X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্ববিদ্যালয়ের এমফিল-পিএইচডি থিসিস কতটা মৌলিক?

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
৩১ জানুয়ারি ২০২১, ১৮:৪৭আপডেট : ৩১ জানুয়ারি ২০২১, ১৮:৫১

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার সম্প্রতি গবেষণায় চুরির অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষকের পদাবনমনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ নতুন নয়। ইতিপূর্বেও ওই অভিযোগে অনেক শিক্ষকের শাস্তি হয়েছে। অনেকে হয়েছেন চাকরিচ্যুত। কিন্তু এরপরও থেমে নেই গবেষণায় জালিয়াতি ও চুরির ঘটনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও অন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন গবেষণা চুরি ও শাস্তির ঘটনা প্রায় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। তাই প্রশ্ন হচ্ছে, শাস্তি হওয়া সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এমন গর্হিত অপকর্ম থেকে বিরত রাখতে পারছেন না কেন সেই বিষয়ে এখন নতুন গবেষণা দরকার।

গবেষণার কপি-পেস্টের বাইরে আরও একটি গোপন চুরির ঘটনা ঘটে। সেটি হচ্ছে, একজনের গবেষণাপত্র অন্যজনের লিখে দেওয়া। আমার পরিচিত অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের বিরুদ্ধেই এমন অভিযোগ রয়েছে। অনেক স্বামী তার স্ত্রীর গবেষণাপত্র লিখে দিয়েছেন। অনেক স্ত্রী তার স্বামীর গবেষণাপত্র লিখে দিয়েছেন। আবার অনেকে শিক্ষার্থীদের দিয়েও তার পিএইচডি থিসিস লিখে নিয়েছেন। এছাড়া অনেকের গবেষণাপত্র তারা অর্থের বিনিময়ে লিখে নিয়েছেন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অগোচরে অতি গোপনে হলেও এমন একটি চক্র রয়েছে, যারা অতি সংগোপনে অর্থের বিনিময়ে এই কাজটি করছেন। নীলক্ষেতের এমন বেশ কিছু চক্র রয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ গবেষণা সংস্থাও পরিচালনা করে, যার প্রকাশ্য উদ্দেশ্য বিভিন্ন সেমিনার সিম্পোজিয়াম আয়োজন হলেও তারা মূলত অর্থের বিনিময়ে অন্যের গবেষণাপত্র লিখে দেয়। আর ওই গবেষণাপত্র লিখে দেওয়ার জন্য তাদের একটি গবেষণা সেলও রয়েছে। সেমিনার সিম্পোজিয়াম আয়োজনের উদ্দেশ্য হলো গবেষণায় আগ্রহী তরুণদের সহজে খুঁজে বের করা। কারণ, নতুন কিছু শেখার নিয়তে গবেষণা মনস্ক তরুণরাই ওইসব সেমিনার সিম্পোজিয়ামে ভিড় করেন। ফলে ওই চক্র খুব সহজেই গবেষণায় আগ্রহী তরুণদের খুঁজে পায় ওই সেমিনার সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে। এভাবে তরুণদের সাথে সুসম্পর্কও গড়ে ওঠে। ফলে পরবর্তী সময়ে ওই চক্র তরুণদের অর্থের বিনিময়ে গবেষণাপত্র সরবরাহ করার প্রস্তাব দেয়। অনেক তরুণই না বুঝে ওই চক্রের ফাঁদে পা দেয়। গবেষণা জীবনের শুরুতে এমন সহজলভ্য গবেষণাপত্র পাওয়ায় তাদের মধ্যে গবেষণার আগ্রহ হারিয়ে যায়। ফলে বাংলাদেশ হারিয়ে ফেলে সম্ভাবনাময় গবেষক মনস্ক তরুণদের। তাই এসব ‘গবেষণা সংস্থা’র মতো আরও যে সব সংস্থায় এই ধরনের গোপন ও সূক্ষ্ম অপরাধের সঙ্গে জড়িত, সরকারের উচিত সেগুলো নজরদারি করা। বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত গবেষণা প্রতিষ্ঠানের আয়ের উৎস এবং ওই প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের আয়-ব্যয়ের হিসাব আমলে নিলে খুব সহজে বিষয়টি ধরা পড়বে বলে আমরা মনে করি।

এছাড়া নীলক্ষেতের কম্পিউটার দোকানে বিভিন্ন গবেষণাপত্রের সফট কপি সংরক্ষণ করা আছে বলে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা ওইসব দোকান থেকে সস্তায় গবেষণাপত্র কিনে গবেষণা জীবনের শুরুতেই অপরাধে জড়িয়ে না পড়ে তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এদিকেও নজর প্রদান করতে হবে। তবে শুধু নজরদারি করলে হবে না, বরং শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। অনেক বিভাগে বাধ্যতামূলক থিসিস করার যে নিয়ম আছে তা বন্ধ করতে হবে। বরং যেসব শিক্ষার্থী কেবল প্রকৃতপক্ষে গবেষণা শিখতে চায় তাদেরই যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে গবেষণার আর্থিক প্রণোদনাসহ গবেষণার উপযুক্ত সুযোগ প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। আর এমনটি নিশ্চিত করা গেলে গবেষণাপত্র বিক্রির রমরমা ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। তখন তরুণরা নিজেরাই গবেষণায় নিযুক্ত হয়ে গবেষণাপত্র লিখতে আগ্রহী হবে। আর গবেষণাপত্র বিক্রির রমরমা ব্যবসা বন্ধ হলেই অন্য চুরির কানাগলিও বন্ধ হয়ে যাবে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকলের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে ভাববেন এমনটিই আমাদের দাবি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ২০১৪ সালের তথ্য অনুযায়ী তখন এমন ভুয়া পিএইচডি সনদধারী ছিল ৫ হাজারের মতো। ওই সব ব্যক্তিরা যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন সেসব প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নেই বলে তাদের ওই সব ডিগ্রিকে ভুয়া হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু গবেষণার সংকট সেখানে নয়। কারণ, অনুমোদন না থাকার কারণে ডিগ্রি ভুয়া হলেও ওইসব পিএইচডির জন্য উপস্থাপিত গবেষণাপত্র মৌলিক হতে পারে। গবেষণার ক্ষেত্রে মূল প্রশ্ন এই মৌলিকত্ব। অনেক সময় দেখা যায় যে, অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান থেকে পিএইচডি করার পরও ওই গবেষণা মৌলিক নাও হতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক শাস্তির ঘটনা তার বড় প্রমাণ। অনেক সময় চুরি ও জালিয়াতি নির্ভর গবেষণাপত্র জমা দিয়ে পিএইচডি অর্জন করা সম্ভব হয়। রাজনৈতিক কারণে ও ব্যক্তিগত দ্বেষ-বিদ্বেষের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক সময় ওইসব জালিয়াতি ও চুরির ঘটনা জনসম্মুখে প্রকাশিত হচ্ছে। অভিযুক্তরা শাস্তি পাচ্ছেন। কিন্তু এমন অনেকে আছেন যারা রাজনৈতিক বিরোধ ও ব্যক্তিগত দ্বেষ বিদ্বেষকে কৌশলে সামলে নিজের ওই অপকর্মকে অদ্যাবধি ঢেকে রাখতে পেরেছেন। নিজের গবেষণা কাজ করার প্রয়োজনে মানবিক ও সামাজিক বিদ্যার অনেক থিসিস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার থেকে পড়ার সুবাদে এটুকু উপলব্ধি হয়েছে, অনেক গবেষণাপত্রই কেবল তথ্য বা ডাটার কমপাইলেশন বা সংকলন।

অনেক বই বা তথ্যসূত্র থেকে তথ্য নিয়ে এগুলো লেখা হয়েছে। প্রায় প্রতিটি লাইনের শেষে তথ্যসূত্র দিয়ে ওই গবেষণাপত্র তার রেফারেন্সিং নিশ্চিত করলেও ওই গবেষণাপত্রে মৌলিক কোনও অবদান নেই। বিষয় ভেদে একটি গবেষণায় কমপক্ষে ৪০-৬০ ভাগ মৌলিকত্ব না থাকলে সেটি গবেষণাপত্রের মর্যাদা পায় না। এক্ষেত্রে গবেষক না বলে উক্ত লেখককে তথ্য সংগ্রাহক বলা যেতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন অনেক পিএইচডি ডিগ্রি অথবা এমফিল ডিগ্রিধারীর গবেষণাপত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, তারা কেবল তথ্য সংগ্রাহকই ছিলেন। কিন্তু তথ্য সংগ্রাহক হয়েও গবেষণার জন্য এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন।

প্রায়শই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রির চুরি ও জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ায় এবং গবেষকরা শাস্তি পাওয়ায় এই প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত অন্য এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রির জন্য জমা দেওয়া থিসিসগুলোর কী অবস্থা? ওই থিসিসগুলোর মধ্যেও আর কোনও থিসিসে চুরি ও জালিয়াতির ঘটনা ঘটেনি তার নিশ্চয়তা কতটুকু? তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত হবে এই প্রতিষ্ঠান থেকে গত এক দশকে পিএইচডি, এমফিল ডিগ্রি যারা নিয়েছেন তাদের সবার গবেষণাপত্র যাচাই করা। আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের গবেষক তৈরির জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত পিএইচডি ও এমফিল গবেষণার গত এক দশকের সব গবেষণাপত্র যাচাই-বাছাই করার দাবি উত্থাপন করছি।

এক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য বিশ্ববিদ্যালয় যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করে গবেষণা পত্রগুলো যাচাই করলে জাতি আশ্বস্ত হবে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গবেষণার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে শুধু গবেষণা চুরি বা জালিয়াতির ঘটনার যাচাই নয়, পাশাপাশি প্রদত্ত গবেষণার মানও যাচাই করে একে এ, বি, সি, ডি ক্যাটাগরি করা দরকার। এর মাধ্যমে বোঝা যাবে যে, একটি গবেষণাপত্র কতটুকু মৌলিক অবদান রেখেছে। আর এর মাধ্যমে তরুণ গবেষকরা তাদের পূর্ববর্তীদের ভুলত্রুটি থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন নতুন গবেষণায় অবদান রাখতে পারবেন।

পরিশেষে, গবেষণা চুরি ও জালিয়াতির ঘটনায় শাস্তি স্থায়ী কোনও সমাধান নয়। গবেষণাপত্র জমা দিয়ে ডিগ্রি অর্জনের কয়েক বছর পর চুরি ও জালিয়াতির ঘটনায় শাস্তি নিশ্চিত করার মধ্যেও কোনও কৃতিত্ব নেই। বরং পূর্বেই এমন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে যাতে শিক্ষার্থী ও গবেষকরা এমন কাজ থেকে বিরত থাকেন। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার উপযুক্ত পরিবেশ, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও গবেষণার উপযুক্ত বাজেট নিশ্চিত করলে এই সমস্যার সমাধান হবে বলে আমরা মনে করি।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিদ্যুৎ ও গ্যাস কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র ছাড়া ঋণ মিলবে না
বিদ্যুৎ ও গ্যাস কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র ছাড়া ঋণ মিলবে না
ওমরা পালনে সৌদি গেলেন পাটমন্ত্রী
ওমরা পালনে সৌদি গেলেন পাটমন্ত্রী
গাজায় আবিষ্কৃত গণকবরের স্বচ্ছ তদন্ত দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্র
গাজায় আবিষ্কৃত গণকবরের স্বচ্ছ তদন্ত দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্র
খুলনায় এ যাবতকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এ যাবতকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ