X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুন্দরবনে হঠাৎ করে হরিণ শিকার বাড়ছে?

হোদায়েৎ হোসেন, খুলনা 
০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১১:২১আপডেট : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১১:২৯

সুন্দরবনে হরিণ শিকার হঠাৎ করেই উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ১২ শিকারিকে হরিণের মাংস ও চামড়াসহ আটক করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, শিকারিদের ধরতে সুন্দরবনে স্মার্ট প্যাট্রল এবং বন বিভাগের টহল থাকলেও অদৃশ্য কারণে শিকার কমছে না। স্থানীয়দের অভিযোগ, বনবিভাগের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ম্যানেজ করে, আবার কখনও তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে চুরি করে বনে ঢুকে শিকারিরা ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করছে। বিভিন্ন ধরনের সুবিধা নিয়ে শিকারিদের সুযোগ করে দিচ্ছেন কিছু অসাধু বন কর্মকর্তা, পুলিশ ও জনপ্রতিনিধিরাও। তারা শিকারি চক্রের কাছ থেকে হরিণের মাংসসহ আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করায় দিন দিন সুন্দরবনে হরিণ শিকার বাড়ছে।

তবে বন কর্মকর্তারা বলছেন, বন্যপ্রাণী শিকার বাড়েনি। বরং মানুষ সচেতন হওয়ায় এবং পুরস্কারের আশায় শিকার হওয়ার প্রাণী ও শিকারি ধরিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। একারণেই শিকার বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে। সুন্দরবন

জানুয়ারি মাসের শেষ ১০ দিন ও চলতি ফেব্রুয়ারির প্রথম দুই দিনে সুন্দরবন থেকে শিকার করা চারটি মাথা, ১৯টি হরিণের চামড়া, ১২০ কেজি মাংস জব্দ করা হয়। এসময় আটক করা হয় ১২ জন চোরা শিকারিকে। সুন্দরবন বিভাগ, কোস্ট গার্ড ও পুলিশ সদস্যরা এ বন্যপ্রাণীর অংশ বিশেষসহ শিকারিদের আটক করে। বন্যপ্রাণী আইনে আটকদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে।

জানা গেছে, সংঘবদ্ধ চোরা শিকারিরা সুন্দরবনের গহীনে কেওড়া গাছের ফাঁকে ফাঁকে অবস্থান নিয়ে নৌকা, ট্রলার ও গাছে মাচা পেতে হরিণের গতিবিধি লক্ষ্য করে। হরিণ নদী ও খালের চরাঞ্চলে ঘাস খেতে আসে। শিকারিরা এসব স্থানে ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করে। কখনও তারা গুলি ছুড়েও শিকার করে। পরে গোপন আস্তানায় মাংস তৈরি করে সুন্দরবন সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করে।

সুন্দরবন সংলগ্ন মোংলা, শরণখেলা, কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছাসহ বনের আশপাশ এলাকায় সবচেয়ে বেশি হরিণের মাংস পাওয়া যায়। এভাবে হরিণ শিকার করে বিক্রি করতে গিয়ে অনেকে ধরাও পড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। সুন্দরবন (ছবি: মোংলা প্রতিনিধি)

অভিযোগ রয়েছে, বনবিভাগের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ম্যানেজ করে, আবার কখনও তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে চুরি করে বনে ঢুকছে শিকারিরা। ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করে বিভিন্ন কৌশলে এ হরিণের মাংস খুলনা-বাগেরহাট এমনকি ঢাকায় নিয়ে গিয়ে বিক্রি করছে নানা দামে। তবে বেশি দামে বিক্রি হয় চামড়া। আর এভাবে বিক্রি করতে গিয়ে মাঝে মধ্যে পথে ঘাটে ধরা পরে দুই এক জন শিকারি। ধরা পড়া ব্যক্তিদের কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছেড়ে দিয়ে অর্থ বাণিজ্য করছে কিছু অসাধু বন কর্মকর্তা ও পুলিশ। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা ও জনপ্রতিনিধিও এ সব শিকারি চক্রের কাছ থেকে মুনাফা লুটছেন বলে অভিযোগ আছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবন ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে পেশাদার হরিণ শিকারিদের বিশেষ সিন্ডিকেট রয়েছে। তাদের সঙ্গে থাকে এজেন্ট ব্যবসায়ীরা। এ সব এজেন্টের মাধ্যমে কখনও অগ্রিম অর্ডারে, আবার কখনও তাৎক্ষণিকভাবে মাংস এনে বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করা হচ্ছে।

দাকোপ উপজেলার বাণীশান্তা গ্রামের বাসিন্দা আবেদ খান জানান, ‘বনবিভাগের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের খুশি করতে ও তদবির হিসেবে হরিণের মাংস সরবরাহ করে থাকে শিকারিরা। এসব কারণেই প্রধানত লোকালয়ের অনেক লোকই হরিণ শিকারকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। শিকারিদের বনবিভাগের লোকজন চেনে। কিন্তু তাদের কখনও গ্রেফতার করে না।’ সুন্দরবন

বন বিভাগের মতে, বনে ডাকাতরা এখন তুলনামূলকভাবে কম সক্রিয়। কিন্তু হরিণ শিকারিদের চক্রগুলোর উৎপাত সুন্দরবন ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে আবার বেড়েছে। তবে হরিণ নিধন এবং শিকারের বিরুদ্ধে তাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে পাচারকারীদের আটক করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে হরিণের মাংস উদ্ধার করা হয়। পরে তাদের বিরুদ্ধে বন্যপ্রাণী নিধন আইনে মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু কোথাও এই শিকারি চক্রের মূল হোতাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি।

স্থানীয়রা জানায়, কর্তৃপক্ষের কাছে চিহ্নিত হরিণ শিকারি এবং মাংস ব্যবসায়ীদের একটি তালিকা থাকার পরও প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কোনোরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। উল্টো, বন বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনের বেশ কিছু কর্মচারীর সঙ্গে এসব শিকারি চক্রের যোগসাজশের অভিযোগ রয়েছে। দাকোপ উপজেলার অনেক গ্রামে হরিণের মাংস নিয়মিত বিক্রি হচ্ছে এবং এই প্রবণতা বেড়েই চলছে। অনেকেই ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি দরে খুশি মনে হরিণের মাংস কিনছে বলে জানান স্থানীয়রা।

দাকোপ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সেকেন্দার আলী বলেন, ‘হরিণ শিকার ও পাচার রোধে আমরা সব সময় সতর্ক রয়েছি। বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে হরিণের মাংসসহ পাচারকারীদের গ্রেফতার করছি। তবে আগের তুলনায় হরিণ শিকার অনেকটাই কমে এসেছে। এ বিষয়ে জিরো টলারেন্সে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। হরিণ শিকারের মূল হোতাদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান অব্যাহত রেখেছি।’ সুন্দরবন

বাগেরহাটের পুলিশ সুপার (এসপি) পংকজ চন্দ্র রায় বলেন, ‘এর আগে একসঙ্গে এতগুলো হরিণের চামড়া কখনও উদ্ধার হয়নি। গত ২২ জানুয়ারির ওটাই হলো হরিণের চামড়ার সবচেয়ে বড় চালান।’ তিনি বলেন, ‘চামড়াসহ পাচারকারীদের গ্রেফতারের পর আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। পরে আদালতে তাদের মঞ্জুর হলে জিজ্ঞাসাবাদে নিয়ে হরিণ শিকারের ফাঁদ জব্দ করা হয়েছে। এই চক্রের সঙ্গে আরও কারা জড়িত আছে তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। সুন্দরবনের প্রাণী ও বনজ সম্পদ রক্ষায় পুলিশ তৎপর রয়েছে। বন রক্ষায় ও ওই চক্রের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারের জন্য পুলিশের অভিযান অব্যাহত থাকবে।’

সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক ও সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) খুলনার সভাপতি অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, ‘বন্যপ্রাণী শিকার নিষিদ্ধ হলেও আইন অমান্য করে হরিণ শিকার করছে একটি চক্র। এতে সুন্দরবনে দিন দিন কমে যাচ্ছে হরিণের সংখ্যা। সম্প্রতি হরিণ শিকার বেড়ে যাওয়া আমাদের জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। যেখানে বনদস্যু আটক হয়ে সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হচ্ছে, সেখানে ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার বেড়ে যাচ্ছে।’ এর পেছনে বনবিভাগ ও আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে বলে মনে করছেন তিনি।

খুলনার দাকোপ উপজেলার বানিয়াশান্তা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুদেব কুমার রায় বলেন, তিনি নিজেই হরিণসহ সুন্দরবন সুরক্ষার আন্দোলন করে আসছেন। প্রতিবাদমুখর থাকার কারণে তিনি অনেকেরই বিরাগভাজন হচ্ছেন। তারপরও তিনি থেমে নেই। তিনি আরও বলেন, ‘শিকারিরা নিশ্চয়ই কারও না কারও ছত্রছায়ায় এ কাজে যুক্ত রয়েছে। যারা আটক হচ্ছে তারা সমাজের আরও বড় অপরাধীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সমাজের প্রতিষ্ঠিত লোকদের প্রশ্রয় ছাড়া এরা সক্রিয় থাকতে পারে না। এদের ভালো করে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই জড়িত অন্যদের বিষয়ে তথ্য পাওয়া যাবে।’ সুন্দরবন

সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, ‘সম্প্রতি সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী রক্ষায় অপরাধে জড়িতদের তথ্য প্রদানকারীকে পুরস্কার বিধিমালা-২০২০ অনুমোদন হয়েছে। এর ফলে এখন চোরা শিকারিদের ব্যাপারে সাধারণ মানুষ তথ্য প্রদানে উৎসাহিত হয়েছে। বিধিমালা অনুযায়ী সুন্দরবনের অভ্যন্তরে বাঘের চামড়াসহ আটক করার ক্ষেত্রে সহায়তা করে তথ্য প্রদানকারীকে ৫০ হাজার টাকা ও সুন্দরবনের বাইরে বাঘের চামড়াসহ আটক করার তথ্য প্রদানকারীকে ২৫ হাজার টাকা, সুন্দরবনের অভ্যন্তরে হরিণের চামড়াসহ আটক করার সহায়তাকারীকে ২০ হাজার টাকা ও সুন্দরবনের বাইরে হরিণের চামড়াসহ আটক করায় সহায়তাকারীকে ১০ হাজার টাকা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে তথ্য প্রদানকারীর নিরাপত্তা ও তথ্য গোপন রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।’

তিনি দাবি করেন, ‘সুন্দরবনে বন্যপ্রাণী শিকার বাড়েনি। আগে বণ্যপ্রাণীর অংশ বিশেষ উদ্ধার হতো। আসামি আটক হতো না। এখন পুরস্কার ঘোষণার কারণে বন্যপ্রাণীর অংশসহ আসামি আটক হচ্ছে। এ কারণে মনে হচ্ছে বন্যপ্রাণী শিকার বেড়েছে। আসলে নতুন বিধিমালার পর মানুষের সচেনতা বেড়েছে। তাই হরিণের মাংসসহ আটকের মাত্রা বেড়েছে।’

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার বলেন, ‘পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রাস্তাঘাটে মাদক ব্যবসায়ীদের মোটরসাইকেল বা গাড়ি নিয়ে ধাওয়া করে ধরতে পারে। কিন্তু বনের মধ্যে তা সম্ভব না। বিস্তীর্ণ বনের প্রত্যেকটি খালের আলাদা আলাদা বনরক্ষী দিতে পারলে হয়তোবা হরিণ শিকার কমে যেত। মানুষের  নৈতিকতার অবক্ষয় হয়েছে। শিকারি ধরা পড়লে মামলা হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু দুই দিন পর আদালত থেকে তারা জামিন নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে।’

/এফএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া