X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

নন-রেভিনিউ ওয়াটার: বছরে ৪৫ কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে ওয়াসা

হুমাযুন মাসুদ, চট্টগ্রাম
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৩:০০আপডেট : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৩:০০

উৎপাদিত পানি ভোক্তাদের কাছে পৌঁছানোর আগে পাইপ লিকেজ, চুরি অথবা বৈধ ব্যবহারের পরও অপচয় দেখানোর নাম নন-রেভিনিউ ওয়াটার (এনআরডব্লিউ)। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড স্যানিটেশন প্রতিষ্ঠানে এই নন-রেভিনিউ ওয়াটার যেখানে ৫ থেকে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ হয়, সেখানে চট্টগ্রাম ওয়াসায় এটি গড়ে ২৫ থেকে ৩৩ শতাংশ। অর্থাৎ উৎপাদিত পানির চার ভাগের এক ভাগ বা তার বেশি প্রতিদিন অপচয় হচ্ছে। এতে একদিকে চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে নগরীর বিশাল জনগোষ্ঠীকে পানি সরবরাহের আওতায় আনতে পারছে না। হিসাব করে দেখা যায়, নন-রেভিনিউ ওয়াটার খাতে গত বছর ৪৫ কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসা।

ওয়াসার পক্ষ থেকে এটিকে সিসটেম লস বলা হলেও অভিযোগ উঠেছে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নিজেরা লাভবান হওয়ার জন্য নন-রেভিনিউ ওয়াটারের নাম দিয়ে এই টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। নগরীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশে মিটার রিডাররা গ্রাহকদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে রিডিং কম দেখান। টাকার বিনিময়ে অবৈধ সংযোগ দেন। ওই পানিগুলোকে নন-রেভিনিউ ওয়াটার নাম দিয়ে রাজস্ব আয় কম দেখাচ্ছেন।

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম বলেন, ‘নন-রেভিনিউ ওয়াটার এত বেশি কেন সেটি আমরা বলতে পারবো না। লিকেজসহ বিভিন্নভাবে কী পরিমাণ পানি অপচয় হয় তা নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিটির কাছে আমরা আমাদের সব তথ্য উপস্থাপন করেছি। সেখানে লিকেজসহ বিভিন্নভাবে প্রতিদিন গড়ে ৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ অপচয় ছাড়া আর কোনও সিসটেম লসের তথ্য পাওয়া যায়নি। এই ৩ দশমিক ৪৪ শতাংশের বাইরে আর কোনও পানি অপচয় হওয়ার সুযোগ নেই। এরপরও নন-রেভিনিউ ওয়াটার এত বেশি হয় কেন আমার জানা নেই। এ বিষয়ে অর্থ ও বাণিজ্যিক বিভাগ ও মিটার রিডিংয়ের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা ভালো বলতে পারবেন।’

এই হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ৫ শতাংশের বেশি সিসটেম লস বা নন-রেভিনিউ ওয়াটার হওয়ার কথা নয়, কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় চট্টগ্রাম ওয়াসায় প্রতিমাসে গড়ে নন-রেভিনিউ ওয়াটার থাকে ২৫ থেকে ৩৩ শতাংশ। যদি গত নভেম্বর মাসে এটি অনেক কমেছে। নভেম্বর মাসের এমআইএস রিপোর্টে নন-রেভিনিউ ওয়াটার দেখানো হয়েছে ১৭ শতাংশ। কোনও ধরনের প্রযুক্তি সংযোজন ছাড়াই শুধু অর্থ ও বাণিজ্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্তরিকতার কারণেই নভেম্বর মাসে নন-রেভিনিউ ওয়াটার অর্ধেকে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে ওয়াসা। যেখানে এর ছয় মাস আগে এপ্রিল মাসে নন-রেভিনিউ ওয়াটার ছিল ৩৩ শতাংশ। এটি প্রমাণ করে, অর্থ ও বাণিজ্য বিভাগের কর্মকর্তারা এতদিন গাফলতি করেছেন। তারা আন্তরিক না হওয়ায় নন-রেভিনিউ ওয়াটারের মাধ্যমে বিশাল অংকের রাজস্ব হারাচ্ছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এমআইএস রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ওই ১১ মাসে নন-রেভিনিউ ওয়াটার খাতে চট্টগ্রাম ওয়াসা ৪১ কোটি ৬৭ লাখ ৩১ হাজার ৩৫০ টাকা রাজস্ব হারিয়েছে। এই হিসাবে শুধুমাত্র নন-রেভিনিউ ওয়াটারের নামে প্রতি বছর চট্টগ্রাম ওয়াসা রাজস্ব হারাচ্ছে ৪৫ কোটি টাকা।

ওয়াসার প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে তিনটি প্রকল্প ও গ্রাউন্ড ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের মাধ্যমে চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রতিদিন গড়ে ৩৫ থেকে ৪২ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করে। এর মধ্যে শেখ রাসেল পানি সরবরাহ প্রকল্প থেকে দৈনিক ৯০ মিলিয়ন লিটার, শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার প্রকল্প থেকে ১৪৩ মিলিয়ন লিটার, মোহরা পানি সরবরাহ প্রকল্প থেকে ৯০ মিলিয়ন লিটার উৎপাদন করা হয়। এছাড়াও গ্রাউন্ড ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট এবং ৪৩টি গভীর নলকূপ থেকে ৬৮ মিলিয়ন এবং ৩৭ মিলিয়ন লিটার পানি উৎপাদন করা হয়। উৎপাদিত এই বিশাল পানির ৯ থেকে ১০ কোটি লিটার প্রতিদিন নন-রেভিনিউ ওয়াটার হিসেবে অপচয় হচ্ছে। এই অপচয় রোধ করা গেলে নগরীর আরও বিশাল জনগোষ্ঠী ওয়াসার পানির সরবরাহের আওতায় আসতো। বর্তমানে চট্টগ্রাম ওয়াসা নগরীর ৫৭ ভাগ এলাকায় পানি সরবরাহ করতে পারে, পানির অপচয় রোধ করা গেলে প্রতিষ্ঠানটি ৭০ থেকে ৮০ ভাগ এলাকায় পানি সরবরাহ করতে সক্ষম হতো।

৪২ কোটি লিটার নয়, প্রতিদিন চট্টগ্রাম ওয়াসা গড়ে ৩৫ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করে এই হিসেব ধরলেও দেখা যায়, নন-রেভিনিউ ওয়াটার খাতে প্রতি বছর ওয়াসা ৪৫ কোটি টাকার মতো রাজস্ব হারাচ্ছে। এই হিসাবে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে ওয়াসা ৪১ কোটি ৬৭ লাখ ৩১ হাজার ৩৫০ টাকা রাজস্ব হারিয়েছে। 

ওয়াসার এমআইএস রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে নন-রেভিনিউ ওয়াটার ছিল ২৭ শতাংশ। ওই মাসে পানির গড় বিক্রয় মূল্য ছিল ১২ দশমিক ৪৬ টাকা। সেই হিসাবে ৩৫ কোটি লিটার পানি থেকে দৈনিক আয় হওয়ার কথা ৪৩ লাখ ৬১ হাজার টাকা। আর মাসিক আয় হওয়ার কথা ১৩ কোটি ৮ লাখ ৩০ হাজার টাকা। এই হিসাবে জানুয়ারি মাসে নন-রেভিনিউ ওয়াটারের কারণে ওয়াসা রাজস্ব হারিয়েছে ৩ কোটি ৫৩ লাখ ২৪ হাজার ১০০ টাকা। ফেব্রুয়ারি মাসেও একই অবস্থা। ফেব্রুয়ারি মাসে নন-রেভিনিউ ওয়াটার ছিল ২৫ শতাংশ। ওই মাসে পানির গড় বিক্রয় মূল্য ছিল ১২ দশমিক ৭০ টাকা। সেই হিসাবে ৩৫ কোটি লিটার পানি থেকে দৈনিক আয় হওয়ার কথা ৪৪ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। আর মাসিক আয় হওয়ার কথা ১৩ কোটি ৩৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এই হিসাব অনুযায়ী ফেব্রুয়ারি মাসে নন-রেভিনিউ ওয়াটারের কারণে ওয়াসা রাজস্ব হারিয়েছে ৩ কোটি ৩৩ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা।

একই হিসাব অনুযায়ঢ নন-রেভিনিউ ওয়াটার খাতে মার্চ মাসে ওয়াসা রাজস্ব হারিয়েছে ৪ কোটি ২৬ লাখ ৪ হাজার ৮০০ টাকা, এপ্রিল মাসে ৫ কোটি ২৫ লাখ ২৯ হাজার ৪০০ টাকা, মে মাসে ৪ কোটি ৫০ লাখ ৮১ হাজার ৭৫০ টাকা, জুন মাসে ৪ কোটি ৬৭ লাখ ৭৭ হাজার ৫০০ টাকা, জুলাই মাসে ৩ কোটি ৫৪ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা, আগস্ট মাসে ৩ কোটি ১৮ লাখ ৩১ হাজার ৮০০ টাকা, সেপ্টেম্বর মাসে ৩ কোটি ৩৮ লাখ ৮৭ হাজার ৭০০ টাকা, অক্টোবর মাসে ৩ কোটি ৪৭ লাখ ৫০ হাজার ৮০০ টাকা এবং নভেম্বর মাসে ২ কোটি ৫১ লাখ ৬৮ হাজার ৫০০ টাকা।

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে ওয়াসার প্রধান বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক আবু সাফায়াৎ মুহাম্মদ শাহে-দুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নন রেভিনিউ ওয়াটার কমিয়ে আনতে হলে কী কী কারণে পানির অপচয় হচ্ছে সেগুলো খুঁজে বের করতে হবে। দেখতে হবে– পানি সরবরাহের পাইপলাইনগুলো কত সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; মাটির নিচ দিয়ে যাওয়া এসব লাইনে কয়টি অদৃশ্য লিকেজ আছে; পাশাপাশি দেখতে হবে কোন জায়গা থেকে উৎপাদন হচ্ছে, সেখান থেকে কোন জায়গায় ব্যয় হচ্ছে। নন-রেভিনিউ ওয়াটারের বিষয়ে উৎপাদন ও বিতরণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িতরা ভালো বলতে পারবেন।’

২০২০ সালের মে মাসে নন-রেভিনিউ ওয়াটার ৩৩ শতাংশ ছিল, এটি নিয়ে কঠোরতা আরোপের পর নভেম্বর মাসে এসে এটি ১৭ শতাংশে নেমে আসলো। তার মানে এখানে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গাফলতি ছিল। অভিযোগ আছে নন-রেভিনিউ ওয়াটার বেশি দেখিয়ে কর্মকর্তারা বিপুল পরিমাণ রাজস্ব  নিজেরা ভাগাভাগি করে নিয়ে যাচ্ছেন। এই অভিযোগের বিষয়ে শাহে-দুল ইসলাম বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কোনও মন্তব্য করবো না। আমি ওয়াসায় যোগদান করেছি মাত্র ছয় মাস হয়েছে। এই মুহূর্তে আমি এটি নিয়ে কোনও মন্তব্য না করে কীভাবে সেটি কমিয়ে আনা যায় তা নিয়ে কাজ করবো। কাজ করে নন-রেভিনিউ ওয়াটার যদি এক শতাংশও কমানো যায়, এতে সরকারের রাজস্ব খাতে বিপুল পরিমাণ টাকা যোগ হবে। আমি সেটি নিয়ে কাজ করতে চাই।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘নন-রেভিনিউ ওয়াটার ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে আমরা কাজ করছি। কোন জায়গায় উৎপাদন এবং সেখান থেকে কোথায় ব্যয় হচ্ছে সেটি নিশ্চিত করতে আমরা ডিস্ট্রিক্ট মিটারিং এরিয়া (ডিএমএ) নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। এটি বাস্তবায়ন হলে নন-রেভিনিউ ওয়াটার ১০ শতাংশের নিচে নিয়ে আসতে পারবো। আশা করছি, আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে ডিএমএ প্রকল্প শেষ করতে পারবো।’

 

/এমএএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘সামরিক বাহিনীতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আইন কর্মকর্তাদের পেশাগত মানোন্নয়ন জরুরি’
সামরিক বিচার ব্যবস্থা নিয়ে সেমিনারে বিমান বাহিনী প্রধান‘সামরিক বাহিনীতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আইন কর্মকর্তাদের পেশাগত মানোন্নয়ন জরুরি’
ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তির বিরোধিতা, ২৮ কর্মীকে বহিষ্কার করলো গুগল
ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তির বিরোধিতা, ২৮ কর্মীকে বহিষ্কার করলো গুগল
বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির জন্য বাড়ছে হাহাকার
বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির জন্য বাড়ছে হাহাকার
চট্টগ্রামে তিন ভাইবোনকে হত্যা: ২ জনের মৃত্যুদণ্ড
চট্টগ্রামে তিন ভাইবোনকে হত্যা: ২ জনের মৃত্যুদণ্ড
সর্বাধিক পঠিত
এএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
রেস্তোরাঁয় ‘মদ না পেয়ে’ হামলার অভিযোগএএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
‘আমি এএসপির বউ, মদ না দিলে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেবো’ বলে হামলা, আহত ৫
‘আমি এএসপির বউ, মদ না দিলে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেবো’ বলে হামলা, আহত ৫
রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত করতে নতুন উদ্যোগ রাজউকের
রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত করতে নতুন উদ্যোগ রাজউকের
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট