X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

ছেলেটি, মেয়েটি এবং আমরা

তুষার আবদুল্লাহ
০৯ জানুয়ারি ২০২১, ১৫:৫৮আপডেট : ০৯ জানুয়ারি ২০২১, ১৫:৫৮

তুষার আবদুল্লাহ রায় ঘোষণাতো হয়েই গেছে সেই বিষন্ন রাতে। এখন সেই রায় নিয়ে চলছে যুক্তি-তর্ক। রায় বদলেও ফেলছেন কেউ কেউ। দু’দিন পেরিয়ে এসে অবস্থান বদলাতেও দেখা যাচ্ছে অনেককে। সঙ্গে নিজেদের মধ্যেই চলছে নানা রকম সওয়াল জবাব।

বক্তব্য, পাল্টা- বক্তব্য ঘটনায় থাকেনি। সমাজ, রাষ্ট্র পেরিয়ে বৈশ্বিক হয়েছে। কেউ কেউ নিজের কাছেই নিজে প্রশ্ন করেছেন, প্রশ্ন রেখেছেন সমাজের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে। কারও কারও প্রকাশ ভঙ্গী এমন– এধরনের সংবাদ শোনার জন্যে তৈরি ছিলেন না মোটেও। এমন ঘটনা ঘটার মতো পরিবেশ তৈরি হয়নি। আবার কারও কাছে বিষয়টি স্বাভাবিক দুর্ঘটনা মনে হয়েছে। এসব কিছুর সঙ্গে রোগ সারাবার বিস্তর সুপারিশে প্লাবিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এই সব কিছুই ঘটছে ঘোষিত রায়কে আবর্তিত করেই। রায়টি ছিল বিভক্তি রায়।এক পক্ষ বলছে, ছেলেটি দোষি। যে পরিস্থিতিতেই ঘটনাটি ঘটুক না কেন, শেষ পর্যন্ত দোষি ধর্ষকই। অন্যপক্ষ বলছে, দোষ মেয়েটিরও রয়েছে। সে কেন ছেলেটির বাড়ি গেলো এবং সাবধানতা অবলম্বন করলো না। এর সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সনাতন মাধ্যমের এক রকম প্রয়াস ছিল ঘটনাটি যৌথ বোঝাপড়ার মধ্যে ঘটতে যাওয়া ক্রিয়ায় দুর্ঘটনা মাত্র। যেখানে প্রচ্ছন্নভাবে এই ইঙ্গিতটি রয়েছে যে আমাদের সমাজে বা এধরনের সম্পর্ক এবং সম্পর্কের বোঝাপড়াটি ওই গন্ডি পর্যন্ত গড়াচ্ছে স্বাভাবিকতার মধ্যেই। একই ভাবে ওই বার্তাটিও স্পষ্ট– সম্পর্কের বিশ্বস্ততার প্রাচীরটিও অক্ষত নেই।

খবরটি যখন বিস্ফোরিত হলো, তখন একপক্ষ ঠোঁট উল্টে, ভেংচি কেটে বলতে শুরু করলো- ওহ আচ্ছা, ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে এমন ঘটনাতো ঘটবেই। কল্পিত আরও কিছু ঘটনার অনুকাহন বর্ণনায় তারা বিনোদিত হতে চাইলো। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গেও তাদের এমন ভঙ্গিমা দেখি আমরা। যেন বাংলা মাধ্যমের বিদ্যায়তন, রাষ্ট্র পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয় তুলসী পাতায় আচ্ছাদিত। বিভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসীরা আবার দেখলাম, ধর্মীয় শিক্ষা ও আচারের বয়ান দিতে শুরু করলেন। ভাববেন না এরা ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত কেউ, এরা আধুনিক শিক্ষার প্রচারক, তাদের সন্তানরা ইংরেজি মাধ্যমেই যান। তবে কেন এধরনের বয়ান? কারণ তাদের মানসিক ও নৈতিক আস্থার জায়গাটি অনেক আগেই ভেঙে চুরমার। অনেককেই দেখলাম ছেলে এবং মেয়ে উভয়ের পরিবারের পরিচয় জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন। একটু অতিটাকা বা ক্ষমতার গন্ধ পেলেই যেন সরল রায় দিয়ে দেওয়া যায়– উঁচু তলাতে বা টাকার সমুদ্রে এমন নোংরামিতো ভেসে উঠবেই। যেন মধ্যম ও নিচুতে কেবল সুগন্ধি ফুলই ফোটে।

ঘটনার ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পর সনাতন ও নতুন মাধ্যমে আরেকটি শব্দ পেলাম ‘বিকৃত যৌনাচার’। মেয়েটির মৃত্যুর জন্য বিকৃত যৌনাচারই দায়ী। এই শব্দটির মধ্যেও রায় লুকায়িত। ধর্ষণ নয়, উভয়ের সম্মতিতে ঘটতে যাওয়া ক্রিয়াটি বিকৃতভাবে পরিচালিত হতে গিয়ে ঘটেছে দুর্ঘটনা। যে শব্দটি ব্যবহৃত হলো বিকৃত যৌনাচার। এর সঙ্গে আমাদের সন্তানদের পরিচয় ঘটলো কী করে, পরিচয়টি কি একেবারেই নতুন? মোটেও নয়। সমাজে এমন ঘটনা ঘটার খবর কানে উঠে প্রায়শ। মেয়েটির মৃত্যু না হলে এই ঘটনাটিও গলি পেরিয়ে সদর রাস্তায় এসে পৌঁছাতো না। আমরা উড়াল সড়কের সওয়ার হলেও, এখনও ভাবি মেয়েটি পোশাক নিয়ে। মেয়ে যে কোনও যৌন নিপীড়নের শিকার হলে, সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চাই, মেয়েটির পোশাকই ঘটনাটিকে প্ররোচিত করেছে। যৌনতাকে আমরা বরাবরই শাক দিয়ে ঢেকে রাখি। যৌনতা মানে অশ্লীলতা নয়, সৃষ্টির সৌন্দর্য ও পবিত্রতা হচ্ছে যৌনতা। এই বোধের কাছে জাতি হিসেবে সামষ্টিকভাবে আমরা পৌঁছাতে পারিনি। এখনও পরিবারে লুকোচুরি চলে কন্যার ঋতুচক্রে। অগ্রসর চিন্তার পতাকা উঁচিয়ে বেড়ায় যে গণমাধ্যম, তার কাজের জায়গাতেও নারী সহকর্মীরা ঋতু চক্রের অসুস্থতার ছুটি নেন লুকিয়ে। কোথাও কোথাও এই ছুটি নেওয়ার জন্য তাকে নিগৃহীতও হতে হয়। বিদ্যায়তনে তো নয়ই, পরিবারেও যৌন শিক্ষা ও এ বিষয়ক সচেতনতা দেওয়া হয়নি। ফলে শৈশব থেকেই সন্তানরা এই বিষয়ের কৌতূহল এক সময় মেটাতো যৌন উত্তেজক লেখা বা বই পড়ে। এখন অন্তর্জালে তাদের জন্য এই জ্ঞান অবাধ। সেই অবাধ জ্ঞান আবার বিকৃতিতে ভরপুর। কারণ মানসিকভাবে বিকৃতরাই ভিডিওচিত্র অনলাইনে ছেড়ে দিচ্ছে। এ থেকে রক্ষা পেতে যৌনতা আছে এমন সাইট বন্ধ করে দেওয়ার নানা নির্দেশ ও ব্যবস্থা সরকারিভাবে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু আদম সন্তানদের নিষেধের প্রতি দুর্নিবারমোহ থাকবেই। তারা নানা উপায়ে তার কাছে যাবেই। বাঁধা উল্টো তাদের বাসনা আরো তীব্র করে তুলবে। স্মরণে রাখা প্রয়োজন, উন্নত পরিচয়দানকারী দেশও যৌন বিকৃতি ও অপরাধ ওই বিষয়ক শিক্ষা দিয়ে আটকাতে পারেনি। পেরেছে অধিকাংশকে সচেতন করে ওই বিষয়ের অতিমারি ঠেকাতে। মৃত্যু দুঃখজনক, এমন মৃত্যু আমরা চাই না বলেই, সন্তানকে সুস্থ ও সুন্দর সম্পর্কের মন্ত্র শেখানো জরুরি। অতিজরুরি জানানো জৈবিক চাহিদারও একটি নন্দন আছে, যেখানে ভালোবাসা ও বিশ্বাসের ফুল ফোটে, অবিশ্বাসের নয়। 

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সরকারি চাকরির বড় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, বেতন স্কেল ৯৩০০-২২৪৯০ টাকা
সরকারি চাকরির বড় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, বেতন স্কেল ৯৩০০-২২৪৯০ টাকা
মিয়ানমারে বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত শহরে কোণঠাসা জান্তা
মিয়ানমারে বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত শহরে কোণঠাসা জান্তা
দুই ভাইয়ের হাতাহাতিতে প্রাণ গেলো বড় ভাইয়ের
দুই ভাইয়ের হাতাহাতিতে প্রাণ গেলো বড় ভাইয়ের
বিখ্যাত চমচমের কারিগর শংকর সাহা মারা গেছেন
বিখ্যাত চমচমের কারিগর শংকর সাহা মারা গেছেন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ