X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

বহুমাত্রিক দুর্নীতির সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৫:৫৬আপডেট : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৫:৫৬

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ‘মাঠ পর্যায় থেকে উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সর্বত্র দুর্নীতি’—কথাটি আর কারও নয়, স্বয়ং দুর্নীতি বন্ধের দায়িত্বে যিনি আছেন তার। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর সোমবার সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে এ কথা বলেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ।

পরদিন একটি পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমি মনে করি, দেশে সুশাসন দরকার। চারপাশজুড়ে থাকা দুর্নীতি বন্ধ না হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়’। দুদক চেয়ারম্যানের কথার অনেক প্রকার ব্যাখ্যা হবে। কিন্তু একটি কথা বলা দরকার যে, দুর্নীতির ইস্যুতে আমরা অতিমাত্রায় দুদক-নির্ভর হয়ে পড়েছি। সব খাতের দুর্নীতি নির্মূল দুদকের একার কাজ নয়। মন্ত্রণালয়, সংসদীয় কমিটি, সরকারি কেনাকাটায় তদারকি সংস্থা, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও দফতর, বাংলাদেশ ব্যাংক, আর্থিক বিভাগ, এনবিআর, সেবা খাত, এমনকি বিচার ব্যবস্থাসহ সব প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহির আওতায় না আনতে পারলে এ কাজ সম্ভব নয়। সেখানেই সুশাসনের প্রশ্ন, যেটি বলেছেন দুদক প্রধান।

বাংলাদেশে দুর্নীতি বাড়ছে— এটি কোনও নতুন কথা নয়। কিন্তু তবু এমন একটা ইস্যু বারবার আলোচনায় আসে। কারণ, কোনও না কোনও জায়গা থেকে উপলক্ষ সৃষ্টি হয়, এবার যেমন এলো দুদকের ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রসঙ্গ। গত পাঁচ বছরের মামলায় বিচারিক আদালতের রায়গুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দুদকের মামলায় ২০১৫ সালে সাজার হার ছিল ৩৭%, ২০১৬ সালে সাজার হার ৫৪%, ২০১৭ সালে সাজার হার ৬৮%, ২০১৮ সালে সাজার হার ৬৩% এবং ২০১৯ সালে সাজার হার ৬৩%।

কিছু দিন আগে প্রতি বছরের মতো দুর্নীতির ধারণা সূচক প্রকাশ করেছে বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)। বলা হয়েছে, দুর্নীতির ধারণা সূচকে আগের বছরের তুলনায় আরও দুই ধাপ নিচে নেমে এসেছে বাংলাদেশ।

দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবনমনের কোনও নড়চড় নেই। সব সময় অতি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় আমাদের অবস্থান। ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত টানা ৫ বছর বাংলাদেশ, বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে টিআই প্রতিবেদনে তালিকাভুক্ত হয়েছিল। পরে ধীরে ধীরে বাংলাদেশের অবস্থান এগিয়ে আসতে থাকে। এখন আবার কেন নামলো তা সবিস্তার ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। বৃহত্তর পরিসর থেকে তুলনায় ক্ষুদ্রতর পরিসর, সর্বত্রই যে রূপে দুর্নীতির ছায়া ক্রমপ্রসারণশীল তার জন্য পরিসংখ্যানেরও প্রয়োজন নেই।

জনজীবনের প্রত্যন্ত স্তরেও দুর্নীতির গ্রাস। গৃহস্থালির নিত্যকার সেবা পরিষেবায় পর্যন্ত দুর্নীতির হাত সম্প্রসারিত হয়েছে। ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘গ্রামে ৮০ শতাংশ মানুষ বাস করে। তাদের নিরাপদ অবস্থান বজায় রাখতে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। আর এই দুর্নীতি বন্ধের জন্য সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। সরকারি ক্যাডারদের মধ্য থেকে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নিয়োগ এবং মাঠ পর্যায়ে সরকারি দায়িত্ব নবনিযুক্ত ক্যাডারদের দেওয়া হলে স্বস্তি ফিরে আসতে পারে। তারাই দুর্নীতির গোড়ায় আঘাত হানতে পারে।’

আরও অনেক সংস্কারের প্রস্তাব নানা জায়গা থেকে আসবে। কিন্তু সমস্যা হলো দুর্নীতির প্রশ্নে সমাজে এক প্রকার গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়ে গেছে। মানুষ ধরেই নিয়েছে, রাজনীতিক, সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী যেই হোক না কেন ক্ষমতাবান মানুষ বড় দুর্নীতি করবেই। এবং তাকেও ছোট ছোট দুর্নীতি করেই বেঁচে থাকতে হবে। এটাই শাসন প্রণালির বৈশিষ্ট্য। আর সে কারণেই দুর্নীতিবিরোধী জিরো টলারেন্সের কথা এখন কেবলই কথার কথা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন তো দূরের কথা, এ নিয়ে দেশের মধ্যবিত্ত সমাজ আলোড়িতও নয়।

দুর্নীতির সঙ্গে একটি বোঝাপড়া করে নিয়েছে মানুষ। মানুষ পথ খোঁজে কী করে অনিয়মের পথে বাড়িতে একটা গ্যাস বা বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়া যায়, কী করে সন্তানের জন্য ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নপত্রের একটা কপি পাওয়া যায়, কী করে সরকারি হাসপাতালে গিয়ে কিছু টাকা কারও হাতে গুঁজে দিয়ে চিকিৎসা করানো যায়, কী করে ঘুষ দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স বা বাতিল গাড়িরও ফিটনেস সার্টিফিকেট পাওয়া যায়। এগুলো সবই এখন জীবনযাপনের প্রাত্যহিক স্তরে স্বাভাবিক বিষয়। এটি এখন আর নিন্দার বিষয় নয়, বরং সক্ষমতা। কারণ, সরকারি অফিসে কোনও সেবাই পাওয়া যায় না টাকা বা প্রভাব না থাকলে। তাই ঘুষ দিয়ে কাজ করে নেওয়ার দক্ষতাটি এক ধরনের সামাজিক বৈধতা লাভ করেছে। এভাবেই সরকারি কর্মীরা সাধারণ মানুষকে দিয়েই সমাজে বহুমাত্রিক দুর্নীতির গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করেছেন। দর্শন একটাই—‘যদি নির্বিঘ্নে বাঁচতে চাও তাহলে অন্যকে ফাঁকি দিয়ে নিজের লাভটি হাসিল কর, দুর্নীতিতে হাত পাকাও।’

রাজনীতিবিদ, আমলা, পেশাজীবী, ব্যবসায়ীদের মধ্যে যারা বড় দুর্নীতিবাজ, যারা রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট করে পাচার করছেন তারা সাধারণ মানুষের মাঝে এসব ছোট দুর্নীতি প্রবেশ করিয়ে এখন আরামে আছেন। এটা হলো নাগরিক সমাজের দুর্নীতি। এটাই সংকট। আর এ কারণেই দুর্নীতি চলবে। চলবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও। এবং যে যত বড় দুর্নীতিবাজ, প্রতিবাদের অগ্রভাগে তারই মুষ্টিবদ্ধ আস্ফালন বেশি করে দেখবো আমরা।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হৃদরোগ বিভাগে ছারপোকার রাজত্ব, হাসপাতাল পরিচালক দুষছেন রোগীদের
রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালহৃদরোগ বিভাগে ছারপোকার রাজত্ব, হাসপাতাল পরিচালক দুষছেন রোগীদের
‘মডার্ন মেট্রোপলিস’ থিমে ঈদ সংগ্রহ এনেছে ঢেউ
‘মডার্ন মেট্রোপলিস’ থিমে ঈদ সংগ্রহ এনেছে ঢেউ
কাপাসিয়ায় গরু চোর সন্দেহে ২ জনকে পিটিয়ে হত্যা
কাপাসিয়ায় গরু চোর সন্দেহে ২ জনকে পিটিয়ে হত্যা
ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কবে সমন্বয় করবে রাজউক?
বহুতল ভবনের সংজ্ঞাফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কবে সমন্বয় করবে রাজউক?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ