X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

অশিষ্ট কথা বলা অমিত শাহের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে

আনিস আলমগীর
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৩:৫১আপডেট : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৭:০৮

আনিস আলমগীর বাংলাদেশ সম্পর্কে অসৌজন্য, অসার কথা বলা ভারতীয় কিছু নেতার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আর এর শীর্ষে রয়েছেন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন হিন্দু মৌলবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সাবেক সভাপতি অমিত শাহ। অমিত শাহ সেই ব্যক্তি, যিনি ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গার সময় সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ডেপুটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন এবং ২০২০ সালের দিল্লি দাঙ্গার সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মন্ত্রিসভার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। গুজরাটের দাঙ্গায় প্রায় দুই হাজার এবং দিল্লির দাঙ্গায় ৫৩ জন মারা গেছে; যে দুই দাঙ্গায় সিংহভাগ নিহতরা ছিল মুসলমান।

গত ১১ ফেব্রুয়ারি অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গের এক জনসভায় বাংলাদেশ থেকে কথিত অনুপ্রবেশের ইস্যু নিয়ে আবারও উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ক্ষমতায় এলে সীমান্ত দিয়ে ‘কোনও মানুষ দূরে থাক– একটা পাখিও ঢুকতে পারবে না।’ পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস অবশ্য দাবি করছে, তাদের শাসনামলে অনুপ্রবেশ ঘটছে বলে কেন্দ্রীয় সরকার যা বলছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

অমিত শাহের বাংলাদেশ নিয়ে বিদ্বেষপূর্ণ, অবমাননাকর মন্তব্য করার ইতিহাস দীর্ঘ। প্রায় প্রতিবছরই বাংলাদেশিদের নিয়ে অবমাননাকর কথা বলেন তিনি। ২০১৯ সালে বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশিদের খুঁজে খুঁজে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। ২০২০ সালের নভেম্বরে বিএসএফ-এর সঙ্গে এক বৈঠকে বলেছেন বাংলাদেশ থেকে ভোটার গিয়ে ভারতে ভোট দিয়ে আসে। সীমান্ত সিল করে দেওয়া হবে, যাতে ‘মশা-মাছিও’ ঢুকতে না পারে। তার এসব আপত্তিকর মন্তব্যের মধ্যে ২০১৮ সালে বাংলাদেশিদের ‘উইপোকা’ বলার বিষয়টি ভারতেও সমালোচিত হয়।

পশ্চিমবঙ্গ-আসামের বিজেপি নেতারাও মাঠের বক্তৃতায় ভারতে বাংলাদেশিদের ‘অনুপ্রবেশ’-এর কথা বলেন। গত ১৯ জানুয়ারি ২০২০, চব্বিশ পরগনার এক সমাবেশে পশ্চিমবাংলা বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছেন, রাজ্যটিতে ‘অবৈধভাবে’ বাস করা এক কোটি বাংলাদেশি মুসলিমকে ফেরত পাঠানো হবে। তিনি দাবি করেন, পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী এক কোটি অবৈধ মুসলিম সরকারের দুই রুপির ভর্তুকির চাল খেয়ে বেঁচে আছে। লক্ষ করুন, দিলীপ ঘোষ পশ্চিমবাংলার আড়াই কোটি মুসলমানের এক কোটিকে বাংলাদেশি বানিয়ে ফেরত পাঠানোর খায়েশ প্রকাশ করেছেন।

এটা এখন পরিষ্কার যে আগামী এপ্রিল-মে অনুষ্ঠিতব্য পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনকে ঘিরে বিজেপি বাংলাদেশ বিরোধী এসব প্রচারণায় নেমেছে। তাদের টার্গেট মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসকে হারিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গদি দখল করা। সেখানে ৩০ শতাংশ মুসলমানের ভোট বিজেপির বাক্সে যাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। আর ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে ভারতের ভোটের মাঠে সবচেয়ে সচল ‘পাকিস্তান কার্ড’ সেখানে অচল। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ‘বাংলাদেশ কার্ড’ চালাতে তৎপর। কারণ, দুই বাংলার রয়েছে দেশভাগজনিত লোক বিনিময়ের তিক্ততা, হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দুঃখজনক ইতিহাস। আবার ভাষা-সাহিত্য, সম্প্রীতি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ- সব মিলিয়ে রয়েছে দুই বাংলার ঐতিহাসিক বন্ধনও।

বাংলাদেশ বহুবার বলেছে, যেখানেই থাকুক উপযুক্ত প্রমাণসহ তালিকা দিলে বাংলাদেশ তার নাগরিকদের গ্রহণ করবে।স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েও অমিত শাহ সেটা দিতে পারেননি। কারণ, ভোটের মাঠে এই বক্তৃতাবাজি চালালেও অমিত শাহ ভালো করেই জানেন, ভারতে কোনও বাংলাদেশি ‍মুসলমান নেই, থাকলে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন সময়ে যাওয়া হিন্দুরা রয়েছে। এদের মধ্যে যারা পাকিস্তান আমলে গিয়েছেন তারা সিংহভাগ বিত্তশালী এবং শিক্ষা-সংস্কৃতিতে উন্নত শ্রেণি। যারা গরিব তারা দেশভাগের সময় যায়নি, তেমনি ভারত থেকেও গরিব মুসলমানরা আসেনি, এসেছে বনেদি মুসলমানরা।

অন্যদিকে, স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সামর্থ্যবান হিন্দুদের কেউ কেউ যাচ্ছেন ভারতকে হিন্দু সম্প্রদায়ের তীর্থভূমি জ্ঞান করে। আর কেউ কেউ যাচ্ছেন এখান থেকে বড় অংকের টাকা আত্মসাৎ করে। মামলায় পলাতক হয়ে। বাংলাদেশ বরং অভিযোগ করতে পারে যে, ভারত এদের দ্বারা অবৈধভাবে বাংলাদেশের সম্পদ পাচারে সহায়তা করছে এবং মুসলমান ছাড়া সবাইকে নাগরিকত্ব দিবে বলে ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল বা সিএবি-এর মুলা’ ঝুলিয়ে দেশত্যাগে উৎসাহ জোগাচ্ছে।

বাকি থাকে বাংলাদেশের মুসলিমরা। বাংলাদেশের মুসলিমরা তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বসবাস করতে কোন কারণে ভারতে যাবে–এই প্রশ্ন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র বাংলাদেশি নাগরিকের। ভারতে মুসলমানরা হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিতে পারে না, উচ্চ পদের সরকারি চাকরি পায় না, নিম্ন শ্রেণির বেসরকারি চাকরি করতে হলেও অনেককে ধর্ম গোপন করতে হয়। ভারতে হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানদের প্রেম-বিয়ে নিষিদ্ধ, গরুর মাংস খাওয়ার কারণে মুসলমানদের হত্যা করে- এসব বর্বরতা তো এখন বিশ্ববাসীর অজানা নয়। নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ জুটি ভারতকে তথাকথিত সেক্যুলার রাষ্ট্র নাম দিয়ে হিন্দু রাষ্ট্র বানিয়েছেন, যার অর্থনৈতিক অবস্থা বাংলাদেশ থেকে মোটেও ভালো নয়। সুখের সন্ধানে কে এমন অসহিষ্ণু রাষ্ট্রে যাবে যেখানে ধর্মে-ধর্মে ঘৃণা, বর্ণে-বর্ণে বিরোধ, ২০ কোটি মুসলমানকে নাগরিকত্বহীন করার পাঁয়তারা চলমান।

গত অক্টোবরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছে, মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ভারতকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আইএমএফ বলেছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের সম্ভাব্য মাথাপিছু জিডিপি তিন দশমিক আট শতাংশ বেড়ে হতে পারে এক হাজার ৮৮৮ ডলার। অন্যদিকে ভারতের সম্ভাব্য মাথাপিছু জিডিপি ১০ দশমিক তিন শতাংশ কমে হতে পারে এক হাজার ৮৭৭ ডলার। অর্থাৎ, এই প্রথম মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ ভারতের থেকে ১১ ডলার এগিয়ে যেতে পারে।

অথচ বিজেপির মন্ত্রীরা, এমনকি সুশীল শ্রেণিও প্রতিনিয়ত বলে আসছিল ভাত-কাপড়ের সন্ধানে বাংলাদেশিরা ভারতে পাড়ি জমাচ্ছে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিষাণ রেড্ডি একধাপ এগিয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা আশ্রয় চাইলে তারা ভারতে নাগরিকত্ব পাবে, কিন্তু মুসলমানদের জন্য এ সুযোগ রাখা হয়নি। কারণ, তাতে অর্ধেক বাংলাদেশি ভারতে চলে যেতে চাইবে! পরিস্থিতি যখন এমন তখন কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা তার সম্পাদকীয়তে সঠিক প্রশ্নই তুলেছে–‘কে কোন দিকে অনুপ্রবেশ করিবে, তাহাই এখন প্রশ্ন।’

অমিত শাহ ভাগ্যবান যে বহুদিন বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতার রাজনীতি হচ্ছে না। এই বিরোধিতার কোনও বাস্তব ভিত্তি না থাকলেও ভোটের বাক্সে একটা প্রভাব আছে। কারণ, ভারত বিরোধিতার নামে এখানে সূক্ষ্মভাবে হিন্দু বিদ্বেষকে উসকে দিয়ে মুসলমান ভোট পকেটে নেওয়াই ছিল প্রধান লক্ষ্য। গত এক দশক ধরে সেটা আর দেখা যাচ্ছে না। বরং বাংলাদেশের প্রধান দলগুলোর মধ্যে তারা ক্ষমতায় এলে কোন দল ভারতকে কতটা সহযোগিতা করবে, সেই প্রতিযোগিতা চলছে।

ভারত-বিরোধিতার রাজনীতি থাকলে রাজনৈতিক দলগুলোর মাঠের বক্তৃতায় এখন বিপুল সংখ্যক ভারতীয় নাগরিকের বাংলাদেশের বিভিন্ন এনজিও, গার্মেন্টস, টেক্সটাইল, আইটি সেক্টরে কাজ করা এবং হুন্ডির মাধ্যমে ভারতে টাকা পাঠানোর বিষয় নিয়ে তোলপাড় করতো। রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেশন মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট তাদের ২০১৯ সালের রিপোর্টে দেখিয়েছে, ভারতীয় নাগরিকদের বাংলাদেশ থেকে পাঠানো অর্থের পরিমাণ চার বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কতজন ভারতীয় বাংলাদেশে বৈধ-অবৈধভাবে চাকরি করছে সেই সম্পর্কে সরকারি পরিসংখ্যান কোথাও পেলাম না।

অফিসিয়াল তথ্যমতে, ২০১৮ সালে সাড়ে ২২ লাখ বাংলাদেশি পর্যটক হিসেবে ভারত গিয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই বিপুল সংখ্যক পর্যটক ভারতের অর্থনীতিতে কী পরিমাণ ভূমিকা রাখে, করোনা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশি পর্যটকের অনুপস্থিতিতে কলকাতার ব্যবসা-বাণিজ্যের কী হাল হয়েছিল–সেটা অমিত শাহ না জানলেও কলকাতার ব্যবসায়ীরা ভালোভাবে টের পেয়েছেন।

করোনাকালে বাংলাদেশি রোগীর অভাবে একই হাল হয়েছে ভারতীয় হাসপাতালগুলোর। বিদেশি পর্যটক হিসেবে বাংলাদেশিরা যেমন ভারতে প্রথম স্থান দখল করে আছে, তেমনি চিকিৎসার জন্য বিদেশি হিসেবে ভারতে শীর্ষস্থানে বাংলাদেশিরাই। লাখ লাখ বাংলাদেশি প্রতিবছর দিল্লি, তামিলনাড়ুর ভেলোর, মাদ্রাজ; তেলেঙ্গানার হায়দ্রাবাদ; কর্ণাটকের ব্যাঙ্গালোর এবং পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় চিকিৎসার জন্য ছোটেন। সে কারণেই ভারত তাগাদা দিয়ে দু’দেশের মধ্যে বিমান সার্ভিস চালু করেছে।

বিজেপি সরকার মুখে বাংলাদেশকে এই অঞ্চলে ভারতের অন্যতম বন্ধু বললেও বাস্তবে অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা, সীমান্তে বিএসএফ-এর মানুষ হত্যা বন্ধ করার মতো দ্বিপাক্ষিক ইস্যুর পাশাপাশি রোহিঙ্গা সমস্যার মতো আন্তর্জাতিক ইস্যুতেও ঢাকার পাশে দিল্লিকে পাওয়া যায় না। অবশ্য দুই দেশের বন্ধুত্বের নিদর্শনের ইতিহাসও কম নয়। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো যখন ঝুলে থাকে তখন কোভিড মহামারিতে বাংলাদেশকে ভারতের ২০ লাখ ভ্যাকসিন উপহার নগণ্য হয়ে যায়। বরং বাংলাদেশিদের আড্ডায় বড় করে উঠে আসে বাংলাদেশকে করিডোর হিসেবে ব্যবহার করে ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগ বৃদ্ধি, বাংলাদেশের সহায়তায় সেভেন সিস্টারের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন করে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরিয়ে আসার বিষয়।

বাংলাদেশ নিয়ে বেফাঁস মন্তব্য করার আগে অমিত শাহের এসব কিছু জানা দরকার।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

[email protected]

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিশ্বসাহিত্যের খবর
বিশ্বসাহিত্যের খবর
দেশজুড়ে এমপিরাজ শুরু হয়েছে: রিজভী
দেশজুড়ে এমপিরাজ শুরু হয়েছে: রিজভী
স্কুল ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
সেন্সর বোর্ডের সিদ্ধান্ত, রাফীর সিনেমাটি প্রদর্শনের অযোগ্য!
সেন্সর বোর্ডের সিদ্ধান্ত, রাফীর সিনেমাটি প্রদর্শনের অযোগ্য!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ