X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘ট্রাম্পিজম’কে হারিয়ে ‘বাইডেনিজম’ জয়ী হবে!

মো. জাকির হোসেন
২০ জানুয়ারি ২০২১, ১৫:৩৭আপডেট : ২০ জানুয়ারি ২০২১, ১৫:৫২

মো. জাকির হোসেন আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের শপথগ্রহণ ও অভিষেক অনুষ্ঠিত হবে। আমেরিকার নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের এমন অভিষেক পৃথিবী এর আগে কখনও দেখেছে বলে জানা নেই। অভিষেকের আগের নানা জমকালো অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে। বিশিষ্টজনদের নিয়ে নৈশভোজ, অভিষেকের পূর্ণাঙ্গ মহড়াসহ অনেক কিছুই বাতিল করা হয়েছে। প্রেসিডেনসিয়াল প্যারেডের পরিসরও ছোট করে আনা হয়েছে। সাধারণ মানুষের জন্য এবার আর আগের মতো অনুষ্ঠান উন্মুক্ত থাকছে না। প্যারেডের সময়ও রাস্তার দু’পাশে থাকবে না মানুষের ভিড়। বাইডেনের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যাতে কোনও বিশৃঙ্খলা না হয় এ জন্য ওয়াশিংটন ডিসি কার্যত সামরিক গ্যারিসনে পরিণত হয়েছে। ওয়াশিংটন ডিসিতে নেওয়া হয়েছে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা। নিরাপত্তার বেড়াজালে অনেকটা অবরুদ্ধ ওয়াশিংটন ডিসি। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ঘিরে আছেন সামরিক বাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা। নিরাপত্তার ঘেরাটোপে নগরীতে প্রায় কারফিউ অবস্থা বিরাজ করেছে। কেবল ওয়াশিংটন ডিসিতেই ২৫ হাজারের বেশি সেনা সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। তারপরও উৎকণ্ঠা কাটছে না। সেনা সদস্যদের মধ্যে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি সহানুভূতিশীল পক্ষ নিয়ে এই উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলো খবর দিয়েছে, ওয়াশিংটন ডিসির নিরাপত্তায় নিয়োজিত লোকজনের মধ্যে ট্রাম্পের প্রতি সহানুভূতিশীল পক্ষ থাকতে পারে। এ অবস্থায় ওয়াশিংটন ডিসিতে পাহারায় নিয়োজিত সেনা সদস্যদের ওপর নজরদারির জন্য পাল্টা সেনা গার্ড মোতায়েন করা হয়েছে। কেবল ওয়াশিংটন ডিসি নয়, ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ড আগে থেকেই ৫০টি রাজ্যে পাঠানো হয়েছে। গত ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে উগ্র ট্রাম্প সমর্থকরা নজিরবিহীন ঘৃণ্য আক্রমণ করে এবং এ ঘটনায় ৫ জনের মৃত্যু হয়। অন্যদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেনের শপথের ২ দিন আগে থেকেই দেশজুড়ে প্রতিবাদ মিছিল শুরু করেছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকরা। প্রতিবাদ শান্তিপূর্ণ হলেও কোনও কোনও অঞ্চলে প্রতিবাদীদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের সমর্থকদেরও রাস্তায় দেখা গিয়েছে। গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, চরমপন্থী গোষ্ঠী বুগালুর সদস্যদের কোনও কোনও মিছিলে দেখতে পাওয়া গিয়েছে। তাদের হাতে অটোমেটিক রাইফেল ছিল। এই গোষ্ঠী আমেরিকায় আরও একটি গৃহযুদ্ধ ঘটিয়ে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চায়।

মিথ্যাচার, কথা ও কাজে হিংস্রতা, শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদকে উসকে দেওয়া, একনায়কতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী আচরণ এবং মার্কিন সমাজকে ভয়ংকরভাবে বিভাজনের মাধ্যমে মার্কিন গণতন্ত্রকে বিপন্ন করে তুলেছে ট্রাম্প। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ট্রাম্প তার নিজ দেশের গণতন্ত্রকে যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে তার পূর্বসূরি প্রেসিডেন্টরা বিভিন্ন দেশের গণতন্ত্রকে এর চেয়েও ভয়ংকরভাবে ধ্বংস করেছে। অনেক দেশে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারকে অপসারণ কিংবা হত্যা করে সামরিক, স্বৈরাচারী, একনায়ক সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছে, পৃষ্ঠপোষকতা করেছে অনেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট। যাই হোক, আজকের লেখার বিষয়ে ফিরে আসি। ট্রাম্প তার বল্গাহীন ক্ষমতালিপ্সাকে চরিতার্থ করাতে নানা অপকৌশল অবলম্বন করেছেন। তার রিপাবলিকান দল থেকে নির্বাচিত সদস্যদের ও প্রশাসনের কর্মকর্তা, যাদের তার দল ও তার প্রতি আনুগত্য রয়েছে, এমন ব্যক্তিদের ব্যবহার করে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তার দাবির প্রেক্ষিতে কোনও কোনও ক্ষেত্রে ভোট পুনরায় গণনাও করা হয়েছে। নির্বাচনে কারচুপি, অনিয়মের মিথ্যা অভিযোগ নিয়ে ট্রাম্প আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। সর্বশেষ সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ রিপাবলিকানদের দিয়ে তিনি নির্বাচনের সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়াটি বাতিল করানোর অপকৌশল অবলম্বন করেছিলেন। তার অপকৌশলকে রিপাবলিকান সিনেটররা সমর্থন করবেন না আঁচ করতে পেরে তিনি তার সমর্থকদের উসকে দিয়েছেন ক্যাপিটল হিল আক্রমণ করতে। নজিরবিহীন এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত একজন মহিলা এবং দু’জন পুলিশসহ ছয় জন গুলিতে নিহত হয়েছেন। সংসদ ভবনে উত্তেজিত জনতার আক্রমণ গণতান্ত্রিক দেশ দূরে থাক, অগণতান্ত্রিক, কর্তৃত্ববাদী ও একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার দেশেও বিরল ঘটনা। ক্যাপিটল হিল আক্রমণের নিন্দনীয় ঘটনায় সাবেক ও কর্মরত কয়েকজন সেনা সদস্য অংশ নিয়েছেন। ফলে বাইডেনের শপথ অনুষ্ঠানের নিরাপত্তায় নিয়োজিত লোকজনের মধ্যে ট্রাম্পের প্রতি সহানুভূতিশীল পক্ষ থাকতে পারে বলে অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে। ট্রাম্প তার ক্ষমতালিপ্সা ও নিকৃষ্ট যুদ্ধংদেহী আচরণে শুধু দেশকে বিভক্ত করেননি; তার নিজের দলকেও বিভক্ত করেছেন। মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে অবিশ্বাসের বীজ ঢুকিয়ে দিয়েছেন। ট্রাম্প মার্কিন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিগ্রস্ত করার পাশাপাশি মার্কিন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ও বড় ফাটল সৃষ্টি করেছেন, যার ভেতরে ঢুকে পড়েছে বর্ণবাদ, ফ্যাসিবাদ ও উগ্রবাদ। অভ্যন্তরীণভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করার পাশাপাশি ট্রাম্প বহির্বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের যে নেতৃস্থানীয় অবস্থান ছিল সে ইমেজকেও দারুণভাবে ক্ষুণ্ন করেছেন। জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন ট্রাম্প। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে চাঁদা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। অভিবাসনবিরোধী ট্রাম্প ভয়ংকর সব অভিবাসনবিরোধী আইন ও বিধিমালার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসনবান্ধব মানবিক ভাবমূর্তিকে ধূলিসাৎ করেছেন। চার দশকের মধ্যে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক সবচেয়ে খারাপ হয়েছে। তাইপের ওপর থেকে সব বিধিনিষেধ তুলে দিয়ে চীনকে আরও উসকানি দিয়ে রেখে গেছেন ট্রাম্প। ব্রেক্সিট সমস্যা থেকে শুরু করে বাণিজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে ট্রাম্প একলা চলার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ইউরোপীয় মিত্ররাও। ইয়েমেনে হুতিদের সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে ট্রাম্প প্রশাসন, যা নিয়ে জাতিসংঘ এবং ত্রাণ সংস্থাগুলো গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। জাতিসংঘ ত্রাণ সংস্থার পক্ষ থেকে নিরাপত্তা পরিষদে বলা হয়েছে, এই সিদ্ধান্তে ইয়েমেনে মানবিক দুর্যোগ ভয়াবহ রূপ নেবে। কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করতে জো বাইডেন বিশেষভাবে ইচ্ছুক, সেই কিউবাকে হঠাৎ করে সন্ত্রাসে মদতদাতা রাষ্ট্রের তালিকায় ঢোকানো হয়েছে। ইরানে এখন আল কায়দা তাদের প্রধান ঘাঁটি তৈরি করেছে এই অভিযোগ তুলে কিছু সিনিয়র ইরানি নেতা এবং প্রতিষ্ঠানের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছেন। এমনকি আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির নিয়ন্ত্রিত কিছু প্রতিষ্ঠানকেও এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়েছে। আছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও শরণার্থী সংকট। সর্বোপরি রয়েছে ভয়ানক করোনা মহামারি।

জ্ঞান-বিজ্ঞান, চিকিৎসা শাস্ত্রে উন্নত দেশ হওয়া সত্ত্বেও ট্রাম্পের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে করোনায় সর্বোচ্চ মৃত্যু ও আক্রান্তের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। স্মরণকালের ভয়াবহ অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা ও অস্থিরতা বিরাজ করছে যুক্তরাষ্ট্রে। সর্বোপরি বৈশ্বিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের ভয়ংকর চ্যালেঞ্জ রয়েছে সামনে। ইতিহাসের এমন এক প্রতিকূল সময়ে জো বাইডেন প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে যাচ্ছেন।

ট্রাম্পবাদকে পরাহত করে বাইডেনবাদ কতটুকু জয়ী হবে তা সময়ই বলে দিবে। তবে আশাবাদী হওয়ার মতো যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে পোড়খাওয়া মানুষ বাইডেন একজন ভালো প্রশাসক ও সংগঠক। ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। মাত্র ২৯ বছর বয়সে সিনেটর নির্বাচিত হওয়ায় মার্কিন রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতাও প্রচুর। জয়ের পর পরই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছিলেন, ‘সামনে আমাদের কঠিন পথ, কিন্তু আমি অঙ্গীকার করছি: আমি আমেরিকার সব মানুষের প্রেসিডেন্ট হবো। কে আমাকে ভোট দিয়েছে আর কে দেয়নি, সেটা বড় কথা নয়। আপনারা আমার ওপর যে আস্থা রেখেছেন, আমি সেই ভরসার প্রতিদান দেবো।’ বাইডেন বলেছেন, ‘বিদ্বেষের বদলে ভালোবাসা, বিভাজনের বদলে ঐক্য এবং কল্পনার বদলে বিজ্ঞান- এ বোধ হোক আমাদের এগোনোর পথ।’ বাইডেন আরও বলেছেন, ‘আমেরিকার আত্মাকে ফেরাতে আমি এ নেতৃত্ব দিতে চেয়েছি। জাতির মেরুদণ্ড মধ্যবিত্তরা যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে, এ জন্য আমি প্রেসিডেন্ট হতে চেয়েছি। আমি এ দায়িত্ব পেতে চেয়েছি যেন দেশের ভেতর নিজেদের মধ্যে ঐক্য ফেরাতে পারি, এবং একই সঙ্গে বিশ্বদরবারে আমেরিকাকে মহিমান্বিত করে তুলতে পারি।’
ট্রাম্পের কাছ থেকে যে আমেরিকাকে বাইডেন পাচ্ছেন, সে আমেরিকা করোনা মহামারিতে পর্যুদস্ত, অর্থনীতি ভঙ্গুর, বেকারত্ব চরম সীমায় গিয়ে পৌঁছেছে, আর বহির্বিশ্বে প্রায় বন্ধুহীন ভয়ংকর বিরূপ ইমেজের মধ্যে আমেরিকা। জো বাইডেন তার প্রাথমিক কাজও নির্ধারণ করে ফেলেছেন। তিনি বলেছেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার প্রথম কাজ হচ্ছে করোনা মহামারির কবল থেকে আমেরিকাকে মুক্ত করা। তার প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য করোনা সংকট থেকে দেশকে উদ্ধার করা। সে জন্য প্রথমেই একটি টাস্কফোর্স তৈরি করেছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। তার দ্বিতীয় কাজ, তার মতে, ট্রাম্পের আমল ছিল আমেরিকার অন্ধকার যুগ। এই অন্ধকার যুগ থেকে আমেরিকাকে আলোয় ফেরানো। আমেরিকার অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে তিনি ১০০ দিনের কর্মসূচি প্রণয়ন করেছেন। বাইডেন তার প্রতিশ্রুতি পূরণ ও সদিচ্ছার প্রমাণ দিতে দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিনই প্রায় ডজনখানেক নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করবেন। ট্রাম্পের সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের যেসব নীতি বদলে ফেলা হয়েছিল, সেগুলো আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে এসব নির্বাহী আদেশ। এরমধ্যে রয়েছে জলবায়ু চুক্তিতে ফেরা, সাত মুসলিম দেশের যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া, নতুন অভিবাসন নীতির খসড়াও ঘোষণা, যা লাখো অনিবন্ধিত অভিবাসীর বৈধতা পাওয়ার পথ খুলবে ইত্যাদি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করছেন, অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র দুই নীতির ক্ষেত্রেই বাইডেন হয়তো ওবামা নীতিতে ফিরে যাবেন। চীনের সঙ্গে শত্রুতার পরিবর্তে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে প্রাধান্য দেবেন। অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকতে না পারলে ধনতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক বিশ্বে আমেরিকার নেতৃত্ব ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। এমন লোকজনকে বাইডেন তার পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিয়েছেন যারা ‘একলা-চলা’ নীতির বদলে আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় বিশ্বাসী। আমেরিকার ক্ষত মেরামত এবং ঐক্য ও সংহতির উদ্যোগে বাইডেনবিরোধী রিপাবলিকানদের একটি অংশের সমর্থন পাবেন বলে প্রত্যাশা করা যায়। ক্যাপিটল হিলে হামলাকে রিপাবলিকানদের অনেকে নিন্দা জানিয়েছে। ট্রাম্পের উগ্র আচরণে বিরক্ত হয়ে রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠ আমেরিকান ম্যানুফ্যাকচারার অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা ট্রাম্পের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে আহ্বান জানিয়েছিলেন ট্রাম্পকে সংবিধানের ২৫তম সংশোধনী ব্যবহার করে ক্ষমতাচ্যুত করতে। প্রতিনিধি পরিষদে ট্রাম্পের অভিশংসনের পক্ষে বেশ কয়েকজন রিপাবলিকান নেতা ভোট দিয়েছেন। সিনেটে অভিশংসনের অনুমোদনের সময়ও বেশ কয়েকজন রিপাবলিকান সিনেটর ট্রাম্পের অভিশংসনের পক্ষে ভোট দিবেন বলে আলোচিত হচ্ছে।

আশার পাশাপাশি হতাশারও কারণ রয়েছে। ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাইডেনের দ্বিতীয় মেয়াদেই মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষত সিরিয়ায় উগ্রপন্থা ও জঙ্গিবাদের উত্থান ও চূড়ান্ত বিকাশ হয়েছিল। ওই সংকটের পেছনে প্রেসিডেন্ট ওবামার সঙ্গে বাইডেনের ভূমিকা নিয়ে বিতর্কও কম হয়নি। বাইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে নিয়োগ পেয়েছেন অ্যান্টনি ব্লিংকেন। ব্লিংকেন ওবামা আমলে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক সমন্বয়ক হিসেবে বাইডেন ব্রেট ম্যাকগার্কেরকে নিয়োগ দিয়েছেন। সিরিয়া ভেঙে যে তিন-চারটি নতুন রাষ্ট্রের চিত্র অঙ্কন করা হচ্ছে, তা অনেকটাই ম্যাকগার্কের চিন্তাপ্রসূত বলে মনে করা হয়। বাইডেনের পররাষ্ট্র দফতরে জন কেরি, অ্যান্টনি ব্লিংকেন, ব্রেট ম্যাকগার্ক এবং জেইক সুলিভ্যানের প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে আবার যুদ্ধের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি ইয়েমেন, সিরিয়া গৃহযুদ্ধের সমাপ্তির সম্ভাবনা হ্রাস পেয়েছে। লিবিয়াকে দ্বিখণ্ডিত করার পরিকল্পনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ফিলিস্তিনিদের মাতৃভূমি থেকে উৎখাত করে ইসরায়েলের অবৈধ বসতি স্থাপন অব্যাহত থাকবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। সংঘর্ষ জিইয়ে রাখার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের প্রাকৃতিক সম্পদ এবং ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার গতানুগতিক মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতেই বাইডেন ফিরে যাবেন বলে মনে করা হচ্ছে। ট্রাম্প হোয়াইট হাউজ ছেড়ে গেলেও ট্রাম্পিজমের কালো ছায়া ও বিদ্বেষের বিষে পুরো আমেরিকা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়ে গেছে। অর্ধেকের বেশি রিপাবলিকান সিনেটর এবং প্রতিনিধিরা বলেছেন, সুযোগ থাকলে তারা আবারও ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনয়ন দেবেন। বাইডেনের শপথ অনুষ্ঠানকে ঘিরে কড়া নিরাপত্তার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্য থেকে ওয়াশিংটন পর্যন্ত সমাবেশ করেছে ট্রাম্পের সমর্থকেরা। তারা যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি নগরীতে সশস্ত্র মহড়া দিয়েছে। ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে ট্রাম্প বিধ্বস্ত হলেও জনপ্রিয় ভোটে ট্রাম্প বাইডেনের সঙ্গে প্রায় সমানে তালে লড়েছেন। শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদীদের কাছে ট্রাম্প ‘ঈশ্বরতুল্য’।

ক্যাপিটল হিলে আক্রমণকারীদের কাছে বর্ণবাদী কনফেডারেট ফ্ল্যাগ দেখা গেছে। গৃহযুদ্ধের সময় থেকেই এই পতাকার বিরুদ্ধে ক্ষোভ রয়েছে। অভিযোগ, এই পতাকা বর্ণবাদী। বস্তুত, শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য কায়েম করতে বহু সময়েই এই পতাকা ব্যবহার করা হয়েছে। এখনও বর্ণবাদীরা এই পতাকাটিকে সিম্বল হিসেবে ব্যবহার করেন। দীর্ঘদিন ধরে এই পতাকাটি বাতিলের দাবি উঠলেও ট্রাম্পপন্থীরা তা প্রদর্শন করে যুদ্ধের ইঙ্গিত দিয়েছে বৈকি। আমেরিকায় সাদা-কালো বিভাজনের পাশাপাশি সাদাদের নিজেদের মধ্যেও এলিট ও শ্রমজীবী শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে সুস্পষ্ট বিভাজন রয়েছে। জো বাইডেন এলিট ক্লাসের লোক। তিনি সংখ্যায় অধিক শ্রমজীবীদের স্বার্থরক্ষায় এলিটদের বাধার সম্মুখীন হবেন সন্দেহ নেই। যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত কালো মানুষদের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা করা না গেলে গণতন্ত্রের রাজনৈতিক দিক যতই ঝলমলে হোক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক গণতন্ত্র তিমিরেই থেকে যাবে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি গণতন্ত্রের দায়বদ্ধতার সৌন্দর্য কেবলই বইয়ের পাতায় সীমিত থাকবে। এছাড়াও ইহুদি লবি ও অস্ত্র ব্যবসায়ী কার্টেলের মতো শক্তিশালী স্তম্ভের সঙ্গে যুদ্ধ করে জেতা বাইডেন প্রশাসনের জন্য বড় সমস্যা হবে। বাইডেনের অভিবাসন নীতি সংস্কারের ঘোষণার সাথে সাথে হন্ডুরাস থেকে হাজার হাজার লোকের কাফেলা যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ছুটে আসছে। ট্রাম্প সমর্থক অভিবাসী বিরোধীরা এটিকে বাইডেনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে। অন্যদিকে, মুসলিম বিদ্বেষ জাগিয়ে তুলতে ট্রাম্প ও তার সমর্থকরা বসে থাকবে না। সব মিলিয়ে একটি অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতেই কাজ করতে হবে বাইডেনকে।

ক্ষতিগ্রস্ত গণতন্ত্র মেরামত ও আমেরিকার জনগণের প্রচণ্ড বিভাজনকে হ্রাস করতে ও উগ্রবাদী ট্রাম্পিজমকে পরাহত করতে হলে কিছু সময়ের জন্য হলেও উদারবাদী গণতন্ত্রের পরিবর্তে কর্তৃত্ববাদী গণতন্ত্র চর্চা করতে হবে বাইডেনকে। বিদ্বেষের রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে ট্রাম্পকে অপসারণ করতে হলে অভিশংসনে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের এক প্লাটফর্মে আসতে হবে।
বহির্বিশ্বের সঙ্গে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষেত্রে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘বাইডেনিজম’ অতীতের চেয়ে অনেক মানবিক হতে হবে। অন্যথায়, মেয়াদ শেষে অতীতের মতো ‘যুদ্ধবাজ’ তকমা নিয়েই হোয়াইট হাউজ ছাড়তে হবে বাইডেনকে। ‘ট্রাম্পিজম’কে হারিয়ে ‘বাইডেনিজম’ কতটা জয়ী হবে তা জানতে আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ