থ হয়ে উঠবে। এমন আশায় স্বাক্ষর দিয়েছিলাম।

আমি বললাম ওকি ব্যাক করবে? একজন ডক্টর বললেন, এটা বলা যায় না। অন্যজন আমাকে সান্ত্বনার ভাষায় কি যেন বলতে চাইলেন। আমি স্পেসিফিক করে জানতে চাইলাম- লাইফ সাপোর্ট থেকে মানুষ কি ফেরে না? দুজনেই বলেছেন। ফেরে। তবে তা সময়ের সাথে সাথে ও রোগীর কন্ডিশনের ওপর। স্যারের ১০০% লাঞ্চ ইনফেকশন প্রায়। তাই আশা ৫০/৫০। তবে দেরি করলে তার ক্ষতি হবে। আমি সাথে সাথে বললাম শেষ চেষ্টা তো করতেই হবে। আমার নাযাহ ও শুভ বাবাকে দেখবে। ওদের এখানে আসার অনুমতি দিন। তারা বললেন হাতে সময় খুব কম। এখুনি আসতে বলেন। নাযাহকে ফোন করে বললাম, মা ওপরে চলে আসো। বাবাকে এখনই লাইফ সাপোর্ট দেবে। আমি দ্রুতপায়ে গেলাম হাকিমের কাছে। বুঝিয়ে বললাম অনেক দোয়া করছি। ফু দিলাম মাথা থেকে পা পর্যন্ত। মনে কষ্ট দিয়ে থাকলে মাফ চেয়ে নিলাম। কোনও অভিনয় করতে পারিনি। বললাম, তুমি খুব ভালো মানুষ তোমাকে মাফ করার কিছু নেই। আর বললাম যতক্ষণ জ্ঞান থাকবে- আয়াতুল কুরসি ছাড়বে না। এরই মাঝে নাযাহকে বারবার ফোন দিচ্ছি, কারণ ডাক্তাররা বলছেন স্যারের সেনস থাকতে থাকতেই আমরা লাইফ সাপোর্ট দিতে চাই। সেটা তার জন্য ভালো। হাকিম চোখের ইশারায় শুভকে আসতে বললো। দৌড়ে ডাকলাম, শুভ গেল বাবার কাছে। নাযাহকে পিপিই পড়তে সাহায্য করে নিয়ে এলাম বাবার কাছে। আহারে বাচ্চাটা হৃদ। শেষ দেখাটা বোধ হয় আর হলো না। আমাদের অসহায় অবস্থা আমি হয়তো কোনদিনই ভাষায় সেভাবে বর্ণনা করতে পারবো না। আমার কাছে তখন হাকিমের জীবন মরণ সমস্যা। বেঁচে থাকা, তার মনের অবস্থা, শরীরের কষ্ট, আমার শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাওয়া- সব মিলিয়ে এক বিশাল শূন্যতা তৈরি হচ্ছিল। রুমে বাতাসে হাকিমের চুল উড়ছে। ও হাঁপাচ্ছে। ক্রমশ নিস্তেজ হচ্ছে। আমরা দৌড়ে বের হলাম। দরজা লাগিয়ে দিলেন ডক্টর। আমরা আইসিইউ এর দরজার বাইরে। আমি মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম। আমার ভয়ে শরীর কাঁপছিল।

কেবিনে এলাম। দুপুর ১২টায় শুভ আমাকে বাসায় দিয়ে গেল। নাযাহ তখন একা হসপিটাল। ছায়ার মতো জামিল হাকিমের পাশে, নাযাহর পাশে। আমি বাসায় এসে দেখি বাচ্চাটা তখনও ঘুমিয়ে। এরপর সবার ফোন। এত এত মানুষের মেসেজ, ফোনগুলো দিয়ে দিলাম শুভকে। একটা বাসায় ছিল, যেখানে হৃদ কথা বলছিল। হৃদকে সিচুয়েশন বললাম, ওর খাবার দিয়ে এই কঠিন সময়েও নিজের সুস্থতার জন্য বেশি করে খেলাম। মা বলতেন, ‘শোক করতেও শক্তি লাগে।’  আমি বাচ্চার রুমে প্রায় অচেতন। কিন্তু ঘুম আসছে না।

১৫ নভেম্বর  বিকাল পর্যন্ত হাকিম লাইফ সাপোর্টে। সেই সময় যে কতো দীর্ঘ ছিল- তা কেবল আমিই জানি। সেই সময়গুলোতে টেলিভিশন, রেডিও, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানতে পারি হাকিমের জন্য ঘরে ঘরে মসজিদে উপাসনালয়ে সবার দোয়া চলছে। যারা হাকিমকে চেনে না, তারাও দোয়া করেছেন। আমি ঘুমের ঔষধ খেয়েও ঘুমাতে পারছি না,  হাকিমের জ্ঞান ফেরার আশা নিয়ে আল্লাহর ওপর ভরসা করে চলছিলাম। বন্ধু রিপার ফোনে কোরআন তিলাওয়াত এখনও কানে ভাসে। ভাইবোনদের সান্ত্বনা, বন্ধু-সহকর্মীদের উদ্বেগ। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে জ্ঞান ফিরে আসে স্বাভাবিক ক্ষেত্রে। আমাদের সে পর্যন্ত যেতে হয়নি। আছরের ওয়াক্তে নামাজে সেজদায় পড়ে আল্লাহকে ডাকছি। আমার নাযাহও তাই। সেও ঐ সময় সেজদায় বাবার জন্য প্রার্থনারত। আলহামদুলিল্লাহ, জ্ঞান ফিরে আসে হাকিমের। জামিল জানায়। ভাগ্নে রবিন নিজে যায় হাকিমের শারীরিক সুস্থতার বিষয়টি নিজ চোখে দেখতে। বাসায় এসে আমাকে নিশ্চিত করে, আঙ্কেল ভালো আছেন।

হাকিমের ফিরে আসার খবরে সকলেই যেন শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে। এ যেন হাকিমের বেঁচে যাওয়া নয়। এটা ওর শুভাকাঙ্ক্ষীদের আপনজনদের জীবন ফিরে পাওয়া। এত ভালবাসা, সম্মান- আজীবন আমারা সবার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো। মানুষের দোয়া আর ভালোবাসায় আজিজুল হাকিমের প্রতি আল্লাহর অশেষ রহমত হয়েছে। আল্লাহর প্রতি কোটি কোটি শুকরিয়া।

লাইফ সাপোর্টে যাবার আগে হাকিম আমাকে বলেছিল, ‘ছেলে-মেয়ে দুটোকে দেখো। শুভর দিকে তাকিয়ে শুধু আমাদের দিকে ইশারা করেছিল। কথা বলবার শক্তিটুকু ছিল না। জ্ঞান ফিরে যখন শুভর সাথে প্রথম কথা বলে, তখন বলেছিল- মাকে বলো আমি আয়াতুল কুরসি ছাড়িনি। জ্ঞান ফিরেও পড়েছি। অনেকের মুখ ভেসে উঠেছে সবার জন্য দোয়া করেছি। ফোনে এসব শুনে আমি প্রাণ ফিরে পাই।’

আজিজুল হাকিমের শারীরিক অবস্থা নিয়ে সকলের উৎকণ্ঠা কাজ করছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিভ্রান্তি ছড়িয়ে যাচ্ছিল। বিপর্যস্ত থাকায়, আমি বা নাযাহ কোনও আপডেট শেয়ার করার মতো মানসিকতায় ছিলাম না। অনুভব করলাম, কোনও একজন নির্দিষ্ট মানুষকে দায়িত্বটুকু এখন নিতেই হয়। তারপর  হাকিমের স্বাস্থ্য বিষয়ক একটা লেখা পোস্ট দেই।

আইসিইউতে ১৫ নভেম্বর থেকে কয়েকদিন এবং ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত হাকিম বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হসপিটালে নিবিড় পর্যবেক্ষণেই ছিলেন। শেষের কয়েকটা দিন কেবিনে থাকলেও সেখানেও তাকে স্পেশাল অবজারভেশনে রাখা হয়েছিল। তার দিন রাত সারাক্ষণের সঙ্গী নাযাহ ও শুভ। ছায়াসঙ্গী ছিলো ভাগ্নে ড. জামিল আর বাসায় ছিলাম হৃদকে নিয়ে আমি। জ্ঞান ফিরলেও শরীরের অন্যান্য সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সুস্থতার জন্যও তাকে ঔষধ দেয়া হয়েছে। ডাক্তারের ভাষায় হঠাৎ সুনামির মতোই হাকিমকে করোনা-আঘাত করে তার শরীরের সমস্ত অর্গানগুলোকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল। আল্লাহর কৃপায় তাদের চিকিৎসায় আবারও সুস্থতা ফিরে পেয়েছে।

প্রতিদিনের খবরগুলো আমি পেয়েছি আমাদের বড় ভাইতুল্য প্রিয় মানুষ সংসদ সদস্য ও অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর ভাই-এর কাছ থেকে। তিনি নিয়মিতভাবে আমাকে সব জানিয়েছেন। আরও জানাতেন বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশিদ ভাই। অভিনেতা নাসিম, পরিচালক অলীক, উপস্থাপক আনজাম মাসুদ নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন। সবাই হাকিমের খবর নিয়ে আমাদের সাহস দিয়েছেন, দোয়া করেছেন। সবার প্রতি আমার ও পরিবারের অশেষ কৃতজ্ঞতা।

নভেম্বর ২২, ২৩, ২৪ তারিখ রাতে আমি ইচ্ছে করেই নাযাহ ও শুভকে রাতে বাসায় পাঠিয়ে দিতাম। কারণ এই ৩দিনে আমি শিখতে চেয়েছি, বাসায় কি করে হাকিমকে সেবা যত্ন করতে হবে। ওষুধ কখন কি দিতে হবে। কী কী খাওয়াতে হবে। ইত্যাদি। সারারাত জেগে থাকতে হয়েছে হাকিমের সাথে। বাসায় খোঁজ খবর রেখেছি সারাক্ষণ। হৃদ-এর প্রতিও লক্ষ্য রাখতে হয়েছে। ২৪ তারিখ রাতে আমি ঘুমের ঘোরে প্রায়ই একা একা বলছিলাম- আব্বা কিছু লাগবে? আব্বা খারাপ লাগছে? আরও অনেক কথা। হাকিম জেগে বলতো, কার সাথে কথা বলছো? আমার বাবার মৃত্যুর আগের রাতে হসপিটালে আমি জেগেছিলাম। ডাক্তার ২৪ তারিখে যখন বলেছিলেন আগামীকাল ‘ডিসচার্জ’ দেবো, কারণ আজিজুল হাকিম এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। ভয়-ক্লান্তি কাটিয়ে অনেকদিন পর যখন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিলাম আব্বার সাথে কাটানো ঐ রাতের কথাগুলোই অবচেতনে ঘুমের ঘোরে আমি বলছিলাম।

২৫ নভেম্বরে বাচ্চারা বাবাকে সাদরে বাসায় স্বাগতম জানায়। আনন্দে সবার চোখেই পানি। আনন্দের অশ্রু যাকে বলে, চিকিৎসকের পরামর্শে বাসায় একটি রুমে একমাস পূর্ণ বিশ্রামে খুব যত্নে রাখা হয় সবার প্রিয় মানুষ, প্রিয় নায়ক, অভিনেতা আজিজুল হাকিমকে। হসপিটাল থেকে ফেরার দিন নাযাহ ও শুভর কোভিড টেস্ট করে আসি। স্বাভাবিকভাবেই নাযহার পজিটিভ আসে। ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী আমাদের পোস্ট কোভিডের প্রভাবমুক্ত থাকতে যা কিছু খাওয়া দরকার নিয়ম করে চলা দরকার ও ঔষধ-পথ্য দরকার সব চালিয়ে গিয়েছি। ৯ ডিসেম্বর ২০২০ ছিলো আজিজুল হাকিমের ফলোআপ ডেট। আবারও হাকিমের নানা ধরণের বায়োলজিক্যাল টেস্ট করা হয় এবং তার রিপোর্ট দেখার পর ডাক্তার মহিউদ্দীন আহমেদ জানান, আপনি এখন ঠিক আগের আজিজুল হাকিম। আর সবার যেমন সাবধানতা মেনে চলতে হবে আপনারও ঠিক তাই। নিশ্চিন্ত হয়ে বাসায় ফিরে আসি।

কোভিড পরবর্তী প্রভাবের ভোগান্তিটা চলছিল তখনও। ক্লান্ত লাগা, অবসাদগ্রস্ততা, প্রেশার আপ ডাউন, শরীরে পানি আসা, চুল পড়ে যাওয়া ইত্যাদি। বারবার ক্ষুধা পাওয়া, খাবারে রুচি বেড়ে যাওয়া, মোটা হয়ে যাওয়া- এসবও করোনা পরবর্তী সিনড্রোম। তাই আমরা এসব প্রভাবের মধ্য দিয়েই চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থাপত্র অনুসরণ করে ভালো আছি। আমরা সবাই সাহসের সাথে করানোকে ফেইস করার জন্য সব সময় মানসিকভাবে দৃঢ় ছিলাম, যা আমাদের এই যুদ্ধে শক্তি ও মনোবল দিয়েছে। যে কোনও যুদ্ধ জয়ে এই দুটোর খুব বেশি প্রয়োজন।

২০২০ সালের নভেম্বর মাসের ১০ তারিখ থেকে ডিসেম্বরের ২৫ তারিখ পর্যন্ত যে কঠিনতম পরীক্ষার মধ্য দিয়ে দিন-রাত পার করতে হয়েছে, তার অনেক কিছুই এই লেখাতে তুলে আনা সম্ভব নয়। তবে এটুকু বলতে পারি, বিপদে ধৈর্যহারা হইনি, সবার অনেক অনেক অনেক দোয়া সাথে ছিল। হাসপাতালে আজিজুল হাকিমকে ঘিরে স্ত্রী ও চিকিৎসকরা
আমার অভিজ্ঞতায় করোনা সম্পর্কে যা শিখেছি-
* একবার হলে আর করোনা হবে না- এন্টিবডি তৈরি হয়ে যায়, এটা সঠিক নয়। এই ধরনের আশ্বাস ডাক্তার আমাদের দেননি। বরং বলেছেন, এরপর হলে তা দুর্বল শরীরের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
* করোনা আনপ্রেডিকটেবল। কার ক্ষেত্রে কিভাবে প্রভাব রাখবে বা কোন চিকিৎসা নিতে হবে এসব বিষয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কোভিড টেস্ট করাসহ রক্তের নানা পরীক্ষা, চেস্ট এক্সরে বা সিটিস্ক্যান-এর মাধ্যমে জটিলতা জেনে বুঝে প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসা নেয়া উচিৎ।
* বাসায় রাখা উচিত অক্সিমিটার (অক্সিজেনের মাত্রা অর্থাৎ স্যাচুরেশন মেপে দেখার ছোট একটা যন্ত্র) যেখানে লেভেল ৯৫-এর ওপর নিরাপদ বলা হয়।
* ফুসফুসে বাতাস নেবার প্র্যাকটিস করতে হবে নিয়মিত। নাক দিয়ে আস্তে আস্তে দীর্ঘক্ষণ শ্বাস নিয়ে মুখ দিয়ে বাতাস বের করলে ফুসফুসে অক্সিজেন সরবরাহ হয়।
* সচেতনতা আর সাবধানতা অবলম্বন করে করোনা থেকে মুক্ত থাকবার চেষ্টা করতে হবে।
* করোনা পজিটিভ হলে তা পাপ বা গুনাহ বা লজ্জার না ভেবে সবাইকে জানাতে হবে। এটাতে লাভ হবে- সবাই দোয়া করবে আর অন্যরা নিজেকে নিরাপদ রেখে আপনাকে স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারবে। তা না হলে অসুস্থতা গোপন করার কারণে অনেকেই সংক্রমিত হয়ে পড়বে।
নতুন বছরের প্রত্যাশা-
বিধ্বংসী এই করোনা ভাইরাস সারা বিশ্বেই রূপ পাল্টে চলেছে। এই মহামারি থেকে নিজেকে রক্ষার সর্বোচ্চ চেষ্টাও তাই বিফল হচ্ছে। হার মানতে হচ্ছে করোনার কাছে। তবুও সব রাত যেমন ভোর হয়, ইনশাআল্লাহ্ অচিরেই পৃথিবীতে মানুষ আবার তার স্বাভাবিক জীবনে স্বস্তির শ্বাস নেবে।
নতুন বছরে পরিবারের প্রিয়জন হারানো মানুষগুলোর শোক কাটিয়ে ওঠার শক্তি দিন সৃষ্টিকর্তা। সারা বিশ্বে করোনায় আক্রান্ত মানুষেরা সুস্থ হয়ে উঠুক, ভালো থাকুক প্রতিটি মানুষ। হিংসা, দ্বেষ ভুলে পরস্পরকে ভালোবাসি সবাই, পৃথিবী হোক সুন্দর ও শান্তিময়। প্রকৃতি শুদ্ধতা নিয়ে তার নিজস্ব স্বাভাবিকতায় ফিরে আসুক, আমরা ফিরতে চাই আমাদের সুন্দর জীবনে।
করোনামুক্ত হোক পৃথিবী। ২০২১ সেই বার্তা বয়ে আনুক।

/এমএম/
সম্পর্কিত
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
কান উৎসব ২০২৪১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
এই জন্মদিনে আরেক সিনেমার ঘোষণা
এই জন্মদিনে আরেক সিনেমার ঘোষণা
ভোট দিতে এসে কেউ উৎফুল্ল, অনেকেই ক্ষুব্ধ!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনভোট দিতে এসে কেউ উৎফুল্ল, অনেকেই ক্ষুব্ধ!
দেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
সিনেমা সমালোচনাদেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা