X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে করোনা নিয়ন্ত্রণে, ভ্যাকসিন বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি এখনও

আবদুর রহমান, টেকনাফ (কক্সবাজার)
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১১:১০আপডেট : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১১:১০
image

গতবছরের মার্চে বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস যখন দ্রুত বিস্তার হচ্ছিল তখন সারাদেশের মানুষকে নিরাপদে রাখার চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো খুব ভাবাচ্ছিল সরকারকে। ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাস করা ক্যাম্পগুলোতে একবার করোনা ঢুকে গেলে কী হবে সেই চিন্তাটা সত্যিই ছিল পীড়াদায়ক। তবে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সরকারের পরিকল্পনার সঙ্গে দাতা সংস্থাগুলো সমন্বিতভাবে যোগ দেওয়ায় ও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করায় সেখানে করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঠেকিয়ে রাখা গেছে। স্বাস্থ্যকর্মীরা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে করোনা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আছে। রোহিঙ্গারা খুব একটা আক্রান্তও হননি। এখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা মেনেই চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। তবে করোনার ভ্যাকসিন প্রাপ্যতার বিষয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি।

এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘করোনা মহামারিতে দাতা সংস্থাগুলো শুধু রোহিঙ্গাদের নয় স্থানীয়দের পাশেও দাঁড়িয়েছে। এখন পর্যন্ত তাদের কর্মকাণ্ড খুবই সন্তোষজনক।’

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাস্ক বিতরণ করছে একটি দাতা সংস্থা। (ছবি: সংগৃহীত)

রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় জরুরি সহায়তার কাজে থাকা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সমন্বিত গ্রুপ ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের  (আইএসসিজি) মুখপাত্র সৈকত বিশ্বাস বলেন, ‘আশ্রিত রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সরকারের সঙ্গে যে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে তার বাস্তবায়ন চলমান থাকবে।’

সৈকত আরও জানান, রোহিঙ্গাদের কাছে করোনা ভাইরাস মোকাবিলার ভ্যাকসিন পৌঁছানোর ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে দাতারা। এ ব্যাপারে সরকার এখনও কোনও সিদ্ধান্ত জানায়নি।

তবে বেসরকারি সংস্থাগুলোর কর্মকাণ্ডে তদারকি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন সিভিল সার্জন।

জেলা সিভিল সার্জন অফিসের হিসাব অনুযায়ী, জেলায় চলতি ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৮৩ হাজার ৫১০ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৭ হাজার ৫৬৪ জন রোহিঙ্গা। যে পাঁচ হাজার ৮৯০ জনের শরীরে ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে তার মধ্যে ৩৮৫ জন শরণার্থী।

ডা. মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘এখন পর্যন্ত জেলায় করোনা আক্রান্ত হয়ে ৮৩ জন মারা গেছে। এর মধ্যে ১০ জন রোহিঙ্গা ছিল।’

 রোহিঙ্গাদের একটি গোসলখানা জীবানুমুক্ত করে দিচ্ছেন এক স্বাস্থ্যকর্মী। (ছবি: ইউএসসিজি’র বুলেটিন থেকে সংগৃহীত)

আইএসসিজি জানায়, গত বছরের এপ্রিল মাসের শুরুতেই দেশে করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে সংক্রমণ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর)। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী, ক্যাম্প এলাকায় যাতায়াত কমিয়ে সীমিত পরিসরে শুধুমাত্র অতি প্রয়োজনীয় সাহায্য নিশ্চিত করা হয়। একইসঙ্গে আটশ সরকারি কর্মকর্তা ও দেড় সহস্রাধিক স্বাস্থ্যকর্মীকে সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

আইসিজি মুখপাত্র বলেন,  করোনার বিস্তার ঠেকাতে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে যৌথভাবে রোগ প্রতিরোধমূলক এই ব্যবস্থাগুলো আমরা অনেক আগে থেকেই নিয়েছি। এ কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এই মহামারির বিস্তার ঠেকানো সম্ভব হয়েছে।

এদিকে, রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারেই বেশি মনোযোগী সরকার। তবে দেশটিতে সামরিক বাহিনীর আবারও উত্থান করোনার কারণে ধীরগতিতে চলা প্রত্যাবাসনের আলোচনাকে আরও পেছনে ঠেলে দিয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানায়, সরকার এই মুহূর্তে দেশের সাধারণ মানুষদের জন্য করোনার টিকা আনা ও বিতরণে ব্যস্ত। রোহিঙ্গাদের জন্য ভ্যাকসিনের বিষয়টি সরকারের ভাবনাতে আছে তবে এই মুহূর্তে অগ্রাধিকার তালিকায় নেই। দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে বা জাতিসঙ্ঘের সঙ্গে সরকার ভ্যাকসিন ইস্যুতে আলোচনা করবে কিনা বা করলে কবে করবে সে বিষয়ে কোনও পক্ষের সঙ্গে আলোচনাও হয়নি। 

রোহিঙ্গা ক্যাম্প

যেভাবে চলছে প্রতিরোধ যুদ্ধ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে করোনা আক্রান্তদের আইসোলেশনে রেখে তার চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি এআক্রান্তের সংস্পর্শে কেউ এলে তারও নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হচ্ছে।               

তবে করোনা ঠেকাতে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থাকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হচ্ছে সারাবিশ্বের মতো রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলাতেও । এজন্য জনসচেতনতা বাড়াতে কাজ করে যাচ্ছে আইএসসিজি।

এজন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচারণার পাশাপাশি মসজিদের ইমাম ও স্থানীয় রোহিঙ্গা নেতাদের সাহায্যও নেওয়া হচ্ছে। প্রচারণাগুলো চলছে রোহিঙ্গা, বার্মিজ ও বাংলা ভাষায়; এতে ব্যবহার করা হচ্ছে রেডিও স্পট, ভিডিও, পোস্টার ও লিখিত মেসেজ।

আইএসসিজি জানায়, ক্যাম্পগুলোয় এখন পর্যন্ত প্রায় ১৫ লাখ মাস্ক ও প্রচুর পরিমাণ সাবান বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া নতুন করে তৈরি করা হয়েছে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ইউএনএইচসিআর ১০ লক্ষাধিক সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) সরবরাহ করেছে।

করোনাকালে রোহিঙ্গাদের ঘরে পৌঁছানো হচ্ছে খাবার। ( ছবি: ব্র্যাক)

 

জানা গেছে, ডিসেম্বর পর্যন্ত সবগুলো সংস্থা মিলে ১৪টি বিশেষায়িত চিকিৎসা কেন্দ্র তৈরি করেছে। এসব ক্যাম্পে শরণার্থী ও টেকনাফ-উখিয়ার এলাকার স্থানীয়দের মধ্যে গুরুতর করোনা রোগীরা চিকিৎসা পাচ্ছেন। এমন আরও তিনটি কেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। কক্সবাজার সদর হাসপাতালে জেলার একমাত্র আইসিইউ (ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিট) ও এইচডিইউ (হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিট) তৈরিতে সহায়তা করেছে ইউএনএইচসিআর। ওই আইসিইউতে ১০টি বেড, ১১টি ভেন্টিলেটর ও দুটি পোর্টেবল ভেন্টিলেটর এবং এইচডিইউ-তে ২৮টি বেড রয়েছে। রোগীদের নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহে সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্টও করা হয়েছে।

এছাড়া কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য রামু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৫০ শয্যার, চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৫০ শয্যার এবং উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন স্থাপিত কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতালে ১৪৪ শয্যার আইসোলেশন সেন্টার, টেকনাফে ৩০ শয্যার আইসোলেশন সেন্টারের পাশপাশি টেকনাফে আইসিডিডিআরবির অধীনে ২০০ শয্যা বিশিষ্ট আইসোলেশন ও চিকিৎসা কেন্দ্র চালু করা হয়েছিল।

মাঠের কর্মকর্তাদের ভাষ্য

টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা টিটু চন্দ্র শীল বলেন, ‘মহামারির শুরুতে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে এই অঞ্চল নিয়ে খুবই ভয়ে ছিলাম। কিন্তু সরকার ও দাতা সংস্থাগুলো সমন্বিত চেষ্টায় এই চাপটা সামাল দিতে পেরেছে।’

তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত যেসব কার্যক্রম চলছে সেটি যথেষ্ট বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে। কারণ, আগের তুলনায় করোনার রোগী কমে গেছে। যা পাওয়া যাচ্ছে তা হচ্ছে সাধারণ রোগী থেকে। তবে সেন্টমার্টিন যাত্রার জেটিঘাটের মতো দু-একটি জায়গায় নজর দেওয়ার দরকার। মূলত এসব জায়গায় অনেকে স্বাস্থ্যবিধি মানছে না।’

তিনি জানান, ওই উপজেলায় ১১ হাজার ৪৬ জনকে করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে। তার মধ্যে ৫৭১ জন করোনা পজেটিভ হয়েছেন। এদের মধ্যে রোহিঙ্গা ছিল ৮৪ জন।

সরেজমিনে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা গেছে, স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসা লোকজন হাত ধুয়ে হাসপাতালে প্রবেশ করছেন। ফ্লু কর্নারে করোনা নমুনা সংগ্রহ করছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একটি শিশুকে হাত ধোয়া শেখানো হচ্ছে।

রয়েছে অভিযোগ-অনুযোগও

উখিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি মাহমুদুল হক চৌধুরী দাবি করেছেন, করোনা মহামারি মোকাবিলায় দাতা সংস্থাগুলো তার এলাকায় স্থানীয়দের জন্য তেমন একটা কাজ করেনি। তিনি বলেন, ‘তারা (দাতা সংস্থা) চিকিৎসার জন্য বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। তবে করোনা মোকাবিলায় স্থানীয়দের মধ্যে সচেতনতা তৈরি সবচেয়ে জরুরি। এমন কিছু প্রকল্প হাতে নেওয়া উচিত তাদের।’

আইএসসিজি অভিযোগ না করলেও, করোনা মোকাবিলার বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে  চিহ্নিত করেছে ক্যাম্পগুলোতে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মধ্যে সহিংসতার ঘটনাকে। এ কারণে মাঝে মাঝে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ আছে সরকারেরও। সম্প্রতি ডাকাতি ও কর্তৃত্ব বিস্তার নিয়ে দুইদল সন্ত্রাসীর সংঘর্ষে তিন রোহিঙ্গা ও একজন স্থানীয় নিহত হওয়ার পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ছুটে আসেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন। এসময় তিনি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা আইন শৃঙ্খলাবাহিনীহুলোকে জিরো টলারেন্স দেখানোর নির্দেশ দেন। 

/টিএন/
সম্পর্কিত
উখিয়া ক্যাম্পে রোহিঙ্গা যুবককে কুপিয়ে হত্যা
কক্সবাজার জেলার রোহিঙ্গা ভোটারদের তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
সর্বশেষ খবর
ভারতের একটি হোটেলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত ৬
ভারতের একটি হোটেলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত ৬
কুষ্টিয়ার তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস
কুষ্টিয়ার তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস
‘গাজার গণকবরে অন্তত ২০ জনকে জীবন্ত দাফন’
‘গাজার গণকবরে অন্তত ২০ জনকে জীবন্ত দাফন’
‘বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়তে হবে’
‘বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়তে হবে’
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা