কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে শুরু হয়েছে ৮০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী কুড়িখাই মেলা। সোমবার (৮ ফেব্রুয়ারি) থেকে শুরু হওয়া এ মেলা চলবে রবিবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত। সপ্তাহব্যাপী মেলার প্রথমদিন থেকেই জনতার ঢল নামে। শুধু কটিয়াদীর নয়, জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন মেলায় এসে উৎসবে মেতে উঠেছেন।
মেলা উপলক্ষে রেওয়াজ অনুযায়ী গ্রামের জামাইদেরও ঘটা করে দাওয়াত দিয়ে করা হচ্ছে আদর-আপ্যায়ন। সেইসঙ্গে নাইওরে আসছে গ্রামের মেয়েরাও। মেলার শেষের দিনে এলাকার নারীরা কেনাকাটা ও আমোদপ্রমোদ করেন। সবকিছুতে থাকবে নারীদের প্রাধান্য। এরই মধ্যে বাড়িবাড়ি শুরু হয়ে গেছে পিঠা উৎসব।
কুড়িখাই গ্রামের এক থেকে দেড় কিলোমিটার এলাকায় মেলা উপলক্ষে বিভিন্ন দোকানপাট বসেছে। বিশেষ করে কাঠের আসবাবপত্র, শিশুদের খেলনা, দৈনন্দিন পণ্যসামগ্রী, মেয়েদের সাজগোছের জিনিস থেকে শুরু করে মুড়ি, মিষ্টি, খৈসহ এমন কিছু নেই যা মেলায় ওঠেনি। এসবই দরদাম করে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন ক্রেতারা। মেলাতে শিশুদের জন্য রাখা হয়েছে পুতুলনাচ, সার্কাস, মোটরসাইকেল রেস, নাগরদোলাসহ বেশকিছু আয়োজন। এসব দেখে শিশুদের পাশাপাশি বড়রাও আনন্দ পাচ্ছেন।
মেলার অন্যতম আকর্ষণ হলো মাছের হাট। মাছ ছাড়াও সাতদিন জুড়ে বেচাকেনা হয় কাঠের আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্যসামগ্রী। সবমিলিয়ে কয়েক কোটি টাকার বাণিজ্য হয় এ মেলায়।
মাছের হাটে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা বড় বড় মাছ উঠেছে। এসব মাছ চড়া দামে বিক্রিও হচ্ছে। স্থানীয়দের ধারণা, মেলার বোয়াল মাছ খেলে এ বছরের জন্য বিপদ-আপদ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। তাই বোয়াল মাছের দিকে সাধারণ মানুষের চোখ থাকে বেশি। তবে শুধু বোয়াল নয়, সব ধরনের বড় মাছই মেলাতে পাওয়া যায়। মূলত দাওয়াতি জামাইরাই এসব মাছের মূলক্রেতা। তারা শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে খুশি করতে বড়মাছ কিনে শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে যান।
মাছ বিক্রেতারা জানান, এ পর্যন্ত মেলায় ভালোই মাছ বিক্রি হচ্ছে। তাছাড়া প্রতিবছরের মতো এবারও মেলায় ক্রেতাদের ভিড় অনেক। ধনী-গরিব সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্যই মেলায় মাছ রয়েছে। আশা করি, এ বছরও লাভ হবে।
কুড়িখাই গ্রামের জামাই ফারুক মিয়া। প্রতিবছরই শ্বশুড় বাড়ির দাওয়াতে এখানে পরিবার নিয়ে বেড়াতে আসেন। এ বছরও মেলায় এসে সাড়ে তিন হাজার টাকা মূল্যের একটি বোয়াল মাছ কিনে শ্বশুড় বাড়ি গিয়েছেন। তিনি জানান, শুধু মেলা নয়, এখানকার রীতি আসলে পরিবারের মেলবন্ধন। প্রতিবছরই এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করি। তাছাড়া বাচ্চারাও মেলায় এসে বিভিন্ন রকম বিনোদনে মেতে উঠে।
মাজার ও মেলা পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাইনুজ্জামান অপু জানান, বহুবছরের ঐতিহ্যবাহী এ মেলায় প্রতিবছরই লাখ লাখ মানুষের সমাগম ঘটে। এবারও কোনও অংশে কম নয়। দেশের করোনা পরিস্থিতিতেও মানুষের মেলার প্রতি আগ্রহের বিন্দুমাত্র ঘাটতি হয়নি। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে এ মেলা। কুড়িখাই মেলা আজ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। শিশুসহ সব বয়সী মানুষ ঐতিহ্যবাহী এ মেলায় মেতে থাকবে বাকি দিনগুলো, এমনটাই প্রত্যাশা করছেন আয়োজকরা।
জনশ্রুতি রয়েছে, ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বারো আউলিয়ার অন্যতম শাহ সামছুদ্দীন (রহ.) প্রায় ৮০০ বছর আগে তার তিন সহচর শাহ কলন্দর, শাহ নাছির ও শাহ কবীরকে নিয়ে কুড়িখাই এলাকায় আস্তানা স্থাপন করেন। তিনি ইহলোক ত্যাগ করলে এখানেই তার মাজার গড়ে ওঠে। তার মাজারকে কেন্দ্র করে ১২২৫ সাল থেকে ওরস ও গ্রামীণ মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।