X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

শো-অফ করতে গিয়েই মানুষ আর্টের প্রেমে পড়ে : জামাল আহমেদ

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : জুলফিকার রাসেল
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০০:২০আপডেট : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০০:৩৯

শিল্পী ও অধ্যাপক জামাল আহমেদ। উজ্জ্বল রং ও আলো-ছায়ার খেলায় ফুটিয়ে তোলেন জীবনের বিরহ, বেদনা ও আনন্দকাব্য। দেশের ফিগারেটিভিসম ধারার শিল্পীদের মধ্যে অগ্রজ তিনি। ১৯৫৫ সালে জন্ম নেওয়া এ শিল্পী চারুকলায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৯ সালে পেয়েছেন একুশে পদক। সম্প্রতি তার মুখোমুখি হয়েছেন বাংলা ট্রিবিউনের সম্পাদক গীতিকবি জুলফিকার রাসেল।

 

জুলফিকার রাসেল : প্রথম কোন ছবিটা এঁকেছিলেন, যেটা আঁকার পর মনে হলো—এই ছবিটা আমার আঁকা!

জামাল আহমেদ : যখন থ্রি-ফোরে পড়ি তখন—কী এঁকেছি তা মনে নেই। তবে মনে আছে, লাল সূর্য উঠছে এমন একটা ছবি এঁকেছিলাম। যা একটা আবছা স্মৃতি হয়ে আছে।

 

জুলফিকার রাসেল : ছবিটি কাউকে দেখিয়েছিলেন? নাকি নিজের খাতাতেই ছিল?

জামাল আহমেদ : নিজের কাছেই ছিল। ওই আমলে তো কেউ দেখলেই বলতো, ওহ! পড়া বাদ দিয়ে ছবি আঁকছো! তখন তো সবাই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে, এসবই বলতো। আমি পড়তাম গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলে। যেটা দেখতাম সেটাই আঁকতাম। মন থেকেও আঁকতাম। এসবের মধ্যে আব্বা সিদ্ধান্ত দিলেন, তুই মেট্রিক পাস কর, তোকে আর্ট কলেজে ভর্তি করাবো।

 

জুলফিকার রাসেল : আপনি ভালো ছাত্র ছিলেন না?

জামাল আহমেদ : এভারেজ ছাত্র ছিলাম। ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড কিংবা দশজনের মধ্যে থাকতাম না। আঁকার মধ্যে থাকতাম। আমি জানতাম, আব্বা আবেদীন স্যারকে (জয়নুল আবেদীন) চিনতেন। আর্টিস্টদের সম্মান করে সবাই, এটা তিনি সামনাসামনি দেখেছেন। তাই ভেবেছেন, নাহ, এটা তো খারাপ না। আমি মেট্রিক দেই বাহাত্তরে। বলছি, তারও আগের কথা। তখন কোনো বাবা-মা চাইতেন না তার ছেলে আর্টিস্ট হোক।

 

জুলফিকার রাসেল : বাবা চেয়েছিলেন, কিন্তু মা?

জামাল আহমেদ : বাবা চাইতেন। তাই মা-ও আপত্তি করেননি। তিনি নিজেও টুকটাক ছবি আঁকতেন।

 

জুলফিকার রাসেল : বাবা যখন বললেন তখন সেভাবে প্রস্তুতি নিলেন?

জামাল আহমেদ : আব্বা ভর্তি করালেন আর্ট স্কুলে। এটা চারুকলার ভেতরেই। এখনো আছে স্কুলটা। ওখানেই শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়। তিনি আমার সিনিয়র ছিলেন। তিনি নাইন-টেনে পড়তেন, আমি ফাইভে। শাহবুদ্দিন ভাই আসার সময় আমাকে নিয়ে আসতেন। শাহাবুদ্দিন ভাই যেভাবে আঁকতেন আমিও সেভাবে আঁকতাম।

 

জুলফিকার রাসেল : অনেকে তো বলে এটা ঈশ্বরপ্রদত্ত। চারুকলায় গিয়ে কী শিখলেন?

জামাল আহমেদ : না, কিছু তো মনের ইচ্ছে থাকতে হবে। চর্চাও করতে হবে। আল্লাহ দিয়ে দিলো, কিন্তু চর্চা করলাম না, তা হলে তো হলো না। যেমন গায়কদের রেওয়াজ করতেই হবে। গলা ভালো কিন্তু রেওয়াজ না করলে তো হবে না। আমাদের এক বন্ধু আছে আর্কিটেক্ট। ওর নাম পলাশ। খুব সুন্দর গলা। কিন্তু ও তো গানের চর্চা করে না। সে তো নামকরা আর্কিটেক্ট। কিন্তু গান গাইলেও নাম করতো।

 

জুলফিকার রাসেল : গানে যেমন ক্লাসিক্যাল বেইজ থাকতে হয়, তেমনি আর্টেরও বেসিক থাকতে হবে?

জামাল আহমেদ : গান কোথা থেকে আসে? গান কিন্তু মুখ থেকে আসে না, ভেতর থেকে আসে। ছবিটাও কিন্তু হাত থেকে আসে না, ভেতর থেকে আসে। একই বিষয়। ওটা গাওয়া, এটা হাতে করা। এখন ধরো হাতের কনুই থেকে যদি আসে তাহলে সেটা ক্রাফটসম্যান হয়ে যাবে। টেবিল-চেয়ার বানায় না? খুব সুন্দর ফিনিশিং—কিন্তু ওটা আর্ট হলো না। ওটা হবে ভালো টেবিল বা ভালো চেয়ার। ফিনিশিং দেয় না? জাপানিরা ভালো ফিনিশিং দেয়। আমি কিন্তু জাপানি জিনিস ধরলেই বুঝতে পারি। 

আমার মনে আছে একবার এক বন্ধু ড্রাইভ করে প্যারিস থেকে গাড়ি করে নিয়ে গিয়েছিল জার্মানিতে। প্যারিসে অনেক হোটেলে খেয়েছি। সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার। পরের দিন যেতে দেরি হয়েছে, তখনো সে বলেনি আমরা জার্মানি যাচ্ছি। বলল, চল আমরা লাঞ্চ করি। লাঞ্চ করার সময় কিছু বলেনি। সেই রেস্টুরেন্টের দরজার হাতল ধরেই বললাম, কি-রে আমরা জার্মানি এসেছি নাকি? সে তখন বলল, কীভাবে বুঝলি! বললাম, দরজার হাতল ধরেই বুঝে গেছি আমরা জার্মানিতে। কারণ ওটা ছিল বেশ পিচ্ছিল এবং যার ফিনিশিং সুন্দর। এমনটা পৃথিবীর আর কোনো দেশে হবে না। তো, এটা হলো ক্রাফটম্যানশিপ।

জামাল আহমেদ জুলফিকার রাসেল : কিন্তু আর্ট ছাড়া ক্রাফটস হবে?

জামাল আহমেদ : আমি বলছি, আমি একটা লাইন দিলাম, সেটার ভেতরে একটা লাইট থাকতে হবে। একটা শৈল্পিক বিষয় থাকবে। দপ করে বাতি জ্বললে তো হবে না। সুন্দর লাইন দিলেও হবে না। ওটার মধ্যে রিদম থাকতে হবে।

 

জুলফিকার রাসেল : আপনি তো বেসিক আর্ট জানতেনই। আত্মা থেকে সেটা তো আসতোই। তো, চারুকলা আপনাকে বাড়তি কী শেখালো?

জামাল আহমেদ : চারুকলায় ওই যে আমরা একসঙ্গে কাজ করলাম, শিক্ষকরা শেখালো। অনেক কিছুই শিখেছি। জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবো না কী শিখেছি কিন্তু শিখেছি তো অবশ্যই। প্র্যাকটিক্যাল শিক্ষার চেয়ে আমি কিন্তু বেশি শিখেছি আড্ডা মেরে। যেমন, কিবরিয়া স্যারের সঙ্গে কথা বলতাম। তিনি বলতেন আমি শুনতাম। তিনি বলতেন, ছেলেপুলে ফটোগ্রাফ দিয়ে যে ছবি আঁকে, এর থেকে আউটডোরে গেলে খারাপ ছবিটাও ভালো ছবি হবে। আর ফটোগ্রাফ দিয়ে খুব ভালো ছবি আঁকছে দেখে দেখে, এটা আসলে ভালো না। ভালো হলেও ভালো না, কারণ ওটার মধ্যে ফিলিংস নাই। হয়তো পারফেক্ট হয়েছে কিন্তু ওটার ভেতর প্রাণ নেই। আর তুমি আউটডোরে যদি আঁকো, ওটা খারাপ হলেও ভালো ছবি। এগুলো তো শিখেছি, এসব তো বুঝতাম না। মনে করতাম ফিনিশিং দিলেই বেশি ভালো।

 

জুলফিকার রাসেল : আপনি তো অনেক শিক্ষক পেয়েছেন। যেমন, কিবরিয়া স্যারের কথা বললেন। এমন অন্য শিক্ষকদের কাছ থেকে কী কী শিখেছেন?

জামাল আহমেদ : যখন থার্ড ইয়ারে পড়ি যখন তখন কী আঁকবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এক স্যার ছিলেন শহীদ কবির। তরুণ শিক্ষক। তাকে একদিন বললাম, স্যার কী আঁকবো বুঝতে পারছি না। তিনি বললেন, মানে? তোমার চোখের সামনেই তো কতকিছু। যা দেখবা সেটাই আঁকবা। সাবজেক্ট চয়েজ করা শিখেছি স্কুলের স্যারের কাছ থেকে। যেমন, সামনে কল ছিল পিতলের, সেটা ভাঙা। টুপ টুপ করে পানি পড়ছে। পানি পড়তে পড়তে নিচের ইটটা দেখা যাচ্ছে। ওটা কোনোদিন হয়তো আঁকতাম না। ভাবতাম এটা আবার সাবজেক্ট হলো? আঁকবো সুন্দর গাছ, সুন্দর নদী এসব। স্যার বললেন, আরে ওটা আঁকো। আঁকলাম, চমৎকার ছবি হলো। পিতলের কলটা ঝিলিক দিচ্ছে আর সঙ্গে শেওলা পড়া দেয়াল।

কিবরিয়া স্যারের কাছে শিখেছি আবেগ। আরেকজন ছিলেন কাজী গিয়াস স্যার। তিনি ওয়াটার-কালার শেখাতেন। হালকা লেয়ারের ওপর লেয়ার। আমরা দেখতাম পাশে দাঁড়িয়ে।

 

জুলফিকার রাসেল : আপনার কাজের মধ্যে কোন শিক্ষকের প্রভাব বেশি?

জামাল আহমেদ : আমি ছোটবেলায় শাহাবুদ্দিনকে বেশি ফলো করতাম। শিক্ষক না হলেও তাঁর প্রভাবটাই সবচেয়ে বেশি। তিনি শক্তিশালী আর্টিস্ট। শিক্ষক হলেই যে ভালো আর্টিস্ট হবেন, এমন নয়। অনেক ভালো শিক্ষক আছেন কিন্তু ছবি আঁকতে পারেন না। আমি যখন জাপানে গেলাম তখন শাহাবুদ্দিন এবং জাপানিজ শিক্ষা আর আমার নিজস্বতা মিলিয়ে একটা টেকনিক পেয়ে গেলাম। যেমন, যারা বেশি ওয়াটার-কালার করে তারা বেশ পাতলা রঙের বা বেশি ওয়াশ দিয়ে কাজ করে। কিন্তু তেলরঙে তো ওয়াশ দিয়ে কাজ করা মুশকিল। এত তারপিন, লিনসিড অয়েল পাওয়া মুশকিল। এমন সময় ১৯৮৫ সালে প্রথম দেখলাম অ্যাক্রিলিক কালার। দেখলাম, এতে তো শুধু পানি হলেই হয়। আমি প্রথম বাংলাদেশে এই কালার নিয়ে আসলাম। এখন কিন্তু সবাই অ্যাক্রিলিক ব্যবহার করে। তখন বাংলাদেশে এটা কেউ চিনতো না। আবিষ্কার হয়েছে ১৯৪৩ সালে, ঘরের কালার হিসেবে। ১৯৫৫ সালে কিছু আর্টিস্ট এটা নিয়ে শুরু করলেন ছবি আঁকা। তারপর আস্তে আস্তে আর্টিস্টরা সবাই ব্যবহার করলেন।

 

জুলফিকার রাসেল : কিন্তু টেকনিকটা কী? আপনি তো ম্যাটেরিয়ালের কথা বললেন।

জামাল আহমেদ : তেলরং আর অ্যাক্রিলিকের টেকনিক একই। একটায় তেল লাগে, আরেকটায় পানি।

 

জুলফিকার রাসেল : আপনি যে বললেন নিজস্ব একটা টেকনিক আনলেন?

জামাল আহমেদ : সবাই তো পেইন্টিংয়ের মতো করে। যেভাবে অয়েল-কালার করে, রঙ লাগিয়ে লাগিয়ে পেস্ট করে। আমি এটা ওয়াটার-কালারের মতো করে করলাম। ওয়াটার-কালার যেভাবে করে সেভাবেই ওয়াশ দিয়ে অ্যাক্রিলিক দিয়ে করলাম। মনে হবে ওয়াটার-কালার দিয়ে করেছি। যেমন, ইংল্যান্ডের কয়েকজন আর্টিস্ট আসলেন। ইন্ডিয়াতে একটা আর্ট ক্যাম্প হয়েছিল। ওয়াটার-কালার আর্ট ক্যাম্প। আমি অ্যাক্রিলিক নিয়ে গেলাম। এটাও তো ওয়াটার মিডিয়াম। ওরা বলতো, তুমি এটা কীভাবে করো? এটা তো ওয়াটার-কালারও না, অয়েল-কালারও না। ওরা অ্যাক্রিলিক চেনে, কিন্তু জানতে চাইল স্টাইলটা এমন কেন? আমি তাদের দেখালাম কীভাবে করি।

 

জুলফিকার রাসেল : জাপানের আর্ট কেমন দেখলেন?

জামাল আহমেদ : জাপানিজ শিল্পীদের যারা জাপানে থাকে ওদের কাজ একরকম। আবার যেসব জাপানিজ বাইরে থাকে যেমন, প্যারিস কিংবা আমেরিকা থাকে ওদের কাজ অন্যরকম। জাপানে যারা আছে তারা খুব কনজারভেটিভ। লাইনের বাইরে যাবে না। যে নিয়মে করতে হবে সেই নিয়মেই করবে। মেথড বা টেকনিক যেটা করতে হবে সেটার মধ্যে থেকেই করতে হবে। এর বাইরে যাবে না।

 

জুলফিকার রাসেল : তার মানে আবেগ নেই?

জামাল আহমেদ : ইমোশনটা কম। তুমি দেখো জাপানিজ কত কিছুর নাম বলতে পারবে—গাড়ি, ক্যামেরা। কিন্তু একজন জাপানিজ আর্টিস্টের নাম বলো দেখি! পারবে না। আর্টিস্টরাও পারে না অনেকে। যারা পারবে তাদেরও চিন্তা করতে হবে। আমিও এক-দুইজনকে চিনি।

 

জুলফিকার রাসেল : তা হলে জাপানে গেলেন কেন?

জামাল আহমেদ : স্কলারশিপ পেয়েছিলাম। আর জাপানে কাজ করতে সুবিধা। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি গলফ মাঠ জাপানে, কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হয় ইন্ডিয়া। মাঠ থাকলেই তো হবে না, মানুষও থাকতে হবে। তেমন, জাপানের টেকনিক থাকলেই হবে না, ইমোশনটাও লাগবে। যার কারণে তারা নাম করতে পারছে না। তবে নামকরা কিছু স্টাইল আছে। যেমন, নিহঙ্গা স্টাইল। এটা চাইনিজ স্টাইলে করা। ওটাতে ওরা খুব ভালো করে। পেইন্টিংয়ে তেমন নেই। তবে যারা আছে তারা জাপানের বাইরে থাকে। তবে ওখানে ম্যাটেরিয়াল সস্তা, স্কলারশিপও পেয়েছি—এজন্য গিয়েছিলাম।

 

জুলফিকার রাসেল : আপনার প্রিয় ম্যাটেরিয়ালস কী?

জামাল আহমেদ : এখন তো অ্যাক্রিলিক আর চারকোল।

 

জুলফিকার রাসেল : দেখলাম একটা ছবি আঁকছেন, সব মিক্সড।

জামাল আহমেদ : মিক্সড করি। যখন যেটা লাগে আর কী। যেখানে আমি ফিল করি এটা দিলে ভালো হবে তখন ওইটাই দেই। অ্যাক্রিলিক দেই, চারকোল দেই। তেলরংও দেই। যা থাকে তাই দেই। তবে জিনিসটাতে রসবোধ থাকতে হবে।

 

জুলফিকার রাসেল : আপনার কিছু কমন সাবজেক্ট আছে। যেমন, এখন দেখছি ঘোড়া, মাঝে দেখতাম পায়রা—এর কারণ কী?

জামাল আহমেদ : একেক সময় একেকটা ভালো লাগে। ঘোড়া কিন্তু আমাদের সঙ্গে যায় না। ঘোড়ার একটা ফোর্স সৌন্দর্য আছে, ডায়নামিক পাওয়ার আছে। শাহাবুদ্দিন ভাই বলেন, পাওয়ার।

 

জুলফিকার রাসেল : শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের কাজে আপনি বেশ অনুপ্রাণিত?

জামাল আহমেদ : হ্যাঁ। শাহাবুদ্দিন ভাই আঁকেন ঘোড়া। ইন্ডিয়ার সুনীলও আঁকেন। তারটা আবার সুন্দর ঘোড়া। আর শাহাবুদ্দিন ভাই বা আমি যেটা আঁকি সেটা হলো পাওয়ার। ঘোড়া দৌড়াচ্ছে কিংবা একটা মোশন আছে। এটা করতে চাই। হয় কিনা জানি না।

 

জুলফিকার রাসেল : আপনার কি মনে হয় বাংলাদেশের মানুষ আর্ট বুঝতে শিখেছে? আগে তো অনেকেই বলতো, আর্টের কোনো চাহিদা নেই। এখন কি চাহিদা তৈরি হয়েছে?

জামাল আহমেদ : সব দেশের মানুষই আর্ট বোঝে কম। আমেরিকা, জাপান, ইউরোপ এবং বাংলাদেশেও বোঝার মতো মানুষ কম। অল্প মানুষই বোঝে, কঠিন বিষয় তো।

 

জুলফিকার রাসেল : কিন্তু ধনীরাই কেন আর্ট কেনে বেশি?

জামাল আহমেদ : ধনীদের তো টাকা আছে। একটা ছবি কেনার পর কেউ দেখে যদি বলে ওয়াও এটা তো দারুণ ছবি, তখন তারা আবার কেনে। এমন আমার বেলায় অনেক হয়েছে। যেমন, একজন ভদ্রলোকের স্ত্রীর খুব ইচ্ছে ছবি কেনার। ভদ্রলোক কিনতে চান না। পরে একটা কিনলেন। তারপর বাসায় ছবিটা যখন ঝোলালেন, তখন সবাই বাহবা দিতে শুরু করলো। তখন উনিই ছবি কেনা শুরু করলেন। মানুষের বাহবা পেতে কিন্তু ভালোই লাগে। তোমাকে যদি কেউ বলে, তোমার শার্টটা খুব সুন্দর, তুমি কিন্তু খুশি হবে।

আর দেয়াল তো কেউ খালি রাখতে পারে না। এত সুন্দর সুন্দর বাড়ি হচ্ছে। ঢাকা শহরের এই সুন্দর সুন্দর বাড়ির দেয়ালগুলোতে শুধু ক্যালেন্ডার লাগাবে না কেউ। তুমি সুন্দর গাড়ি কিনছো, সুন্দর পোশাক পরছো—তো তোমার দেয়াল খালি থাকবে কেন? অবশ্য প্রথমে মানুষ উল্টা-পাল্টা ছবি কেনে। কেনার পরে বুঝতে শুরু করে আরে এটার রঙটা তো কাঁচা। ড্রয়িংটা ভালো লাগছে না। তখন নামিয়ে ফেলে। পরে আস্তে আস্তে যখন চোখ তৈরি হয় তখনই একজন মানুষ ভালো শিল্পীদের ছবি কেনা শুরু করে। প্রথমেই তো কামরুল হাসান কেউ নেবে না। মানে রুচি বদলালেই মানুষ খুঁজে খুঁজে শিল্পীদের ছবি বের করে। ১৯৮৭ সালের দিকে তো শাহাবুদ্দিনের একটা ছবি, একটা মোবাইল আর একটা পাজেরো না থাকলে তুমি ধনীই না। আমি বলছি না এটা আহামরি কিছু, কিন্তু এমন মানসিকতা ছিল। শো-অফ করতে গিয়েই মানুষ আর্টের প্রেমে পড়ে যায়।

 

জুলফিকার রাসেল :  আপনার কি মনে হয় বাংলাদেশে ছবির দাম বেশি?

জামাল আহমেদ : আমাদের দেশে বেশি। মধ্যবিত্তরাও ছবি চায়। তাই মনে হয়, আর্টিস্টদের কিছু ছবি প্রিন্ট করলে ভালো হয়। যেমন, হোসেনের ছবি অনেক প্রিন্ট হয়েছে। শাহাবুদ্দিনও করেছেন। তারও অনেক ছবি কম দামের মধ্যে আছে। এমন হলে সবাই কিনতে পারে। ছবি এমনিতে সবার জন্যও নয়। তবে আমি চাই সবার জন্য হোক। কিন্তু সবার সাধ্যের নাগালে থাকে না।

গতবার একটা শো করেছিলাম। তখন আমার ছবিগুলা বড় বড় ছিল। দামও বেশি ছিল। পাঁচ লাখ, তিন লাখ, দুই লাখ টাকা, এমন। অনেককেই দেখেছি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছেন, জামাল ভাই একটা ক্যাটালগ দেবেন? আমার তখন খুব খারাপ লাগতো। আমার মনে হতো, আহারে এই ছবিটার দাম এত যে নিতে পারলো না। এবার কিন্তু আমি একটা এক্সিবিশন করেছি। সেখানে প্রায় পঞ্চাশটার মতো ছবি ছিল। ছবিগুলোর সাইজও ছিল ছোট। ২০-২৫ হাজার টাকার ছবি ছিল। অনেকেই কিনেছে। এটা আর্টিস্টদের বোঝা উচিত।

জামাল আহমেদ জুলফিকার রাসেল : আপনি একজন অধ্যাপক। অনেক শিক্ষার্থী আসে। আপনার কি মনে হয় এখনকার তরুণ শিল্পীরা দ্রুত জনপ্রিয় হওয়ার চেষ্টা করে?

জামাল আহমেদ : কিছু আছে খুব তাড়াতাড়ি জনপ্রিয় হতে চায়। ছবির দাম বাড়িয়ে দেয়। আমি তাদের বলি, আমরা তো খুব তাড়াতাড়ি হইনি, তোমরাও ধীরে ধীরে হও। এখন তোমার ছবি আর আমার ছবি যদি এক দাম হয়, মানুষ তোমারটা নেবে না, আমারটা নেবে। অনেকেই তখন দাম কমায়। আমাকে কেউ যদি বলে, এই ছবিটা এত টাকায় দিন, আমি বলি ঠিকাছে নিন। আমার কাছে মনে হয়, এই গরিব দেশে মানুষ যে ছবির জন্য অর্থ দেয় এটাও তো কম না। হয়তো অনেকে বলবে, আমি বাজার নষ্ট করি। আমি এসব নিয়ে ভাবি না। এতে আমার কোনো ক্ষতি নেই। কারণ এতে করে তো ঘরে ঘরে আমার ছবি যাচ্ছে। ঢাকা শহরের অনেকের বাসাতেই আমার ছবি আছে। আমি তো একটা ব্র্যান্ড হয়ে গেছি। এখন দেখো মেয়র সাহেব বললেন, জামাল ভাই আমার একটা ছবি দরকার, পুরান ঢাকার হতে হবে। তো, আমি কি বলবো নাকি যে এত টাকা দিতে হবে? এটা কি বলা যায়? আরে উনি ছবি ভালোবাসেন এটাই তো অনেক। আমি তো জানি তিনি টাকা দেবেন। আমি তোমাকে চিনি, এখন তুমিও যদি বলো আমাকে একটা ছবি দিতে হবে। আমি জানি তুমি জানো আর্টিস্টের দাম আছে। তারপরও আমি কি বলতে পারি, আমাকে এত টাকা দিতে হবে? কখনই বলবো না। তবে অনেকেই বলেন।

 

জুলফিকার রাসেল : আপনার কি মনে হয় দেশে ছবি এঁকে জীবিকা নির্বাহ করা সম্ভব?

জামাল আহমেদ : হ্যাঁ সম্ভব। অনেক আর্টিস্ট তো করছে।

 

জুলফিকার রাসেল : এমন কয়জন আছে?

জামাল আহমেদ : আমার ছাত্রদের অনেকের চাকরি নাই। তারা তো করছে। অনেকে তো গাড়ি-বাড়িও করে ফেলেছে। এটা সম্ভব।

 

জুলফিকার রাসেল : তার মানে তো আর্টের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল?

জামাল আহমেদ : অবশ্যই উজ্জ্বল। মানুষের রুচি বদলাচ্ছে, নতুন নতুন বাড়ি হচ্ছে। আমার মনে আছে, একবার আমার এক বন্ধুর মেয়েকে তার বিয়েতে আমার একটা ছবি দিয়েছিলাম। আমেরিকায় নিয়ে গেছে যাওয়ার সময়। সে ফোন দিয়ে বলল, আঙ্কেল আমি এত গিফট পেয়েছি কিন্তু কিছুই আনিনি। শুধু আপনার ছবিটা এনেছি। আমেরিকায় সে কী নিয়ে যাবে? ওভেন, ফ্রিজ এসব? নিলে আর্টই নিয়ে যাবে। ২৫-৩০ বছর আগের কথা। একবার আমার বাসায় এসেছেন পরিচিত এক ভদ্রলোক। তার গার্মেন্ট আছে। এসেছেন এক স্প্যানিশ নিয়ে। সে বলল, আই নো ইউ, আই হ্যাভ সিন ইউর পেইন্টংস। তোমার কাছে ছবি আছে কিনা? আমি তখন দেখালাম। সে দামের কথা জিজ্ঞেস করলো আমি দুটো ছবি ১৫ হাজার করে ৩০ হাজার টাকার কথা বললাম। সে দিয়ে দিলো। যে নিয়ে আসলো সে আবার বিরাট ধনী। তিনি বললেন, এটা কি হলো জামাল? আমি তো দুই টাকা দিয়েও নেব না। আমি বললাম, দিস ইজ নট ফর ইউ। যার বোঝার সে ঠিকই বুঝেছে। এরপর তারা চলে গেলো।

ছয়-সাত মাস পর ওই ভদ্রলোক ফোন দিলেন। স্পেনে গিয়ে ডিনার পার্টিতে গিয়ে দেখলেন দেয়ালে সেই ছবি দুটো। এত সুন্দর ফ্রেম করেছে যে তিনি দেখে আঁতকে উঠেছেন। তিনি তখন বললেন, আরে এটা তো জামালের ছবি! পার্টিতে যারা ছিল সবাই তখন খুব প্রশংসা করছিল। এরপর ঢাকা এসেই আমাকে ফোন দিলেন। বললেন, জামাল আমার ছবি লাগবে। দুইটা ছবি দাও। আমি বললাম, আপনি তো দুই টাকা দিয়েও ছবি নেবেন না, ছবি দিয়ে কী করবেন। তিনি বললেন, আরে মিয়া ফাইজলামি করো নাকি। আমার লাগবে। তারপর তাকে ঘোড়ার ছবি দিলাম। আমাকে ৫০ হাজার টাকা দিলেন। এখন তার ছেলেও আমার ছবি কেনে। অথচ দেখো এর আগে সে দুই টাকা দিয়েও ছবি কিনবে না বলেছিল। ওই যে বিদেশ গেছে ছবি, সেখানে দেশ সম্পর্কে এপ্রিসিয়েশন পেয়েছে।

 

জুলফিকার রাসেল : করোনাকালে দেশের আর্টিস্টদের অবস্থা কেমন ছিল?

জামাল আহমেদ : করোনাকালে যেসব আর্টিস্টরা ভালো ছবি আঁকে, তারা কিন্তু ছবি ডোনেট করেছে। আমি নিজেও ১৫টা ছবি আর্টিস্ট অ্যাসোসিয়েশনকে ডোনেট করেছি। ছোট ছোট ছবি। ২০ হাজার কিংবা ৩০ হাজার টাকা দামের ছবি। এরমধ্যে ৮-৯টা বিক্রি হয়ে গেছে। ওই টাকা আমি নেইনি। যেসব আর্টিস্টদের চাকরি ছিল না বা যাদের এই সময়ে আয় ছিল না তাদের দেওয়া হয়েছে। আমি একা দেইনি। অনেকেই দিয়েছেন।

 

জুলফিকার রাসেল : রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল?

জামাল আহমেদ : হ্যাঁ, সরকার থেকেও আর্টিস্টদের অর্থ সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে। শিল্পকলা একাডেমি অনেক আর্টিস্টকে সহযোগিতা করেছে।

 

জুলফিকার রাসেল : শিল্পকলা একাডেমি তো আমাদের সংস্কৃতিকর্মীদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। আপনার কি মনে হয় শিল্পকলা একাডেমি যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে?

জামাল আহমেদ : আমার তো মনে হয় আগের চেয়ে শিল্পকলা একাডেমির তৎপরতা এখন বেশি। একদিকে নাটক হচ্ছে, একদিকে গান হচ্ছে, আরেকদিকে নাচ। জমজমাট থাকে। পাঁচ-দশ বছর আগে এসব দেখিনি।     

 

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
জাবির সিনেট ও সিন্ডিকেট প্রতিনিধি নির্বাচন: বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের নিরঙ্কুশ জয়
জাবির সিনেট ও সিন্ডিকেট প্রতিনিধি নির্বাচন: বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের নিরঙ্কুশ জয়
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক