X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

পৈতৃক সম্পত্তিতে মুসলিম নারীর অধিকার ও ভোগদখল

মো. রহমত উল্লাহ্
০১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৮:৫৭আপডেট : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৮:৫৮

মো. রহমত উল্লাহ্ ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় বিধান থাকা সত্ত্বেও পৈতৃক সম্পত্তিতে মুসলিম নারীর অধিকার অধিকাংশ ক্ষেত্রে  অনর্জিতই থেকে যায় আমাদের দেশে। এর নানাবিধ কারণের মধ্যে সচেতনতার অভাবই প্রধান। ইসলাম ধর্ম মতে পিতামাতার অবর্তমানে তাদের স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তিতে মেয়ের অধিকার হিসাব করেই দেওয়া আছে। যদিও এটি ভাইয়ের প্রাপ্যাংশের তুলনায় অর্ধেক। অবশ্য পিতামাতা ইচ্ছে করলে তাঁদের সম্পত্তি ছেলেমেয়েকে সমান হারেও ভাগ করে দিতে পারেন। এতে ইসলাম ধর্মে কঠিন নিষেধ নেই। নতুন কোনও আইনেরও প্রয়োজন নেই। পরিমাণ যাই হোক মূল প্রশ্ন হচ্ছে, এই অধিকারটুকু আমাদের মুসলিম নারীরা অর্জন ও ভোগদখল করতে পারছেন কিনা? যদি কেউ পেরে থাকেন তো মোটের তুলনায় এটি খুবই নগণ্য।

আমাদের সমাজে এমন একটি ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত যে, ‘বাপের বাড়ির সম্পত্তির অংশ মেয়েরা নিয়ে নিলে স্বামীর সংসারে অনটন নেমে আসে এবং ভাইদের সাথে বোনদের সম্পর্কের কোনও সেতুবন্ধন থাকে না। বোনেরা ভাইদের বাড়িতে এবং ছেলেমেয়েরা মামার বাড়িতে যাবার বা আপ্যায়ন পাবার যোগ্যতা হারায়।’

আসল কথা হচ্ছে, মেয়েদের স্থায়ীভাবে ঠকানোর এটি একটি চতুর কৌশল ছাড়া আর কিছুই না। ভাইয়েরা পৈতৃক সম্পত্তি ভাগাভাগি (বোনদের অংশসহ) করে ভোগ-দখল করলে যদি অভিশপ্ত না হয়, সম্পর্ক অবনতি না হয়, পরস্পরের বংশধরদের আপ্যায়ন পাওয়ার অধিকার থাকে, পরস্পরের সুখে-দুঃখে এগিয়ে যাওয়ার মানসিকতা থাকে, তো বোনদের অপরাধ কোথায়? বোনের প্রাপ্য সম্পত্তি ভাই ভোগদখল করবে সারা জীবন, ফুফুর সম্পত্তি ভাইপো ভোগদখল করবে জোর করে; তাতে অপরাধ হবে না– অথচ পিতামাতার সম্পত্তির বৈধ প্রাপ্যাংশ কন্যা ভোগদখল করলেই ‘অভিশপ্ত’ হবে– এটা কোন নীতি-ধর্মের কথা?

ইসলাম ধর্মে ও আমাদের রাষ্ট্রীয় আইনে অন্যের প্রাপ্য সম্পত্তি ভোগদখল করার কোনও বৈধতা নেই। বরং কাউকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করা পাপ, অপরাধ। নারী তো ভাইয়ের সম্পত্তি পায় না, পিতামাতার সম্পত্তি পায়। এতে ভাইয়ের রাগ করার, ‘অভিশাপ’ দেওয়ার বৈধতা ও যৌক্তিকতা কোথায়? ভাইকে প্রাপ্যাংশ দিতে কষ্ট না থাকলে, বোনকে দিতে এত কষ্ট কেন?

অবাক ব্যাপার, যে বাবা মেয়েকে বেশি আদর দেখায়, পুত্র-পুত্রবধূ রেখেও মেয়ের সেবা-যত্ন প্রত্যাশা করে মৃত্যু শয্যায়; সে বাবাই তার সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি অনেক সময় কূটকৌশলে ছেলের দখলে দিয়ে মরে যায়। এমন অনেকেই আছেন, ধর্মীয় সকল নিয়ম-কানুন মেনে চলেন কিন্তু নিজের মেয়ে সন্তানদের বঞ্চিত করে ভালো মানুষ সাজেন!

মেয়েদের বঞ্চিত করে ছেলেদের নামে মূল্যবান জমি-বাড়ি দলিল করে দখল দিয়ে যান এমন নীতি-আদর্শহীন বাবার সংখ্যাও আমাদের সমাজে কম নয়। যে ভাইয়ের জন্য সবার আগে নির্দ্বিধায় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এমনকি প্রাণও দিতে পারে বোন; সেই ভাই-ই বোনের প্রাপ্যাংশ না দেওয়ার জন্য বা কম দেওয়ার জন্যে আঁটে নানান কূটকৌশল। কেউ কেউ বছরে দু-একটা দাওয়াত ও কাপড়চোপড় দিয়েই সারতে চায় বোনের প্রাপ্য সম্পত্তি না দেওয়ার দায়। কোনও অধিকার সচেতন বোন তার প্রাপ্যাংশের দাবিতে সোচ্চার হলে, বিচারপ্রার্থী হলে, আদালতের আশ্রয় নিলে, ভাই ধর্মীয় পোশাক পরে ভালো মানুষ সেজে হাজির হয় বিচারকের সামনে। কোনও অসতর্ক, অসুস্থতা বা বিপদের সময় বাবার, মায়ের, বোনের স্বাক্ষর/টিপসই নিয়ে বোনকে অধিকার বঞ্চিত করে বা করার চেষ্টা করে, এমন ভাইয়ের সংখ্যাও অনেক। এমন ভাইকেও বলা হয় আপন ভাই!

সাধারণত ধনী পরিবারের কন্যার সঙ্গে ধনী পরিবারের পুত্রেরই বিয়ে। এটা আমাদের সমাজে বেশি হয়। সেসব বিয়েতে বিয়ের দেনমোহরও ধার্য হয় তুলনামূলক বেশি। অথচ ধনী পিতার সম্পত্তির প্রাপ্যাংশ যদি ওই মেয়ে ও তার সন্তানেরা না-ই পায়, তো তাকে অধিক মূল্যায়নের ভিত্তি কোথায়?

যুগ যুগ ধরে পুত্রসন্তানের ভোগদখলে দিয়ে রাখে সব সম্পত্তি। সেই মেয়ে কখনও সম্পত্তির অধিকার চাইতে গেলে বলা হয়, তোমাকে লালন-পালন করা হয়েছে, লেখাপড়া করানো হয়েছে, বিয়ে দেওয়া হয়েছে, আবার সম্পত্তি দেবো কেন!

কী অদ্ভুত কথা! যে ছেলেকে হয়তো মেয়ের চেয়ে ভালোভাবে লালন-পালন করা হয়েছে, অধিক লেখাপড়া করানো হয়েছে, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে, অধিক ব্যয় করে বিয়েশাদি করানো হয়েছে; সেই ছেলের ভোগদখলেই থাকবে সব সম্পত্তি!

বাস্তবে আমাদের অনেক মুসলিম নারী স্বামীর সম্পত্তিতে নিজের নাম লেখানোর ও ভোগ-দখল করার জন্য যতটুকু সংগ্রাম ও অশান্তি করে, পৈতৃক সম্পত্তিতে নিজের নাম জন্মসূত্রে লেখা থাকলেও সেটি ভোগদখল করার জন্য ততটুকু সংগ্রাম করে না। বিভিন্ন যৌক্তিক, অযৌক্তিক ও ভ্রান্ত ধারণার কারণে পৈতৃক সম্পত্তি গ্রহণ ও ভোগদখল না করে উদারতা দেখালেও, নিঃশর্তে দলিল করে ভাইকে দিয়ে দেয় এমন নারীর সংখ্যা নেই বললেই চলে। অর্থাৎ নারীরা তার রক্তের অধিকার পৈতৃক সম্পত্তির দাবি সত্যিকার অর্থে মন থেকে ত্যাগ করতে পারে না, করে না কোনোদিনই। দাবি অব্যাহত রেখেই মৃত্যুবরণ করে। এই দাবির দাবিদার হয় তার সন্তানেরা। দাবি আদায় করতে গেলেই হয় বিবাদ।

কোনও নারী যদি মনে করে তার পিতামাতার নিকট থেকে প্রাপ্যাংশ ভাইকে বা ভাইয়ের সন্তানদের দিয়ে দেবেন, তো এটি মনে রাখা উচিত যে তার এই প্রাপ্য সম্পত্তির ওপর নিজের সন্তানের অধিকার ও দাবিই অগ্রগণ্য। নিজের সন্তানকে বঞ্চিত করে ভাই, ভাইয়ের সন্তানকে সম্পত্তি দেওয়া অনুচিত। ভাইয়ের অভাবের কারণে দিতে হলেও নিজের স্বামী-সন্তানের মতামত নেওয়া প্রয়োজন।

পৈতৃক সম্পত্তিতে নারীর অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হলে যাদের অবৈধ স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে, তাদের গা জ্বালা হওয়া স্বাভাবিক। এর বিপক্ষে তারা যতই যুক্তি খোঁজুক, ফন্দি আঁটুক, পৈতৃক সম্পত্তির (স্থাবর-অস্থাবর) ওপর নারীর এই জন্মগত অধিকার অর্জন ও ভোগ করার জন্য মনের জোর নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে নারীকেই। নিজের ও নিজের কন্যাসন্তানের ন্যায্য পাওনা বুঝে নিতে ও দিতে হবে যেকোনও মূল্যে।

লেখক: অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা।

Email- [email protected]

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হিট অ্যালার্ট উপেক্ষা করে কাজে নামতে হয় যাদের
হিট অ্যালার্ট উপেক্ষা করে কাজে নামতে হয় যাদের
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজের পাঠদানও বন্ধ
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজের পাঠদানও বন্ধ
রুশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউক্রেনের হামলা, ৫০টি ড্রোন ভূপাতিতের দাবি মস্কোর
রুশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউক্রেনের হামলা, ৫০টি ড্রোন ভূপাতিতের দাবি মস্কোর
বিয়েবাড়ির খাসির মাংস খেয়ে ১৬ জন হাসপাতালে
বিয়েবাড়ির খাসির মাংস খেয়ে ১৬ জন হাসপাতালে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ