X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

এত ভয়, তবু টিকা নয়- কেন?

রুমিন ফারহানা
২৯ জানুয়ারি ২০২১, ১৬:০১আপডেট : ২৯ জানুয়ারি ২০২১, ১৬:০১

রুমিন ফারহানা ২০২০ সালটি ছিল ভয়, আতঙ্ক, অসহায়তা আর স্বজন হারানোর বেদনার। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বই পার করেছে এক বীভৎস সময়। এই পুরো বছরটি পল, অনুপল মানুষ গুনেছে টিকা উদ্ভাবনের অপেক্ষায়। অবশেষে এসেছে সেই বহুল প্রতীক্ষিত টিকা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, মানুষের মধ্যে টিকা নেওয়ার আগ্রহের চেয়ে আতঙ্কই কাজ করছে বেশি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের এক জরিপে দেখা যায়, এখনই পেলে টিকা নেবেন ৩২ শতাংশ। অপেক্ষার পর নিতে চান আরও ৫২ শতাংশ। আর কখনোই টিকা নেবেন না ১৬ শতাংশ মানুষ। অর্থাৎ করোনার আতঙ্ক আর ভয়াবহতার পরও অধিকাংশ মানুষই চায় আরও কিছু সময় পর্যবেক্ষণ করতে, দেখতে এবং যাচাই করতে।

করোনায় এই এক বছরে সারা বিশ্বে আক্রান্ত হয়েছে ১০ কোটির বেশি মানুষ আর মারা গেছে প্রায় ২২ লাখ। বাংলাদেশে যেহেতু শুরু থেকেই পুরো বিষয়টি নিয়ে সরকারের তরফে এক ধরনের লুকোছাপা আর ঢিলেঢালা ভাব আমরা লক্ষ করেছি, সে কারণেই এখানে ঠিক কতজন মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন বা মারা গেছেন, তার কোনও সঠিক পরিসংখ্যান সরকারের কাছে আছে বলেও মানুষ মনে করে না।

২০২০ সালের মার্চে প্রথম যখন বাংলাদেশে করোনা রোগী ধরা পড়ে তখন থেকেই সরকারের বিভিন্ন প্রভাবশালী মন্ত্রীদের আমরা শুনেছি করোনাকে তুচ্ছ করে কথা বলতে। কেউ বলেছেন আমরা করোনার চেয়ে বেশি শক্তিশালী, কেউ বলেছেন করোনা সর্দি-কাশির চেয়ে বেশি সিরিয়াস কিছু নয়। আবার কেউ কেউ দাবি করেছেন উন্নত বিশ্বের চেয়েও আমাদের করোনা মোকাবিলার প্রস্তুতি ভালো। পরে যখন করোনা সত্যিই এলো, দেখা গেলো, বন্দরের থার্মাল ডিটেক্টর থেকে শুরু করে হাসপাতালের বেড পর্যন্ত কেবলই দুর্নীতি, অদক্ষতা আর অব্যবস্থাপনা। এমনকি সম্ভবত পৃথিবীতে একমাত্র দেশ আমরা, যেখানে করোনা টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট বিক্রি হয়েছে। দুই একটি ক্ষেত্রে সরকার কিছু চেষ্টা করলেও এই সেক্টরের মূল অপরাধীরা রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে লোক দেখানো কোনও ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি। লকডাউনের নামে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে পুরো বিষয়টিকে মানুষের কাছে খেলো করে দেওয়া হয়েছিল।

সরকারের অনেক অদ্ভুত সিদ্ধান্তের মধ্যে একটি ছিল কেবল সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে আর সবকিছু খুলে দেওয়া। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছিল করোনা বুঝি কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই আছে। অথচ বাস্তবতা হলো করোনা শিশু-কিশোর-তরুণদের তুলনায় বয়স্ক এবং কো-মর্বিডিটি থাকা মানুষদের জন্য অনেক বেশি বিপজ্জনক।

দেশে গত ১ দশকের বেশি সময় ক্ষমতায় আওয়ামে লীগ থাকলেও যাবতীয় সব সমস্যার জন্য দায়ী হচ্ছে বিএনপি– সব ক্ষেত্রে সরকারি দলের ক্রমাগত এই প্রপাগান্ডা থেমে ছিল না টিকার ক্ষেত্রেও। সরকারি দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতারা বলেছেন, টিকা নিয়ে বিএনপি অপপ্রচার করেছে বলেই নাকি মানুষের মধ্যে টিকা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। বিএনপির তথাকথিত অপপ্রচার নাকি এতটাই শক্তিশালী হয়েছে যে তাতে জনগণকে বিভ্রান্ত না হতে আহ্বান জানিয়েছেন স্বয়ং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। এদের এসব উদ্ভট কথা সরিয়ে রেখে দেখা যাক টিকা নিতে মানুষ কেন অনীহ।

প্রথমত, সরকারের প্রতি মানুষের আছে চরম আস্থার সংকট। দীর্ঘ এক যুগ ক্ষমতায় থাকাকালীন সরকার জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেনি কোনোদিন বরং ক্রমাগত কমতে কমতে সেটা এখন একেবারেই তলানিতে। অবশ্য মানুষকে আস্থায় নিতে সরকার কখনও চেষ্টাও করেনি তেমন আর একটা সময়ের পরতো মানুষ অপ্রয়োজনীয়ই হয়ে ওঠে সরকারের কাছে। তার ওপরে করোনার সময়ে সব ক্ষেত্রে সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতা, নানা রকম তথ্য বিভ্রান্তি, দুর্নীতির খবর, অব্যবস্থাপনা, টেস্ট থেকে শুরু করে হাসপাতালের বেড পর্যন্ত স্তরে স্তরে মানুষের ভোগান্তি মানুষকে করোনার ব্যাপারে সরকারের প্রতি একেবারেই আস্থাহীন করে তুলেছে। সরকার যা বলে, মানুষ এখন তার উল্টোটাকেই সঠিক বলে ধরে নেয়। তাই সরকার যখন টিকা নিতে বলে গুরুত্ব দিয়ে, তখন সেটা মানুষের কাছে অর্থহীন হয়ে থাকে।

দ্বিতীয়ত, শুরু থেকেই করোনাকে সরকার মানুষের সামনে একেবারেই তুচ্ছ করে তুলেছে। তথাকথিত উন্নয়ন নিয়ে গর্ব করা সরকারটি আর্থিকভাবে যে কতটা ভঙ্গুর সেটা দেখা গেলো করোনার সময়ে। করোনাকে গুরুত্ব দিয়ে শুরুতে কঠোর লকডাউন এবং পরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রিত রাখার মাধ্যমে করোনা মোকাবিলা করতে গেলে প্রান্তিক মানুষকে ভরণপোষণ দিতে হয়। সরকার ন্যূনতম সেই কাজটি করতে চায়নি, তাই তারা সবকিছু খুলে দিয়েছে তথাকথিত সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে। অথচ স্বাস্থ্যবিধি দূরেই থাকুক, মানুষকে ন্যূনতম মাস্ক পরাতে পারেনি সরকার। ফলে মানুষ ধরেই নিয়েছে করোনা আদতে বড় কোনও সমস্যা নয়।

তৃতীয়ত, সরকারের ডেটা ম্যানিপুলেশন। সবকিছু খুলে দেওয়ার বয়ান তৈরি করার জন্য সরকারকে দেখাতে হয়েছে দেশে করোনার সংক্রমণ খুব নিয়ন্ত্রিত আছে। ফলে টেস্ট করা হয়েছে খুবই কম। প্রতি দশ লক্ষ মানুষপ্রতি পাকিস্তান, নেপাল, ভারত টেস্ট করছে যথাক্রমে ৩৩ হাজার, ৬২ হাজার আর ১ লক্ষ ২০ হাজার। আর বাংলাদেশ করছে মাত্র ২১ হাজার। একদিকে টেস্টের হার কম, অপরদিকে ডেটা ম্যানিপুলেট করে শনাক্ত দেখানোর হারও খুবই কম; এই মুহূর্তে শনাক্তকরণের হার ৫ শতাংশের নিচে। এখন মানুষ যদি মনে করে এই সামান্য রোগের জন্য টিকা নিতে হবে কেন, তাহলে মানুষকে কি দোষ দেওয়া যায়?

চতুর্থত, টিকা নিয়ে মানুষের ভীতি দূর করার চেষ্টার অভাব। বিএনপির পক্ষ থেকে এই ব্যাপারে আন্তরিক পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল– প্রধানমন্ত্রী আর রাষ্ট্রপতি সবার আগে টিকা নিলে সেটা জনগণের সংশয় দূর করবে। রানি এলিজাবেথ, প্রিন্স ফিলিপ, জো বাইডেন, কমলা হ্যারিস, বাদশাহ সালমান, মোহাম্মদ বিন সালমান, বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুসহ অনেক বিশ্বনেতা টিকা নিয়ে জনগণের সংশয় দূর করেছেন।

পঞ্চমত, প্রচারণার অভাব। যেকোনও নতুন জিনিস সম্পর্কে মানুষকে জানাতে, সচেতনতা বাড়াতে, রিস্ক ফ্যাক্টর বোঝাতে প্রচারণার কোনও বিকল্প নেই। এই টিকা শুধু নতুনই নয়, এটা নিয়ে মানুষের মধ্যে সংশয় এবং ভীতি কাজ করছে, তাই এক্ষেত্রে প্রচারণা হওয়ার প্রয়োজন ছিল আরও অনেক বেশি। সম্প্রতি একটি রিপোর্টে দেখা যায়, টিকা দেওয়ার কার্যক্রম শুরু করার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি প্রকল্পে প্রচার-প্রচারণা খাতের বরাদ্দ পুরো বাদ দিয়ে দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বাদ দেওয়া হয়েছে ডাটাবেইস তৈরি, টিকা পরবর্তী পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার বাজেট। এমনকি সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খলভাবে টিকা দেওয়ার কাজে যে ৪২ হাজার স্বেচ্ছাসেবক ও কর্মীকে প্রস্তুত করা হয়েছে, তাদের আপ্যায়নের জন্যও কোনও বরাদ্দ দেওয়া হয়নি।

মাসের পর নানা ভুল পদক্ষেপের মাধ্যমে করোনার মতো ভয়ংকর একটা ব্যাপারকে এই দেশে স্রেফ ছেলেখেলায় পরিণত করা হয়েছে। এর অবশ্যম্ভাবী ফল হচ্ছে টিকার প্রতি মানুষের অনীহা। এটা দূর হবে, এমন পরিস্থিতিও দেখা যাচ্ছে না। সার্বিক পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে মানুষকে টিকা নিতে বাধ্য করা হবে– নানা ক্ষেত্রে ভ্যাকসিনেশন সার্টিফিকেট চাওয়ার মাধ্যমে।

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে বিএনপির দলীয় সংসদ সদস্য

 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ